"ধর্মনিরপেক্ষ" দেবতা গণেশ
অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী
ভারতীয় সভ্যতায় হাতিকে "গণেশ" বা
"গণেশবাবা" বলা হয়। এর সবচেয়ে বড় কারণ পৌরাণিক গণেশদেবতার মূর্তির
মুখটি হাতির। গণেশের মাথাটি হাতির কেন, সেই নিয়ে পৌরাণিক বা মাইথলজিক্যাল নানারকম কাহিনি আছে। গণেশের এক নাম 'গজানন'(দ্র. "হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশড. হংসনারায়ণ
ভট্টাচার্য)ধর্মশীল, ধর্মভিরু ও
ধর্মান্ধ সব রকমের মানুষই এই কাহিনিগুলোর তাৎপর্য নিয়ে অতশত ভাবে নাতাদের কাছে
আপাতত ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুখশান্তি আর স্বস্তি-সমৃদ্ধির কামনাই বড়
হয়ে ওঠে। দেবতার মুখে হাতির মাথা দেখে বিধর্মীরা বা নাস্তিকেরা কেউ কেউ হাসেনানা
অপব্যাখ্যা করে। কিন্তু ভারতীয় সভ্যতায় এসব যে আসলে প্রতীকী পুরাণকথা (সিমবলিক মিথ
)সেটাই ভুলে যায়। গণেশ তো গণ+ঈশ। গণপতি জনগণের দেবতা। হাতিও তো এমন প্রাণীযে
মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে সেই আদিম যুগ থেকে।
মানুষের সভ্যতায় যে-কয়েকটি প্রাণী মনুষ্যবন্ধু রূপে চিহ্নিতহাতি তার মধ্যে
অন্যতম। আমাদের আর্য ভারতীয় সভ্যতায় সেই আদ্দিকাল থেকেই ইতিহাসে, পুরাণে, লোককথায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, সংগীতে হস্তীউপাখ্যান নানাভাবে দেখা যায়।
মানুষের সাথি হাতি। রাজামহারাজার তো বটেইজনজীবনেও। হাতি মূলত বনজ। কিন্তু পোষ মেনে
মানুষের বন্ধু হয়ে যায়। অত বড় বিপুল শরীরকিন্তু হাতি খুব সরল। সেই সারল্যকে কেউ
কেউ অপব্যাখ্যা করে 'গজমূর্খ' বলে। তা বলুক। কিন্তু হাতি যে সরল এবং ভীষণ
আন্তরিকসেটা বোঝা যায় নানাভাবে। মাহুতের কথায় হাঁটু গেড়ে শুঁড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে আপনাকে পিঠে তুলে নেয়। শুঁড় দিয়ে আপনাকে
কাতুকুতু দেয় বা জল ছিটিয়ে খেলে। হাতি খুব ক্রীড়াপ্রিয়। একসময় সার্কাস
কোম্পানিগুলোতে হাতির রকমারি খেলা ছিল প্রধান আকর্ষণ। কেন~রাজেশ খান্না তনুজার "হাতি মেরে
সাথি" সিনেমাটা মনে নেই?!
'হস্তী' শব্দটি এসেছেহস্ত শব্দের সাযুজ্যে। মানুষের
হাতের মতো হাতির শুঁড়টি। অথচ শুঁড়টি কিন্তু নাক। হাত দিয়ে কাজ করি আমরা। √গজ ধাতুর অর্থ 'করা'। তাই তো হাতির আরেক নাম 'করি'। (দ্র. "বাংলা ব্যুৎপত্তি অভিধান :
শব্দগল্পদ্রুম"অভ্র বসু)।
হাতির এই সারল্যের পেছনে অনেকেই বলেনহাতি তৃণভোজী হওয়াটাই প্রধান কারণ।
তৃণভোজী প্রাণীরা মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। পোষ মানে। এত হিংস্র নয়। আর
নিরামিষ খেলে গায়ে বল হয় নাসেটাই-বা কে বলে! হাতি বা ঘোড়ার গায়ের বল কি কম?
কিংবা ষাঁড়? পৃথিবীতে কে কবে বাঘ সিংহ নিয়ে যুদ্ধে গেছে?
সে মাইথলজি বা লোককথা কিংবা
কাল্পনিক সাহিত্যে হতে পারে। বাস্তবেহাতি-ঘোড়াই মানুষের প্রধান যুদ্ধবাজ
বন্ধুপ্রাণী। মহাভারতের যুদ্ধে আমাদের অসমের ভগদত্তের হাতির নাম ছিলঅশ্বত্থামা।
সেই থেকে 'অশ্বত্থামা ইতি
গজঃ' নামক কথাটার শুরু।
ইন্দ্রের হাতির নাম যে 'ঐরাবত' সেটা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে 'ঐ' বর্ণের প্রয়োগ শিখতে গিয়ে শিখেছি। লোককথায় আছেহাতির মাথায় একটা মুক্তা বা মোতি
আছে। 'গজমুক্তা' নামে একটি সিনেমাই হয়ে গেল আমাদের অসমের
গৌরীপুরে রাজবাড়িকেন্দ্রিক। মুনমুন সেন অভিনয় করেছেন। গোয়ালপাড়া যখন এলই তখন মনে
পড়েপ্রতিমা পান্ডে বরুয়ার বিখ্যাত "হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামুনের
নারী...মাথায় নিয়া তামকলসী ও..." বা বা ড. ভূপেন হাজরিকার "হস্তীরে
নড়ান হস্তীরে চড়ান হস্তীর পায়ে বেড়ি~সত্য করিয়া কনরে মাউত ঘরে কয়জন নারী রে, তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর মাউত বন্ধু রে"
অবিস্মরণীয় সব গান। মাহুতের সাথে লোককন্যার ঘন বিরহী প্রেম...আহা!
লোককথা, লোকসংস্কৃতি আর
মিথের পরতে পরতে হাতি ভারতীয় সভ্যতার অঙ্গ রূপে এসেছে। মানুষ হাতিকে একটাই গ্রহণ
করে যে~বেশির ভাগ হাতির
শুঁড়ে তেল-সিঁদুর মাখে। এগিয়ে গিয়ে কলাটা মুলোটা খাওয়ায় যত্ন করে। হাতি আমাদের
পরম বান্ধব।
অথচ
চোরা শিকারিরা হাতি মারে। সেও এক অন্ধবিশ্বাসের জন্য। হাতির দাঁতে নাকি মানুষের
সৌভাগ্য লুকিয়ে আছে। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি প্রাচীন বা অ্যান্টিক জিনিস
সংগ্রহালয়গুলোতে দেখা যায়। দাঁতই হাতির কাল। চোরা শিকারিরা দাঁত কেটে নিয়ে যায়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে "পশুগণের
ক্রন্দন" শীর্ষক অংশে হাতির এই বেদনার কথা তুলে ধরেছেন।
"বড় নাম, বড় গ্রাম বড় কলেবর~
লুকাইতে নারি মাগো বনের ভেতর।"
কালকেতু বিশাল হাতিকে অনায়াসে পেয়ে শুঁড়ে ধরে আছাড় মারে। আর দাঁত উপড়ে
ফেলে...!
হাতির অনুষঙ্গে আমাদের ভাষায়ও কত সংযোজন। বাংলায় 'গজদন্তমিনার' বলে একটা কথাই আছে। অথবা 'অন্ধের হস্তীদর্শন'। এদিকে, 'গজদাঁত' তো মিষ্টি কিলিং হাসির জন্য ভীষণ হেল্ফফুল।
এখন
তো জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছের কুন্দা মেসিন দিয়ে তোলা হয়। একসময় লোকে হাতি পুষত
জঙ্গলের কাজ করার জন্য। মানুষের জন্য হাতি কী না করেছে!
হাতিকে নিয়ে কত কত গান কবিতা ছড়া, আঁকাবুকিকত কী! সুকুমার রায় লিখলেন
"মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি
নিম গাছেতে হচ্ছে সিম,
হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাগের বাসার বগের ডিম।"
আমি আমার পুত্র অন্তরের ছোটবেলায় মুখে মুখে
একটি ছড়া বানিয়েছিলাম~
"হাতি হাতি হাতি
কাউকে মারিস না লাথি"
অন্তর এটা বলত আর হেসে কুটোপাটি হতো। ওর ছোট্ট
কল্পনায় বুঝত~অমন গোদা পায়ের
লাথি মোটেও সুখকর হবে না।
রাজা-বাদশা-জমিদারদের যুদ্ধের সন্ধিতে কে কয়টা হাতি দেবেন তার উল্লেখ থাকত।
হাতিবাহিনী যত শক্তিশালী ততই সেই রাজা শক্তিমান। মিজুজুমলা অসম আক্রমণ করতে এসে
ব্রহ্মপুত্রের বর্ষায়, ম্যালেরিয়া আর
দুর্গম যাতায়াতে নাকালবর্ষার জলে বিধ্বস্ততখন ক্ষুধার জ্বালায় হাতি কেটে সৈন্যরা
খাচ্ছেসেই তথ্যও পাই। মিরজুমলার সঙ্গে আসা অজ্ঞাতনামা এক ওলন্দাজ নাবিকযোদ্ধার
বর্ণনায় এই কথা আছে।(দ্র. "মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য"আবদুল করিম,
পৃ.৭২)। আহোম রাজের সঙ্গে
মিরজুমলার যে চুক্তি হয়ওতে শর্ত হিসেবে দুই হাজার হাতি প্রদানের কথাও ছিল। হাতির
মাংস হিন্দুরা খায় বলে শুনিনি। মূলত আদিবাসী, জনজাতীয় কোনো কোনো সম্প্রদায় ও অহিন্দুরা খায়।
এখনও, আজকের দিনেও অসমে ট্রেনে
কাটা-পড়া হাতির মাংস কেটে ভোজ এবং পুলিশের গ্রেপ্তার শীর্ষক খবর টিভিতে দেখি।
হাতি বরাবর মর্যাদা, সম্পদ, প্রাচুর্য, শক্তি ও কল্যাণের প্রতীক। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি
বাড়ি এলে কথায় বলে'গরিবের ঘরে হাতির
পাড়া'!
হাতির চিকিৎসার জন্য নানারকম সংস্কৃত পুঁথি প্রচলিত ছিল। সারা ভারতে এসব
পাওয়া গেছে। আমাদের অসমেও আহোম আমলের একটি অতি দুর্লভ এইরকম রঙিন পুঁথি নিয়ে অসমের
বিশিষ্ট পণ্ডিত হেমচন্দ্র গোস্বামী স্যার আশুতোষের সাথে দেখা করেন। উদ্দেশ্যসেটার
ছাপার ব্যবস্থা করা। পুঁথিটির নাম "হস্তীবিদ্যার্ণব"। ওই নান্দনিক বইটি
দেখে স্যার আশুতোষ বিস্মিত হয়েছিলেন। অপূর্ব শিল্পকর্ম। আশুতোষ নিজের পুত্র
উমাপ্রসাদের সাথে পণ্ডিত গোস্বামীকে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের বাড়ি
পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে চিঠি লিখে দিয়েছিলেনতখনকার দিনে কালার প্রিন্ট করানোর ব্যবস্থা
করতে। এই ঘটনা পাই পণ্ডিত হেমচন্দ্র গোস্বামীর ডায়েরিতে। সুখের কথা~"হস্তীবিদ্যার্ণব" রঙিন ছাপা হয়েছিল।
বর্তমানে অসম প্রকাশন পরিষদ বইটি ছাপিয়েছে।
•••
সুশীল পাঠক, এহেন হাতি-মা আর
সন্তানকে অমন নৃশংসভাবে কারা হত্যা করেছে!? যাদের এই সভ্যতা-সংস্কৃতি-পরম্পরার প্রতি
বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই, হয়তো তারাই। তাই
নয় কি?
-অধ্যাপক, কটন কলেজ, গুয়াহাটি
খুব সুন্দর লেখনী
উত্তরমুছুন