চৈত্র সংক্রান্তির আদি ইতিহাস !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
প্রকৃতির নিয়মে বাংলার ঋতুচক্রের পালাবদলে আসে গ্রীস্ম উষ্ণতা নিয়ে। প্রখর তপন তাপে আকাশ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে । মানব মনও তৃষিত হয় প্রকৃতিকে বরণ করতে, স্মরণ করতে। এরই মাঝে বেজে ওঠে চৈত্রের বিদায় ও বৈশাখের আগমনী সুর।
বাংলা বছরের সমাপনীমাস চৈত্র। চৈত্র’ র শেষ দিনটিকে চৈত্র-সংক্রান্ত্রি বলা হয়। আমাদের লোকাচার অনুযায়ী এদিনে বর্ষ বিদায় উৎসব পালন করা হয়ে থাকে, যা বাঙ্গালী জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। চৈত্র-সংক্রান্তির সুর্যাস্তের মধ্যে দিয়ে কালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে যাবে একটি বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশের মানুষ সহ-অবস্থানে বসবাস করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে তাই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজবদ্ধ আচার অনুষ্ঠান একই সঙ্গে পালন করে থাকে।
বাঙ্গালী এই দিনটিতে বেশকিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যেমন--গাজন, নীল পুজা বা চড়ক পুজো, চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা ও শেষ প্রস্তুতি চলে হালখাতার। ঠিক একই সময় আদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে বর্ষবিদায় , বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবি। যে চৈত্র-সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীর এত আয়োজন এবার আমরা দেখব সেই চৈত্রের আদি ইতিহাস।
বাংলা সনের শেষ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে। আদি গ্রন্থ পুরাণে বর্ণিত আছে সাতাশটি নক্ষত্র যা রাজা প্রজাপতি দক্ষের সুন্দরীকন্যার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। প্রবাদতুল্য সুন্দরী এই কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তায় উৎকণ্ঠিত রাজা দক্ষ। উপযুক্ত পাত্র কোথায়? যোগ্যপাত্র খুজে পাওয়া কি সহজ বিষয়? যোগ্যপাত্র পাওয়া না গেলে কি অনূঢ়া থেকে যাবে তারা? না, বিধির বিধানে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল ।
একদিন মহাধুমধামে চন্দ্রদেবের সাথে বিয়ে হলো দক্ষের সাতাশজন কন্যার। দক্ষের এককন্যা চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্র এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। রাজা দক্ষের আরেক অনন্য সুন্দরী কন্যা বিশখার নামানুসারে ‘বিশাখা’ নক্ষত্র এবং ‘বিশাখা’ নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ মাসের নামকরণ করা হয়।
প্রসঙ্গত: বলে রাখি--মাস হিসাবে বৈশাখের প্রথম হবার মর্যাদা খুব বেশী দিনের নয়। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেখানেও বৈশাখের সন্ধান মেলে। বৈদিক যুগের সে তথ্যানুযায়ী বৈশাখের স্থান ছিল দ্বিতীয়। তৈত্তিরীয় ও পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের মতে বৈশাখের অবস্থান ছিল বছরের মাঝামাঝি জায়গায়। অন্যদিকে ব্রহ্মান্ড পুরাণে অনুষঙ্গপাদের একটি শ্লোক অনুসারে মাসচক্রে বৈশাখের অবস্থান ছিল চতুর্থ। তখন বাংলা সন বলতে কিছু ছিলনা। ছিল ভারতীয় সৌরসন গণনা পদ্ধতি।
মোঘল সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার মৌসুম অনুসারে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে নতুন একটি সনের প্রবর্তনের জন্যে অনুরোধ করেন বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পন্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ্ সিরাজীকে। সিরাজী হিজরী চন্দ্রমাসের সঙ্গে সম্রাটের সিংহাসনের আরোহনের বছর এবং ভারতীয় সৌরসনের সমন্বয়ে বাংলাসনের প্রবর্তন করেন। মাসের নামগুলো সৌরমতে রেখেই পূণর্বিন্যাস করেন তিনি। সে অনুযায়ী বৈশাখ বাংলা সনের প্রথমে চলে আসে।
ফিরে আসি আমাদের মূল বিষয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ গাজন। গাজন একটি লোকউৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবের সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতাদের নাম। যেমন- শিবের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি।
এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিবাহ দেওয়া। গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচন্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমণ ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়।
চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এই উপলক্ষ্যে একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।
এ সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। এই মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরণের খেলা এখন একেবারেই কমে গেছে।
চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরী বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল-ফলাদি ও মিষ্টি কেনা-বেচা হয়। বায়োস্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে। অঞ্চলভেদে এই মেলা তিন থেকে চারদিন চলে। বাঙালী যে দিন চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব পালন করে থাকে সেদিন অদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে থাকে তাদের বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অণুষ্ঠান--বৈসাবি ।
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি আসলে কী ? পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান উপজাতিদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি সাধারণত পুরাতনবর্ষকে বিদায় এবং নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাতে যথাক্রমে--বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু উৎসব পালন করে থাকে।
ত্রিপুরাদের বৈসুক শব্দ থেকে ‘বি’, মারমাদের সাংগ্রাই থেকে ‘সা’ এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিঝু ও বিষু শব্দদ্বয় থেকে ‘বি’ আদাক্ষরগুলির সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসবের নামকরণ করা হয়েছে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসুক। বাংলা বছরের শেষ তিনদিন পার্বত্যবাসী অতি আনন্দের সাথে এই উৎসব পালন করে থাকে।
অন্য সম্প্রদায় তথা সকল ধর্মের লোক এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে। সামর্থানুযায়ী ঘরের ছেলে-মেয়েদের নতুন পোষাক দেওয়া হয়, খাবার হিসাবে বিভিন্ন রকমের পিঠা ও পাঁচন তৈরী করা হয়ে থাকে। বৈসুক উৎসবের প্রধান আপ্যয়নের বস্তু হলো পাঁচন। পাঁচন সাধারণত বন-জঙ্গলের হরেক রকমের শাক-সবজির মিশ্রণ। তাঁরা মনে করে বৎসরের শেষ ঋতু পরিবর্তনের সময় বিভিন্ন শাক-সবজি দিয়ে রান্না পাঁচন খেলে পরবর্তী বছরের রোগ-বালাই থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বছরের শেষ দিনের আগের / পূর্বের দিনকে হারি বৈসুক, শেষদিনকে বলে বৈসুকমা আর নতুন বৎসরকে বলে আতাদাকি।
হারি বৈসুক দিনে প্রথমে তারা ফুল সংগ্রহ করে বাড়ী-ঘর, মন্দির সাজায়, তারপর তারা গায়ে কুচাই জল (পবিত্র জল) ছিটিয়ে স্নান করে আসে, সাথে বয়োঃজ্যেষ্ঠদের জল তুলে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। পরবর্তীদিনে পাড়ার যুবক ছেলেরা একজন ওঝার নেতৃত্বে দলবেঁধে গরয়া নৃত্যের মহড়া দেয়। এই গরয়া দেবতার পুজো দিয়ে আশীর্বাদ বক্ষবন্ধনী কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখে। তাদের বিশ্বাস কারায়া গরয়া হচ্ছে বনের হিংস্র পশুদের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা। তাদের পুজোর আশীর্বাদ গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে জুমচাষ ও বিভিন্ন কাজে বনে জঙ্গলে গেলে হিংস্র পশুদের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া যাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা এবং কক্সবাজারের রাখাইনদের অন্যতম প্রধান উৎসব সাংগ্রাই, মারমা বর্ষের শেষ মাস তেংখুং নববর্ষের প্রথম মাস কোসুং মাসের প্রথমে এবং বিদায়ী মাসের শেষদিনে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। ত্রিপুরাদের মত তারাও নতুন জামা-কাপড় কেনাকাটা করে থাকে এবং বিভিন্ন ধরণের পিঠা, বিনিভাত, পায়েস রেঁধে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়ীতে পাঠায়।
সাংগ্রাই-এর মূল আকর্ষণ তরুণ-তরুণীদের জলোৎসব। জলোৎসবের জন্য আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরী করে জল মজুত রাখা হয়। মজুত রাখা জলের দুইদিকে অবস্থান নেয় তরুণ-তরুণীরা। চারিদিকে সংগীতের মূছর্না চলতে থাকে। তরুণেরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে এসে একজন তরুণীর গায়ে ছিটিয়ে দেয়, এর প্রতিউত্তরে তরুণীও ঐ তরুণটির গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে জলোৎসব। মারমা সম্প্রদায়ের ধারণা পুরাতন বৎসরের শতদুঃখ গ্লানি, ব্যর্থতা সবকিছু ধুয়ে-মুছে যায় এই জল ছিটানোর মধ্যে দিয়ে। এভাবেই তারা শেষ করে সাংগ্রাই উৎসব। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ উৎসব ‘বিঝু’ বা ‘বিষু’। তিন দিন ধরে এই উৎসব পালন করে থাকে।
বাংলা বর্ষের শেষদিনকে ‘মুল বিঝু’, তার আগের দিনকে ‘ফুলবিঝু’ এবং নববর্ষের প্রথমদিনকে নুয়াবিঝুর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা দিন বলে। ফুলবিঝুর দিনে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা নদীতে গিয়ে কলাপাতায় ফুল ভাসিয়ে দেয়, অনেকে ফুলদিয়ে ঘর সাজায়, নাধেং (ঘিলা, বিবিধ খেলা), নাধেংখারা (লাটিম জাতীয় খেলা) হাডুডু ইত্যাদি খেলার আয়োজন করে থাকে। সর্বত্র ফুলের এই ব্যবহারের কারণে হয়ত বা এই দিনের নাম করন করা হয়েছে ফুলবিঝু। অনেকে আবার চারণ কবি দিয়ে পালাগান পরিবেশন করে থাকে।
সময়ের বিবর্তনে এসব পুরানো ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। মুলবিঝু দিনেই চাকমাদের প্রকৃত বিঝু। এদিনে অতিথিদের জন্য দরজা উন্মুক্ত থাকে। কাউকে নিমন্ত্রণ করবার প্রয়োজন হয় না। কলাপিঠা, সান্যাপিঠা, বিনিপিঠা, নানা ধরণের মিষ্টি ও পানীয় দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে।
এ সময় অনেক সদ্য বিবাহিত দম্পতি প্রথমবারের মত শ্বশুরবাড়ীতে (বিষুত ভাঙ্গা) বেড়াতে যায়। মুলবিঝুর দিনে সব বাড়ীতে টক, মিষ্টি, পাঁচন রান্না করা হয়। তাদের বিশ্বাস বছর শেষের দিন তিতা, মিঠা খেয়ে বছর বিদায় দেওয়া ভালো। এতে বিগত বছরের দুঃখ কষ্ট, আনন্দ বেদনা দূর হয়ে যাবে।
নুয়াবিঝুর বা গোর্জ্যপোর্জ্যা (বছরের প্রথম দিন) দিন প্রার্থনালয়ে গিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করে এবং আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বন্ধবদের নিমন্ত্রণ করে ভাত খাওয়ায় ও বয়ঃজোষ্ঠ্যদের মদ ও অন্যান্য পানীয় আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে তারা নববর্ষ পালন করে। বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান বাঙ্গালী কিংবা আদিবাসী যেই হোক না কেন সবার কাছে একটি হৃদয়স্পর্শী আয়োজনে পরিণত হয়েছে, পরিণত হয়েছে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।
কোন মন্তব্য নেই