Header Ads

করোনা লকডাউনের প্রেক্ষাপটে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাস্মরণ


নয়া ঠাহর, নিজস্ব প্রতিবেদন, গুয়াহাটি

আজ ২৫শে বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্ম জয়ন্তীদেশ জুড়ে লকডাউন না কোনো স্কুল-কলেজে, না কোনো পার্কে সভা সমিতি বা কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও সম্ভব নয় এবার ঘরে বসে সারতে হচ্ছে কবি প্রণামকরোনার কাঁটায় ঘরবন্দি দেশবাসী
রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার পালিত হয়েছিল ১৯১২ সালেসে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১ তে পা দিয়েছেন কবি  রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে  শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের  সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণীজন  তাঁদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
বেদ-উপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিলকবির মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেলেও, তা প্রকাশ পেয়েছিল নেপালচন্দ্র রায়ের ভাষণেনেপালচন্দ্র বলেছিলেন,  “তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাঁকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও নাসত্যি কবি ঈশ্বর হতে চাননি, তিনি তাই লিখেছিলেন
যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে
১৯৩১ সাল, মহা সমারোহে উদযাপিত হয়েছিল কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তীযা আজও বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেরবীন্দ্রজয়ন্তীর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোমউদযাপন কমিটিতে ছিল চাঁদের হাট
কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুকমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, সি.ভি.রমণ, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়প্রমুখ প্রাতঃনমস্য ব্যক্তিরা
কবির সম্বর্ধনা উপলক্ষে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, বাংলা আর ইংরেজিতেইংরেজি বইটির নামকরণ করেন রঁমা রঁলাতিনি নাম দেন, Golden Book of Tagoreবইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ  আইনস্টাইন, ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকি মত বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিরা
আজকের জীবনের শত নৈরাশ্যের যাপিত জীবনে একখন্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে কবি আমাদের বুকে সাহস জোগায়রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল প্রত্যয়, তাকে বোঝা আর বোঝানো আমার মতো অতি নগণ্য মানুষের জন্য অসাধ্যরবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে তার লেখাকে পরিচিত করে তুলতে হবে সকলের কাছেকারণ, তার লেখার বৈচিত্র্য আর প্রাচূর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক বাঙালির মননে সৃজনে জ্যোর্তিময় এক প্রতীক বাঙালির প্রাণের মানুষ তিনিকবিগুরু প্রায় একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতায় উজ্জ্বল করে তুলে বিশ্বসাহিত্য আসরে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বাংলা বাঙালিকে অনন্য এক মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন প্রবল অনুরাগ অকুন্ঠ শ্রদ্ধার আসনে প্রতিটি বাঙালির প্রাণে তার অধিষ্ঠানসুখে সংগ্রামে, বেদনা উচ্ছাসে, প্রেম প্রকৃতিতে তার ছিল অবাধ বিচরণ
তিনি চির নতুনের কবি, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কবিজন্মদিন মানে নতুনের আহবানএটাই ভাবতেন আমাদের বিশ্বসেরা কবি রবীন্দ্রনাথতাই নিজের জন্মদিনে নিজেই আরো লিখে গেছেন ' উদয় দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে মোর চিত্ত-মাঝে, চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ'
তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মহর্ষি বলে ডাকতেনসেই সনাতন সময়েই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র ছিলচার বছর বয়সের সময় থেকে রবির বিদ্যা শিক্ষা শুরু হয়, শৈশবেই উত্সরিত হয় তার মেধা বুদ্ধির শিখাছোটবেলা থেকেই তার কবিতা পরতে খুব ভাল লাগতো 'জল পড়ে পাতা নড়ে' কথাটি লিখেই তার কবিতা লেখার উত্সাহ যোগায়
তিনি বাংলা ভাষায় বহু কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করে থাকেনআট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন১৮৭৪ সালে তত্ত¡বোধিনী পত্রিকাতে তাঁর 'অভিলাষ' কবিতাটি প্রকাশিত হয়এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা
রবীন্দ্রনাথ মূলত কবিপ্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীত স্রষ্টা হিসেবেরবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন কবিতা গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেনরবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছেএছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছেতাঁর প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী 'রবীন্দ্রনৃত্য' নামে পরিচিত
বিশ্বের আর কেউই তার মতো এভাবে আত্ম উপলবিদ্ধ করতে পারেননিতিনি শুধু নিজেকেই নয় প্রত্যেক বাঙালির আত্মউন্মোচন করেছিলেন নিজেরে গান-কবিতা আর গদ্যের মধ্য দিয়েমানবজীবনের অনুভূতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিবাঙালির চেতনায়, মেধা মননে রবীন্দ্রনাথ সর্বব্যাপীএকজন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, গীতিকার নাট্যকার হিসেবে বিশ্বখ্যাত এই মহামানবের আজ জন্মদিনআজ বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন
কবি হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাত হলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীতিনি ছিলেন একাধারে একজন সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারকপৃথিবীর সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তনকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেনতিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন ৫৬টি কাব্যগ্রন্থ, ১১৯টি ছোটগল্প, ১২টি উপন্যাস, ২৯টি নাটক, ৯টি ভ্রমণ কাহিনী, ২২৩২টি গান দেশ-বিদেশে দেয়া নানা বক্তৃতার মাধ্যমে
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা প্রগতিচেতনারবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিকভারতের ধ্রুপদি লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলকথাসাহিত্য প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেনসমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেনএর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেনরবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছেরবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেনসঙ্গীত নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন
কবিগুরুর সাহিত্যকর্মে মহাকবি কালীদাস, লালন, গগণ হরকরা, হাফিজ, বিদ্যাপতি, উইলিয়াম শেক্সপিয়র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব নজরে পড়েকবিগুরুর সাহিত্যের প্রভাব পড়ে কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দত্তাত্রেয় রামচন্দ্র বেন্দ্রে, আন্দ্রে জিদ, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, কুভেম্পু, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, পাবলো নেরুদা অক্টাভিও পাজের মতো বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনায় 
পঁচিশে বৈশাখ ১৯৪১(৮ই মে) কবির জীবদ্দশার শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তীঅত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে শান্তিনিকেতনে পালিত হয় বিশ্বকবির জীবনের শেষ শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তীশান্তিনিকেতনের উদয়নেবসে জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষে কবি  লিখেছিলেন কয়েকটি লাইন, যা ছিল দার্শনিক কবির জীবনচর্যার নির্যাস,
আমার জন্মদিন মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ
আজকের জীবনের শত নৈরাশ্যের যাপিত জীবনে একখন্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে কবি আমাদের বুকে সাহস জোগায়রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল প্রত্যয়, তাকে বোঝা আর বোঝানো আমার মতো অতি নগণ্য মানুষের জন্য অসাধ্যরবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে তার লেখাকে পরিচিত করে তুলতে হবে সকলের কাছেকারণ, তার লেখার বৈচিত্র্য আর প্রাচূর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.