প্রসঙ্গ : অমিত শাহ’র ভার্চুয়াল ভাষণ বিতর্ক !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
গতকাল পশ্চিমবঙ্গের জনগণের উদ্দেশ্যে বিজেপি’র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে অভিনব ভাষণ দিলেন--তাকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভাষায় ‘ভার্চুয়াল’ বলা হচ্ছে। ময়দানে লক্ষ লক্ষ টাকার প্যাণ্ডেল তৈরি করতে হয় নি--জনবহুল রাস্তায় জ্যামজটও তৈরি হয় নি--রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আটকিয়ে ধোলাই-পেটাইও হয় নি--লোকে ঘরে বসে বসেই চায়ে চুমুক বা পকোড়ায় কামড় দিতে দিতে অমিত শাহ’র ভাষণ শুনেছে--অনেকেই গোটা ভাষণটাই ভিডিও
রেকর্ডিং করে নিতে পেরেছে। কোথাও কোনো গণ্ডগোল-হাতাহাতি-বিশৃঙ্খলা ছিল না। যত মানুষের কানে কথাগুলো পৌঁছে
দেওয়ার টার্গেট ছিল বিজেপি’র তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের কাছে অমিত
শাহ’র উচ্চারিত প্রতিটি অক্ষর পৌঁছে দিয়েছে বাংলার বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলো ! অনেকেরই
বিশ্বাস এবং রটনা ছিল বিজেপি এর জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বিজেপি
দলটি সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারণা আছে তারা জানে--বাংলার প্রতিটি ঘরে তাদের এই
ভার্চুয়াল ভাষণ কি ভাবে পৌঁছে দিতে হয় সেটা বিজেপি জানে এবং সেই কাজটা বাংলার
বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলো করেছে। অনেকেই বলছে বাংলা যখন করোনা ও আমফানের
তাণ্ডবে দিশেহারা--হাজার হাজার মানুষের পেটে ভাত নেই, মাথার ওপর ছায়া নেই, তেষ্টার জল নেই--ঠিক তখনই অমিত শাহ এই ‘চূড়ান্ত অমানবিক’ ভার্চুয়াল ভাষণের লগ্ন বেছে নিলেন কেন? নিলেন, কারণ অমিত শাহ জানেন এ রাজ্যে মাত্র মাস
দশেকের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে--যার সিংহভাগ সময়টাই চলে যাবে করোনা ও
আমফানের বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠে দাঁড়ানোর ব্যস্ততায়। ফলে নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্যে
যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে না প্রচারের ক্ষেত্রে। বড় বড় জনসভার আয়োজন করাও কঠিন
হবে--লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত বা অংশগ্রহণও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। কিন্তু
নির্বাচনকে ঠেকানো যাবে না। নির্বাচন যথা সময়ে হবে বলে এখনও মনে করা হচ্ছে। করোনায় গোটা বিশ্বের মধ্যে আমেরিকা সবচেয়ে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত--তবু সেখানে আগামী নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন হবে--এটা
ডেমোক্র্যাট ও রিপাব্লিকান--এই দুটি দলই জানে। মারাত্মক করোনা আবহে তাদের
নির্বাচনী প্রস্তুতি অন্যান্যবারের মতো হৈ-হৈ করে না হলেও চলছে। প্রাথমিক স্তরের
নির্বাচনী কাজকর্ম চলছেই। কারণ সে দেশে নির্বাচন স্থগিত রাখার উপায় নেই। কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গে আছে--অভাবিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত রেখে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি
করে ছ’মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার উপায় আছে। কিন্তু কোনো ক্ষমতাসীন দল-ই
সেটা চাইবে না। সুতরাং একুশের নির্দিষ্ট সময়ে যে নির্বাচন হচ্ছেই এটা মাথায় রেখেই
অমিত শাহ’রা ময়দানে নেমে পড়েছেন। সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র সঙ্গে পুরোপুরি ব্যক্তি নির্ভর আঞ্চলিক
দলগুলোর মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এই দুই সর্বভারতীয় দল সমষ্টিগত
সিদ্ধান্ত নির্ভর দল (যদিও কংগ্রেসের মধ্যেও বেশ কিছুটা ব্যক্তি বা পরিবার
নির্ভরতা লক্ষ্য করা যায়)--মমতা-মায়াবতী-মুলায়ম- স্টালিন-লালুপ্রসাদ-উদ্ধব ঠাকরে-চন্দ্রশেখর প্রমুখ নেতানেত্রীদের
আঞ্চলিক দলগুলোর মতো ১০০% ব্যক্তি নির্ভর দল নয়। এই দলের সুপ্রিমোরাই দলের শেষ
কথা--দলের সংবিধান-গণতন্ত্র-আইন ইত্যাদি সবকিছুই তৈরি হয় বা ভাঙা হয় সুপ্রিমোদের
ইচ্ছানুযায়ী। ফলে এইসব দলের মধ্যে ব্যক্তির নিজস্ব আবেগ-ক্রোধ-অস্তিরতার দায়
সামলাতে হয় গোটা দলকেই। তাই এইসব দলগুলোকে প্রায়শঃই দেখা যায় আবেগতাড়িত হয়ে রাজনৈতিক মানবিকতা’র দোহাই পেড়ে দেশের সংবিধান-আইনকে পাশ
কাটিয়ে চলার প্রবণতায় ভুগতে। বিজেপি নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ প্রভাবিত
দল হলেও পুরোপুরি ব্যক্তি নির্ভর ব্যক্তি শাসিত দল নয়। বিশেষ বিশেষ দু’চারটি ক্ষেত্র ছাড়া বিজেপি সমষ্টিগত সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিয়ে চলা দল--একেবারে
পেশাদারি মানসিকতায় দল পরিচালনার বিষয়ে বিজেপি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মন্ত্রীসভাই হোক
বা দলীয় সাংগঠনিক সভাই হোক--এই দুটি ক্ষেত্রেই পদাধিকারিদের অংশগ্রহণ ও তাদের
মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কর্পোরেট কালচারটা কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় নি--বরং অনেকটা
বেড়েছে বলেই মনে হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারের বা দলের বিভিন্ন স্তরের
পদাধিকারিরাই নিজের নিজের সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হন--কিন্তু
এটা প্রায় একেবারেই দেখা যায় না আঞ্চলিকদলগুলোর রাজনৈতিক কালচারের মধ্যে।
সুপ্রিমোরা ভয় পান কারুরওেপর নির্ভর করতে--কে কখন কোথায় কি বলতে কি বলে ফেলবে--বা
অপ্রত্যাশিত ‘কেলো’ করে ফেলবে তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় ব্যক্তি নির্ভরতাই দলের একমাত্র
চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। এদিক থেকে কংগ্রেস ও বিজেপি’র রাজনৈতিক কালচার একেবারেই অন্য রকমের--মানুষ সেটা দেখে ও বোঝে। এই দুই দলের
রাজনীতির মধ্যে তাই, বিশেষ করে বিজেপি’র, কোনোরকম আবেগসর্বস্বতা দেখা যায় না। অমিত শাহ’র মতো একজন ১০০% রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যেও আবেগ আশা করার কোনো অর্থ হয় না।
অমিত শাহ’র এখন এক ও একমাত্র লক্ষ্য একুশের
বিধানসভা নির্বাচন এবং পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের পরিবর্তনকে বাস্তবায়িত করা। একজন
রাজনীতিক হিসেবে তিনি তাই অত্যন্ত ঠাণ্ডামাথায় সেই সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন যখন
রাজ্যের মানুষ রাজ্য সরকারের নানান ব্যর্থতায় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে (কারণগুলো আর
বিশদে ব্যাখ্যা করলাম না, সবাই দেখতে পাচ্ছেন) ! অমিত শাহ’ যা চেয়েছিলেন--ময়দানের বিশালমাপের যাগযজ্ঞের আয়োজন না করেই ঘরে ঘরে তাঁর
বক্তব্য পৌঁছে দিতে--সেটা তিনি সকলকে প্রায় চমকে দিয়ে করতে পেরেছেন। কেন্দ্রীয়
প্রকল্প থেকে রাজ্য সরকার মানুষেকে কীভাবে বঞ্চনা করছে--কীভাবে মানুষের টাকা নয়ছয়
করছে--সরকারি অর্থ নিয়ে কিভাবে দলবাজি করছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তাঁর নিজের
তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে তুলে করেছেন। তিনি জানেন, রাজ্যের মানুষ এখন ক্ষিপ্ত হয়ে আছে--চতুর্দিকে অসন্তোষ আর ক্ষোভ-বিক্ষোভে
উত্তপ্ত হয়ে আছে শহর গ্রাম--তাই এই সময়টাই তিনি বেছে নিয়েছেন। তিনি জানতেন
বিরোধীরা রে-রে করে উঠবে--তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে--কিন্তু তার প্রভাব কতটা পড়বে
বা গত ২০১৮’র শেষ দিক থেকে পড়ছে সেটাও তিনি দেখেছেন
এবং এখনও দেখতে চান। যথারীতি অমিত শাহ’র যাবতীয় অভিযোগ ১০০% মিথ্যে দাবি করে ডেরেক ও’ব্রায়ান, অমিত মিত্র, দীনেশ ত্রিবেদী প্রমুখ নেতৃত্ব নিজেদের তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা
করেছেন। তাঁদের এই অভিযোগ খণ্ডনের ভাষা ও ভঙ্গি এবং তথ্য-পরিসংখ্যানের মধ্যে নতুন
কিছু যে নেই সেটা মানুষ বুঝলেও তাঁরা নিজেরা তা বুঝতে চাইছেন না--বোধহয় বোঝার কোনো
উপায় নেই বলেই ! এই কায়দায় পাল্টা অভিযোগের চেষ্টায় কোনোরকম খামতি না রেখেও ২০১৯-এ
বিজেপিকে ঠেকানো যায় নি। একুশে এই একই কায়দায় বিজেপি’র মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে কতটা ঠেকানো যাবে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। যদিও
বিজেপিকে প্রথম থেকেই ঠেকানো অসম্ভব ছিল না। চূড়ান্ত ভুলের পর ভুল রাজনৈতিক
সিদ্ধান্ত বিজেপিকে এ রাজ্যে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত করতেই সাহায্য করে এসেছে। বিজেপি
ছাড়া মূল স্রোতের আর কোনো রাজনৈতিক দল এ রাজ্যে নেই যারা বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে সামান্যতম তৎপরতা দেখাতে পারে। এই ভার্চুয়াল ভাষণের মাধ্যমে বিজেপি ঘন ঘন
মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে যাবে--তাদের দলীয় প্রচার এমন একটা মাত্রায় নিয়ে
যেতে পারে যার ধারে কাছে যাওয়ার ক্ষমতা বিরোধীদের নেই বললেই চলে। ধার করা মগজ পি
কে-ও এখন রীতিমতো প্রমাদ গুণছেন। জেলায় জেলায় তাঁর মগজ দলের মধ্যে যে অসংখ্য ফাটল
তৈরি করেছে তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হবে দু’এক মাস পর থেকেই। একুশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে অমিত শাহ’রা এ রাজ্যে ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র চাষ করতে ছুটে আসবেন--এই প্রত্যাশাটাই চূড়ান্ত অরাজনৈতিক। আগামী মাসগুলোতে
আবেগসর্বস্ব রাজনীতির পথে হাঁটার মতো মোটা মেধার রাজনীতি মোটাভাইরা ভূলেও করবেন
না--আবেগহীন বাস্তবতার পথেই রাজনীতির পাশা ফেলতে থাকবে বিজেপি--সে পাশা খেলায় কে
জিতবে কে হারবে সেটা ভবিষ্যতই বলবে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ঠেকাতে শক্তিশালী
মেধাযুক্ত সেনার প্রয়োজন আবশ্যিক--যা এই মুহুর্তে তৃণস্তর পর্যন্ত তৃণমূলের মধ্যে
প্রায় নেই বললেই চলে--সেটা ঠিক এই জায়গায় পৌঁছে প্রশান্ত কিশোর হাড়ে হাড়ে টের
পাচ্ছেন--কিন্তু দলকে গঙ্গাজলে ধুয়ে পবিত্র করে তোলার চেষ্টায় তিনি যা করে ফেলেছেন
তার পরিণাম যে তাঁকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সেটা আর গোপন রাখা যাচ্ছে না।
অমিত শাহ’রা এ ভাবেই রাজনীতি করবেন--আরও নতুন নতুন
কায়দায় তাদের রাজনৈতিক পেশাদারিত্ব’র প্রমাণ রাখবেন। ফলাফল থাকছে ভবিষ্যতের
গর্ভে !!
কোন মন্তব্য নেই