পরিযায়ী শ্রমিক-সমস্যাকে গুরুত্ব না দেওয়ার মারাত্মক ফল ভুগতে হচ্ছে দেশকে !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
ফের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে লিখতে হচ্ছে আমাকে। না, রাষ্ট্রসঙ্ঘ আমাকে এ দায়িত্ব দেয় নি, দেয় নি এ দেশের সরকারও। তবু লিখতে
হচ্ছে--কেন না, শ্রমিকদের নিয়ে যে ভাবে কেন্দ্রকে রেফারি
বানিয়ে রাজ্যগুলি পিংপং খেলছে তাতে আর চুপ করে থাকা যাচ্ছে না। তবে কিছু বলার আগে ‘পরিযায়ী’ শব্দটিকে নিয়ে দু-একটা কথা বলে নেওয়া
দরকার। রাজশেখর বসু’র ‘চলন্তিকা’ এবং ‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে ‘পরিযায়ী’ শব্দটি নেই--কিন্তু ‘প্রবাসী’ শব্দার্থ ব্যাখ্যা করা আছে। ‘প্রবাসী’ বলতে এই দুই বাংলা শব্দবিশেষজ্ঞ বলেছেন--‘প্রবাসী’ বলতে বোঝায় যারা বিদেশবাসী--অর্থাৎ
বিদেশেই বসবাস করেন--নিজভূমে ফিরতে পারেন--নাও পারেন। নিয়মিত যাতায়াত করতে হয় না
বিদেশবাসীদের। কিন্তু আমরা যাদের সাধারণতঃ ‘পরিযায়ী’ বলি তারা নিয়মিত নিজভূমি থেকে একেক বার একেক রাজ্যে রোজগারের তাগিতে যাতায়াত
করেন--শ্রমিকদের সিংহভাগই চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করতে যান--চুক্তি শেষ হলে তাদের
ফিরতে হয়--পরে প্রয়োজন হলে তারা আবার সেখানে যান বা অন্য কোন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ
পেলে সেখানে চলে যান। যেমন বহু দূরদূরান্ত থেকে খাদ্যের খোঁজে পাখিরা এক দেশ থেকে
আরেক দেশে চলে যায় এবং সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে ফের নিজের নিজের মূল বাসস্থানে ফিরে
যায়। আমাদের দেশের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষ অন্যরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যান বটে
কিন্তু তাদের কাজের নিশ্চয়তা, পিএফ, বোনাস, প্রমোশন ইত্যাদি শ্রম-আইন সম্মত কোন দায়
দায়িত্ব কোনো রাজ্য সরকারই পালন করে না--কারণ, এইসব অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা দালালদের মাধ্যমে শ্রমিকের কাজে
নিযুক্ত হন এবং এদের নিয়োগ কর্তার সিংহভাগই কনট্রাক্টর বা ছোট-বড় নির্মাণ সংস্থা।
এদের কোন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশদ তথ্যাদি রাজ্য সরকারগুলোর কাছে থাকে না। যেখানে দায়
দায়িত্বের কোনো প্রশ্ন নেই সেখানে বিশদ তথ্য সংগ্রহের প্রশ্ন থাকারও কথা নয়। তাই
যারা আবেগতাড়িত হয়ে কিংবা মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বিবেচনায়--‘সব শ্রমিক-ই তো এক’ বলে চিৎকার করেন তারাও মনে মনে ভালভাবেই
জানেন যে ভারতীয় শ্রম-আইন বহির্ভূত এইসব শ্রমিক আর কোম্পানি আইনের আওতায় থাকা
শ্রমিক এক নয়। এইসব শ্রমিক নিজভূমে সংসার প্রতিপালনের মতো ন্যূনতম কোনো কাজকর্ম না
পেয়েই মারাত্মক রকমের অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয় দু’মুঠো অন্নের সংস্থান যাতে হয় তার জন্যে। এদিক থেকে দেখতে গেলে এইসব ‘পরিযায়ী শ্রমিকদের’ ভালোমন্দের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাদের নিজের
নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ রাজ্য সরকারগুলোরই। কারণ, এরা ভোটের সময় যে রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করছে সেই রাজ্য সরকার গঠনে ভোট দেয় না।
নিজের রাজ্যে সরকার গঠনে ভোট দেয়। এ রাজ্যের রেশনকার্ড দিয়ে তারা ভিন রাজ্যে রেশন
পায় না। তাদের আধার কার্ড-রেশন কার্ড--এ সবই নিজের নিজের রাজ্যের পরিচয় বহন করে।
মুখে রক্ত তুলে দু’চার টাকা রোজগার করে যেসব রাজ্যে গিয়ে
সেইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়িত্ব নিজের রাজ্য নেবে না কেন--এটা বড় বড় মোলায়েম ভাষণ
দিয়ে তাদের বোঝানো যাবে? তারা তো প্রবাসী নয়--পরিযায়ী
শ্রমিক--তাদের তো এই মহা সঙ্কটকালে ঘরে ফিরতেই হবে--নিজের রাজ্য যদি হাতগুটিয়ে বসে
থাকে তাহলে ভিন রাজ্য তাদের দায় ঘাড়ে তুলে নেবে কেন? এ রাজ্যে কয়েক’শো কোটি টাকা আমোদ-প্রমোদের জন্য ক্লাবকে
দেওয়া হয়, কিন্তু এইসব শ্রমিকদের জন্যে এই রাজ্যেই
কর্মসংস্থানের জন্যে ন্যূনতম ব্যবস্থা করার টাকা জোটে না ! ফলে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত
বিপর্য্যয়ের ঢেউ যখন এদেশেও আছড়ে পড়ল তখন সবচেয়ে বিপদে পড়ল এই ‘পরিযায়ী শ্রমিক’রাই। করোনা সংক্রমণের সূচনাতেই লকডাউন যখন
অনিবার্য্য হয়েই উঠলো তখন হাতে দিন সাতেক সময় নিয়ে এদের নিজের নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে
দেওয়া বা ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ যেমন কেন্দ্র সরকার অবশ্যই দিতে পারতো। কিন্তু শুধু
কেন্দ্র বা রেলমন্ত্রক নয়--সমানভাবে রাজ্যগুলোরও সবদিক ভেবে বিচার বিবেচনা করে
নিজের নিজের রাজ্যের শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থাকে অগ্রধিকার দেওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু কোনো রাজ্য প্রাথমিক পর্বে সেটা করেই নি ! লকডাউন ঘোষণার দিনেই
প্রধানমন্ত্রী রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার
ব্যবস্থা করতে--এর জন্যে রাজ্যগুলিকে ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও করা
হয়েছিল--সাংবাদিক বৈঠকে এমনটাই দাবি করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী--এবং কোনো
রাজ্য সরকার এমন দাবি করেন নি যে, অর্থমন্ত্রী মিথ্যে কথা বলছেন ! অর্থাৎ খুব স্পষ্টভাবেই দেখা গেল কেরল-উড়িষ্যা-সিকিমের মতো দু’চারটে রাজ্য ছাড়া করোনা ভাইরাসকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবে নি
অধিকাংশ রাজ্যই। ফলে মারাত্মক বিপদে পড়ল মহারাষ্ট্র-গুজরাট-পাঞ্জাব-রাজস্থান সহ
অধিকাংশ রাজ্য। পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না করার ফলে তাদের মধ্যে
যে কোনো উপায়ে ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টা শুরু হয়ে গেল। আমফানের আগেই বাংলার পরিযায়ী
শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে রেল মন্ত্রকের সঙ্গে যে ধরণের টানাপোড়েন চলল
এবং ট্রেনের রিক্যুইজেশন নিয়ে যে ধরণের নাটক শুরু হল তাতে এটা স্পষ্ট বোঝা
যাচ্ছিল--রাজ্য সরকার কোনোভাবেই লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার
অবস্থায় নেই। তাদের ফেরালে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো বা বিপুল
পরিমাণের করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করানোর মতো পরিকাঠামোর অভাবে যে বিপজ্জনক
পরিস্থিতি তৈরি হবে--এটা সরকার অনুভব করছে প্রতিমুহূর্তে। যদিও শেষপর্যন্ত সেই
বিপদ আর কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যে
ফিরছেন--ছড়িয়ে পড়ছেন জেলায় জেলায়--এদের সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা রাজ্য
সরকারেরও স্পষ্ট জানা নেই ! ফলে এখন প্রবল তরজায় নামতে হয়েছে রাজ্য সরকার ও
কেন্দ্র সরকারকে। একে অপরের দিকে কামানের মুখ ঘুরিয়ে তোপ দাগার মধ্য দিয়ে প্রমাণ
করার চেষ্টা করছে কে কতটা নির্দোষ ! কিন্তু মানুষ কি কিছুই দেখছে না? কিছুই বুঝছে না? মানুষ সবই বুঝতে পারছে--সব কিছু নিজেদের
চোখ দিয়েই দেখতে পাচ্ছে। মানুষের বোধবুদ্ধির ক্ষমতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অভ্যাস
কর্তাব্যক্তিদের কতদিন কতটা নিশ্চিন্ত রাখতে পারে এখন সেটাই দেখার। মর্মান্তিক
অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। রাস্তাঘাটে-ট্রাক দুর্ঘটনায় তো
বটেই--এমন কী খাবার ও খাবার জলের অভাবে ট্রেনের মধ্যেও প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে !
প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা মৃত মায়ের আঁচল টেনে মাকে জাগানোর চেষ্টা করছে একরত্তি
শিশু--এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হচ্ছে ! এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা--চূড়ান্ত অমানবিকতার
দায় শুধু কেন্দ্রের--রাজ্যগুলোর নয়? কেন্দ্র টাকা দিতে পারে ট্রেন দিতে পারে
রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দিতে পারে, রাজ্য প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, রাজ্য না চাইলে সেনা নামাতেও পারে না--কিন্তু রাজ্যের মানুষগুলোকে বাঁচানোর
দায় বা দায়িত্ব তো রাজ্য প্রশাসনেরই--তারা যদি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতো তাহলে
পথেঘাটে ট্রেনে ট্রাকে এভাবে শ্রমিকদের মৃত্যু হতো? এত বিপুল সংখ্যায় সংক্রমিত হয়ে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’রা গোটা দেশে সংক্রমণের হার হু-হু করে বাড়িয়ে দিতে পারতো? এখন আর কারুর হাতেই কিছু নেই। জুনের
মাঝামাঝি গিয়ে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেতে হবে দেশবাসীকে। তখনও কেন্দ্র-রাজ্য
নির্লজ্জ তরজায় মেতে থাকবে। সংক্রমণের সংখ্যা যেখানে গিয়ে পৌঁছুবে সেখানে যথাযথ
চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রাখার ক্ষমতা বিশেষ করে এই রাজ্যের একেবারেই থাকবে না। সঠিক
পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হাতের বাইরে চলে গেছে। রাজ্যবাসীকে এখন ঈশ্বরের করুণা নির্ভর
থেকে প্রহর গুণতে হবে। কিন্তু সত্যি সত্যি এমনটা হওয়ার কথা ছিল না--সরকারি
অপদার্থতা-ব্যর্থতা এবং ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র সম্পূর্ণ অমানবিক নাট্য-রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে রাজ্যবাসীকে--চরম
দুর্ভাগ্য ছাড়া একে আর কি বলা যেতে পারে !!
কোন মন্তব্য নেই