করোনা, কোয়ারেন্টাইন, লোকডাউন উদ্ধত মানব জাতিকে কৃতজ্ঞতার পাঠ শেখাচ্ছে; মনে করিয়ে দিচ্ছে জগন্নাথ, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কথাও
অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি
যাকে মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করেনি, যার জন্মদিনে একটি প্রদীপও জ্বলে না, তিনি হঠাৎই সারা বিশ্বজুড়ে জ্বলে উঠলেন। তিনি আর কেউ নন, বাঙালিদের ভুলে যাওয়া আর্চার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। যার গবেষণাগার থেকে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন ট্যাবলেট তৈরি শুরু হয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ট্যাবলেটটি প্রাথমিক কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিদিন ভারতের কাশ্মীর, পঞ্জাব সীমান্তে হামলা
করা পাকিস্তান থেকে শুরু করে
মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা পর্যন্ত ওই ট্যাবলেটের জন্য ভারতের কাছে হাত
পেতেছে। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার
বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানিটি যেখানে ট্যাবলেটটি প্রস্তুত হয়, সেখানে প্রাণ সঞ্চার হয়, তাদের কাঁচা মাল দার্জিলিংয়ের মংপুর সিঙ্কনা গাছের বাগান শুকিয়ে গিয়েছিল, তা ঢেলে সাজানোর ব্যাবস্থা করা হয়। করোনা সংক্রমণের চরিত্র বার
বার বদল হওয়ায় এই সংক্রমণে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন আর কাজ দিচ্ছে
না বলে আমেরিকা
সহ বিভিন্ন দেশ অভিযোগ করেছে। তাই রবীন্দ্র নাথের প্রিয় স্থান মংপুর সিঙ্কনা বাগান আবার শুকিয়ে যাবে। বিগত চার মাস ধরে
পৃথিবীর অসুখ ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ২০০টির বেশি দেশের ২০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় আড়াই লক্ষ মারা
গেছেন। আমেরিকার মত মহাপ্রতাপি দেশের নাকানি চোবানি অবস্থা সেখানে প্রায় ৬০ হাজার মারা গেছেন। যেখানে ২০ হাজারের বেশি করোনা পজিটিভ জর্জিয়ার মতো। প্রোভিন্সে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। ১২টি প্রোভিন্সে লকডাউন তুলে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে বলে খবর আসছে। নিউইয়র্কে মৃতদেহের লাইন। মর্গগুলোতে মৃতদেহ উপচে পড়ছে। সংক্রমণের ভয়ে কেউ মৃতদেহ নিতে আসছেনা। এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের ঘর সামলাতে
না পেরে সকাল-সন্ধ্যা
চীনকে গালি-গালাজ করছেন। মৃত্যুর মিছিলে দ্বিতীয় স্থানে আছে ইতালি। ২৬ হাজার ছাড়ালেও ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তারপরই ফ্রান্সে ২২ হাজার, স্পেন ২৩ হাজার, ব্রিটেন ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। ভারতকে গাল দেওয়া দেশ পাকিস্তানে প্রায় ৪০০, বন্ধুদেশ বাংলাদেশে প্রায় ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভুটান, গ্রিনলান্ড, নেপাল, জিম্বাবোয়েতে একটিও মৃত্যুর ঘটনা নেই।
ভারতের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো, ৩২ হাজার আক্রান্ত, ৯৩৫ জন মারা গেছে। অসমে ৩৭ আক্রান্ত এবং ১ জন মারা গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসের
ফলে মৃতদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ আজ সাংবাদিক
সম্মেলনে গুরুতর অভিযোগ করে বলেন, মৃতদেহ লুকোনো হচ্ছে। ব্যাপকহারে রেশনের চাল লুট চলেছে। বিজেপি নেতাদের জোর
করে কয়রেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের এক তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের করোনা বলে রিপোর্ট দেওয়া যাবে না।
ভারতের কোনো রাজ্যে মৃতদেহ লুকোনোর অভিযোগ নেই। দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রের অবস্থা সব থেকে খারাপ, দেশের বলিউড তারকাদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, দেশের শিল্পপতিদের কোটি কোটি টাকার পুঁজির পাশে মুম্বাই নগরের সংলগ্ন এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাভি বস্তি, ৫ কিলোমিটার জুড়ে বস্তিতে শুধু অনাহার, অপুষ্টি, রোগ যন্ত্রণার ছেঁড়া কাঁথার কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বলিউডের গ্ল্যামার আর বড় বড় পুঁজিপতিদের বিলাস বৈভবের
পাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার ধারাভি বস্তিতে।
এই বস্তিকে সাংঘাতিকভাবে করোনা সংক্রামিত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে শুধু ধারাভিতে। কলকাতার সংবাদপত্র যেমন করোনার
প্রকৃত ছবি চেপে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি ধারাভি সাংবাদপত্রে স্থান পাচ্ছে না। কারণ মানুষের সৃষ্টি ধারাভি
তো মুম্বাইয়ের শিল্পপতি, বলিউডের তারকাদের লজ্জা। প্রকাশ পেলে গ্ল্যামারে কালি পড়বে। ধারাভির দারিদ্রতা দেখিয়ে মদ, গাঁজা, উলঙ্গ অভুক্ত শিশুর ছবি
করে অনেক বলিউড
শিল্পী বিশ্ব সিনেমা জগতে প্রচুর সম্মান কুড়িয়েছে। আজ এই
দুর্দিনে তারা কোথায়? দেশে লক্ষ শিল্পপতির মধ্যে একজনই আছেন, রতন টাটা। হ্যা তিনিই একমাত্র শিল্পপতি দেশের দুর্দিনে ১৫০০ কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য করেছেন। এমন কি মুম্বাইয়ের বৃহত্তম বস্তি
ধারাভি যে মুম্বাইয়ের লজ্জা, বড় বড় প্রাসাদের পাশে, বিলাস বৈভবের পাশের বস্তি ধারাভি যে মানুষের কলঙ্ক, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর কর্তা। মহারাষ্ট্রে ধারাভি আর দিল্লিতে
নিজামুদ্দিন থেকে দেশে করোনা
ভাইরাস ছড়িয়েছে। নিজামুদ্দিনের প্রসঙ্গ তুললেই বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক। কেন বলা হচ্ছে? করোনা কি জাত-পাত
দেখে আক্রমণ করছে? এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত হয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৫ টি রাজ্য। গোয়াও মুক্ত, মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ এবং মনিপুর করোনা মুক্ত রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের মধ্যে সব থেকে ভালো কাজ করছে কেরালা। সেখানেই প্রথম
রোগের সূত্রপাত হয়েছিল। হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন একেবারে ফেল হয়নি। প্রাথমিকভাবে সবাই ব্যাবহার
করছে। রেডেসিভির নামে এক ঔষধ নিয়ে পরীক্ষা
নিরীক্ষা চলছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানি অলিসা গ্রানাটো নিজের শরীরে
ভ্যাকসিন নিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। সারা বিশ্বের ৮০০-র বেশি
কোম্পানি করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন আজ বলেন, নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে
রেপিড টেস্ট কিট মে মাসে তৈরির কাজ শুরু হবে। আইসিএমআর দাবি করেছে, প্লাজমা থেরাপি খুব একটা
কার্যকরী হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব লব আগরওয়াল আজ বলেছেন, দেশে ১৭টি জেলাতে গত ২৮ দিনে একটিও করোনা আক্রান্তের খবর নেই। একমাস বাদে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের স্থান যাত্রা সে সময় জগন্নাথদেবের মাথায় ঘড়া ঘড়া দুধ-জল ঢালা হয়। তাতে ঠান্ডা
লেগে যায়। জগন্নাথকে ১৪ দিন বিশ্রামে থাকতে হয়। জরিবুটি, ঔষধপত্র দিয়ে জ্বর ছড়ানো হয়, পুরীর এ এক হাজার বছরের ধর্মীয় পরম্পরা। সেই সময় ১৪ দিন আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ১৪ দিন হোম কয়রেন্টিনে থাকছে। শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার পরম্পরা কি আজও অব্যাহত? ইউরোপে প্লেগ মহামারী হিসাবে দেখা দেওয়ার পর
যারা জাহাজ বন্দরে নামতো তাদের ৪০ দিন কয়রেন্টিনে পৃথকভাবে রাখা হতো। ইতালিয়ান শব্দ Quarantine আজ আমাদের ঘরের ভাষাতে পরিণত হয়েছে। করোনা ভাইরাস সেই মারণ রোগের নাম কি আগে কোনোদিন শুনেছি? আর লকডাউন সেও তো নতুন শব্দ, দি এপিডমিক ডিজিজ আইন ১৮ ৯৭ এবং দি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন ২০০৫ মোতাবেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সারা দেশে গত ২৩ মার্চ গভীর রাত
থেকে লকডাউন আইন জারি করে কোভিড-১৯ সংক্রমণে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার বার মুখে মাস্ক পড়ে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছেন। গরিব শ্রমজীবী, পরিযায়ী শ্রমিক অশেষ কষ্টের মধ্যে আছেন। কোভিড-১৯, করোনা ভাইরাস, কয়রেন্টিন, লকডাউন আমাদের আষ্টে পৃষ্টে বেঁধেছে। শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব
স্নান যাত্রায় ১৪ দিনের কয়রেন্টিনে যাবেন। তার আগে আমরা কয়রেন্টিন থেকে মুক্ত
হতে পারবো তো?










কোন মন্তব্য নেই