সাংবাদিক, সংগ্রামী বন্ধু পীযুষ কান্তি দাসের স্মৃতিতে ...//
সুশান্ত কর
তিনিচুকীয়া
কবি দিগ্বিজয় পালকে মনে আছে? পেশায় হোমিও চিকিৎসক, নেশায় কবি? হাসপাতাল রোডে চেম্বার ছিল? যেখানে রোগী আসত কম, কবি লেখক সমাজকর্মীরা ভিড়তেন বেশি? Pijushএর মতো অকালে চলে গেছিলেন? সেখানে এসেছিল একদিন দুপুরে, পীযুষ ওর দেশের বন্ধু সঞ্জীব দেব রায়কে সঙ্গে নিয়ে। ঘণ্টাখানিকের আড্ডা আর আজীবনের বন্ধু। বাকিটা বলছি, রয়ে সয়ে। গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা, তথা 'আমাদের সমকালে'র প্রতিষ্ঠাতা সভ্যদের একজন ছিলেন দিগ্বিজয় পাল। তাঁর চেম্বার ছিল মহিমালয়ের পরে শহরে, দ্বিতীয় আড্ডা কবি লেখকদের। আরো ছিল, যেমন ভারতী, শঙ্করী। কিন্তু দিনে রাতের আড্ডা এই দিগ্বিজয় পালের চেম্বার। লেখক সংস্থার সদস্যরা তো ভিড়তেনই। কাছেই ছিল এ এস ই বি। চলে আসতেন সঞ্জীব দাস, কার্তিক মালাকার। আসতেন করুণা রঞ্জন। মহিমালয় না গেলে, অথবা ফেরার পথে। সেরকমই বিমল চৌধুরী, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী। আরো অনেকেই। আসতেন বিজয় ভট্টচার্য, স্মৃতি পালও উঠত। আসত সুজিত দাস। শোভনলাল ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ দত্ত। তখন তো আমাদের পায়ে হাঁটা। ফলে পথে বিশ্রামেরও একটা ব্যাপার ছিল। সেখানেই আলাপ Ashis Nath, Tusar Kanti Nath, Snigdha Nathএর সঙ্গে। এমন কি Arup Baisyaএর সঙ্গেও। সেরকমি একদিন পীযুষ এসে জুড়েছিল সেই আড্ডাতে। সে জি সি কলেজে পড়তে এসেছে,কমলা রোডে জেঠতুতো দিদির ভাড়া বাড়িতে থাকে। আর কবিতা লেখে। জুটে গেল লেখক সংস্থার কাজে। তখন অসম চুক্তি হবে হচ্ছে করছে। উত্তাল আশি। দেখে, আমরা সভা সমিতি করে বেড়াচ্ছি। মাইকও ফুকাচ্ছি। আর দিগ্বিজয় পাল, বিজয় ভট্টাচার্যরা প্রায়ই বেরিয়ে যেতেন রিক্সাতে মাইক জুড়ে পথে পথে কবিতা পড়তে। সুষেণ পালের মাইক। Subhaদাদের বলতে গেলে পার্টি মাইক। কিন্তু আমাদেরও আপনার জন ছিল সুষেণদা। কত ভাড়া যে মিটাই নি। তা পথের কবিতাতেও আমরাও সঙ্গী। কিন্তু পীষুষ আমাদের সঙ্গে ইণ্ডীয়ান স্টুডেন্ট এশোসিনেয়নেও (ISA) ভিড়ে গেল। গ্রামে গঞ্জে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু মনের কোথাও তো সেই সব দেশে রেখে আসা দায় ওকে তাড়া করত। দিদির সংসারও স্বচ্ছল ছিল না খুব। নিজেও শিক্ষকের ছেলে। বাড়িতে আরো চার ভাই বোন। আমাদের বলাবলি করল, একটা অস্থায়ী কাজ জুটলে দিদির ভার নামে। ওর আলাদা ব্যবস্থা হয়। আমাদেরও স্বার্থ ছিল, ওর আলাদা ঘর মানেই -- আমাদের আড্ডা, সভা সমিতি। বিজয়দাকে বললাম। সোনার কাছাড়ে তখন আমাদের আড্ডাও ছিল। রণবীরদাকে বলতেই রাজি। এর পর তো পাঠক দেখলেন, সোনার কাছাড়ে ওর চমক। অচিরেই ও কাগজের সহ সম্পাদক হয়ে গেছিল। পরেশদা ছিলেন। কিন্তু ভাব হতো সেই কাগজ চালাচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে তো সেই ৮৬র ভাষা আন্দোলন। মিছিলে হাঁটছে। পুলিশের তাড়া খাচ্ছে। ২৭শে মে, ১৯৮৬ আই এস এ-র সর্বভারতীয় সভাপতি সৌরভ বরা আততায়ীর হাতে মারা গেলে আমরা যখন তৎক্ষণাত হাজার মানুষের ভিড়ে প্রেমতলাতে পথ সভা করছি, পীযুষ তো সেখানে বাতি জ্বালিয়েছিল, স্লোগান তুলেছিল, উগ্রজাতীয়তবাদী সন্ত্রাসীদের ক্ষমা করা হবে না বলে। আজ এই দিনেই সে নিজে চলে গেল ৩৪ বছর পরে। আর এরই মধ্যে গান্ধিভবনে সভা করে বের করে ফেলল ওর প্রথম এবং একমাত্র কবিতার বই। এখন নাম ভুলে গেছি। উন্মোচন করেছিলেন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী। আমাদের সঙ্গে ও ৮৬ বা ৮৭-তে আই এস এ-র কলকাতাতে সর্বভারতীয় সম্মেলনেও গেছিল এক কাপড়ে। আশির শেষে নব্বুইর শুরুতে অসমের কাগজগুলোর শিরোনাম দখল করে রেখেছিল আলফা আর আর্মকার সংঘাতের সংবাদ। আমরা তখন গোটা অসমে সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করছি। তখন পীযুষ সাংবাদিকতার জন্যে নিত্যদিন সঙ্গী হতে না পারলেও ছিল সঙ্গে... এর পরে ও কেন বা রণবীর রায়ের প্রেরণাতে আবসা ইত্যাদি বলে দুই একটি ভিন্ন সংগঠনে গেছিল সেই জানে। কিন্তু আমাদের সঙ্গ সে কোনোদিনই ছাড়ে নি। তা না হলে Santasreeকে পায় কী করে? শান্তশ্রীর ভাই Bhaskar তো তখন Biswajitদার নেতৃত্বে কোরাসে নাটক করে। শান্তশ্রীও কিছু কিছু স্নিগ্ধদিদের সঙ্গে আসছে নারী মুক্তি সংস্থার সভা সমিতিতে। কিন্তু এর আগেও সবার যেমন থাকে ওর মনে এ ও এসেছে গেছে। এক বিখ্যাত কবিও আছেন এর মধ্যে। আমরা নাম দিয়েছিলাম পীযুষের 'মাধবীলতা'। এই সব করতে গিয়ে ওর লেখাপড়া উঠেছিল লাটে। আরো একটি চাপ ছিল । একে একে ভাইদের এনে শিলচরে দাঁড় করাচ্ছিল সে। প্রদীপকে ঢুকালো সোনারকাছাড়েই। বাকিদেরও এখানে ওখানে ব্যবস্থা করবার কথা কোনোদিনই সে ভুলে নি। আমরা সেকালের বন্ধুরা অধিকাংশই লেখা পড়াতে ভালো ছিলাম না। লেখাপড়া করে 'ক্যারিয়ারিস্টরা', সেই ভাবনা ছিল বড়। তবু টেনেটুনে আমি বিএ পাস দিয়ে দিলাম, এম এ টা হবে কি না হবে সংশয়ে ছিলাম। পীযুষ আটকে গেছিল। ওকে এসে উদ্ধার করল শান্তশ্রী। ততদিনে শান্তশ্রী স্নাতক। সে পীযূষকে স্তাতক করে। নিজে যখন ইংরেজি নিয়ে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছে... তখন একদিন যুগল কোপোত কপোতিকে কামাখ্যা পাহাড়ে আবিষ্কার করেছিলাম --'আবছা মনে পড়ছে। শান্তশ্রীর উৎসাহে সে অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে মাস কমে ডিপ্লোমা করতে যায়। দুজনেই করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসকম বিভাগের এরা ছিল প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রী। এর পরে বাংলাতে গবেষণা করবে বলে করা হলো না নানা কারণে। শেষে এই সেদিন Charvakদার কাছে গিয়ে আবার মাসকমে নাম লেখায় গবেষণা করবে বলে। কিন্তু এবারে শত্রুতা করতে শুরু করে শরীর। সোনার কাছাড়ের পরে কিছুদিন ও 'জনকণ্ঠে' কাজ করে। একটি স্থানীয় চ্যানেলও দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিল যুগলে। গেল বাইশ বছর ধরে আমি নিজে প্রবাসী। শিলচর গেলে যেটুকু জানা দেখা হয়। আর আন্তর্জালে সক্রিয়তার পরে যা কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখি জানি। শেষে গিয়ে ভিড়েছিল ন্যুজ লাইভে। সেই ন্যুজ লাইভই আজ তাঁর বাজে খবরটি জানালো। গেল কয়েকবছরে ও শিলচরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ফ্যাসীবাদ বিরোধী জোট ফোরাম ফর স্যোসাল হারমনিতেও সক্রিয় ছিল Arup Baisya, Biswajit Das, Nilkantha Das,দের সঙ্গে। শরীর দিচ্ছিল না বলে বেশি বেরুতে পারত না। কিন্তু মনে তো এক বৈষম্যবিহীন, অসাম্প্রদায়ীক, গণতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন দেখতই। লকডাউন পর্বে আমরা যখন ঘরে বসে আছি---ওর এই শরীর নিয়ে পেশার দায়ে বেরুতে হচ্ছে কি না, জানতে ভিডিও কল করেছিলাম। দুপুর বেলা। খালি গায়ে ভাত খাচ্ছিল। স্বভাবসুলভ হাসি নিয়ে কথা বলল। শান্ত্রশ্রী দেখালো কী কী রান্না করেছে। দেখে বললাম, তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে সুখেই আছিস। আমাদের ভাবনার কিছু নেই। কী সুখ ! -- আর দিনকতক পরে যে দেখিয়ে দেবে কে জানত? শান্ত্রশ্রীকে কী বা বলি? এক মাত্র কন্যা শিঞ্জিনী---মা -বাবার মতোই সপ্রতিভ আর মেধাবী। ওর তো জীবন পড়ে আছে। এই বয়সে এতো চাপ নিতে পারবে কি মেয়েটি? আমরা সঙ্গে আছি। কিন্তু নিশ্চিত মায়ে মেয়েতে লড়ে যাবে। গতকাল লিখেছিলাম, পীযুষ আজীবন fighter. কালও ভাবিনি, কথাটা কেন লিখেছিলাম, আজই তার এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। আমি জুটির ছবি দিলাম, জানিনা সংস্কাতে মানা আছে কি না। সে এমনিতেও আমাদের স্মৃতিতে থাকবে অমলীন। তার উপরে শান্তশ্রী আছে মানে তো পীযুষ আছেই। আমি নিশ্চিত শান্তশ্রী আর শিঞ্জিনীর মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে পীযুষ, পিষুষের স্বপ্ন। আমরা সঙ্গে আছি, সেই স্বপ্নের সহযাত্রী।
কোন মন্তব্য নেই