Header Ads

দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে কেন জিতলেন কেজরীওয়াল !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 

৭০-টি আসনের মধ্যে ৬২-টি আসনে জয়লাভ নিঃসন্দেহে বড় মাপের এক তরফা জয়। কেজরীওয়ালের জয়ের কারণ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিদগ্ধ রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা নানা মতামত প্রকাশ করেছেন। আমি বিদগ্ধ রাজনৈতিক ভাষকার বা পণ্ডিত নই--সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়েই আমি রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করি। আমার ধারণা কেজরীওয়ালের জয়ের পেছনে উন্নয়নের রাজনীতি নেই--যা দারুণভাবে ক্লিক করে গেছে তার বিশুদ্ধ নাম হল--ডোল রাজনীতি। কেজরীওয়াল গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে মুগ্ধ করেছেন বিদ্যুৎ জল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ‘‘ফ্রী’’ করে দিয়ে। তথাকথিত এই ''উন্নয়নের'' জোরেই এই বিপুল জয় অর্জন করেছেন তিনি। পাশাপাশি তিনি হিন্দু-মুসলিম-পাকিস্তান নিয়ে যুক্তিহীন একবগ্গা প্রলয়নাচন নাচেন নি--প্রতিবাদ করেছেন--ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন--বিজেপি’র বিরুদ্ধে নিজের দৃঢ় অবস্থানকে স্পষ্ট করতে কাজকম্ম লাটে তুলে দিয়ে দিনের পর দিন ধর্নায় বসেন নি--খোল করতাল বাজিয়ে নগরসংকীর্তনে নিজের ব্যক্তিত্ব-ডিগনিটি এবং সাংবিধানিক পদ মর্যাদাকে যাত্রাপালার ‘ভবপাগলা’ টাইপের চরিত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন নি। 



রাজনীতিতে নেমেও একজন প্রাক্তন প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ছাত্র তথা একজন প্রাক্তন আইএস কর্তা হিসেবে তিনি কথায় কথায় তাঁর মাত্রাজ্ঞান হারান নি। মাত্র ৭০ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায় বিজেপি’র মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো অর্থবল ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা দিল্লীতে তাঁর ছিল না। কিন্তু তাঁকে ভোট দিয়ে জেতাতে পারে এমন অভাবী ভোটার দিল্লীতে ছিল যাদের তুষ্ট করতে পারলে তিনি জিতবেন--এই সহজ সত্যটা বুঝতে তাঁর ভুল হয় নি। সুতরাং অভাবী মানুষকে তুষ্ট করার জন্য দরকার ছিল না রাজনৈতিক তত্ত্বকথার বুকুনি--দরকার ছিল বিনামূল্যের সেইসব পরিষেবার যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বেশ খানিকটা স্বস্তি দিতে পারে। পেইড পরিষেবায় এই স্বস্তি দেওয়া কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। কেজরীওয়াল তাই ‘ডোল’ রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরলেন এবং সুকৌশলে লাগাতার প্রচার চালালেন তিনি উন্নয়নের রাজনীতিতেই মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন ও পাবেন! গরিব মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা এই ভাবনাচিন্তার স্তরে নেই যেখানে তারা বুঝতে পারবেন--পেইড পরিষেবা অর্জনের ক্ষমতাটাই প্রকৃতপক্ষে সঠিক উন্নয়ন--যা ডোল রাজনীতিকে বোঝায় না।
তারা এটাও বোঝার মতো জায়গায় থাকে না যে--এই ডোল বা বিপুল ভর্তুকির অর্থটা সরকারের কাছে আসছে কোথা থেকে। নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলের কোষাগার থেকে আসে না--জনগণের পকেট থেকেই আসে। কিন্তু ঘুর পথে। কিভাবে আসে সেটা দেশের একজন পাগলেও বোঝে। শুধূ গরিব মধ্যবিত্তরা বুঝলেও তা নিয়ে টুঁ-শব্দও তারা করতে চায় না। কিন্তু মুশকিল হল এটাই--এই ডোল রাজনীতি দিয়ে--সংরক্ষণের রাজনীতি দিয়ে কিছুকাল অভাবী মানুষকে বোঝানো গেলেও চিরকাল তাদের বোঝানো যায় না। নিজেদের ডোল-প্রাপ্তির অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে পেইড পরিষেবা অর্জনের ক্ষমতা একেবারে হারিয়ে ফেলার রাজনীতির মূল্য কিন্তু তাদেরই মেটাতে হয় শেষপর্যন্ত। তখনই প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তন আসে সমাজ জীবনে।
কয়েক মাস আগে গত লোকসভা নির্বাচনে দিল্লীতে আম আদমি পার্টি একটি বিধাসসভাতেও নিজেদের এক নম্বরে রাখতে পারে নি। ৭০-এর মধ্যে ৬৫-টি আসনে বিজেপি একনম্বরে ছিল এবং ১৩৫ বছরের পুরনো কংগ্রেস এক নম্বরে ছিল ৫-টি আসনে। মাত্র কয়েকমাস পরেই চিত্রটা আমূল বদলে গেল কি করে? এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দুটি মাত্র দলের মধ্যেই। গত নির্বাচনে ২২.৫% ভোট পাওয়া কংগ্রেস নির্বাচনের সন্ধ্যা থেকে ফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত বলে এসেছে তারা এই নির্বাচনে ‘‘স্যাক্রিফাইস’’ করেছেন! কার জন্যে স্যাক্রিফাইস করেছে সেটা ঠিক ঠাক বুঝতে হলে ভোট শেয়ারিং-এর অঙ্কটার দিকে তাকাতে হবে। লোকসভা নির্বাচনে ২২.৫% (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) ভোট পাওয়া কংগ্রেসের ভোট ১৮% কমে গেল কয়েক মাসের মধ্যেই--‘‘স্যাক্রিফাইস’’-এর এত চড়া দাম কংগ্রেসকে কেন দিতে হল? প্রবল দাপুটে কংগ্রেস নেতাদের বিচরণ ক্ষেত্র দিল্লীতেই কংগ্রেসের এই সর্বস্ব হারানো চেহারাটার পেছনে কি কোনো রাজনীতি নেই? আমার তা একেবারেই মনে হয় না। ৬৭-টি আসনে প্রার্থী দিল কেন কংগ্রেস, যদি তারা জানতোই এরকম ফল হতে চলেছে! এই ৬৭’র মধ্যে মাত্র তিনজন জামানত রক্ষা করতে পেরেছেন! বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেত্রী শীলা দীক্ষিত এই সেদিন লাগাতার পনের বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করে বিদায় নিয়েছেন। সেই দিল্লীতেই কংগ্রেসের ভোট কমে দাঁড়াবে মাত্র ৪.৩২ শতাংশে! অর্থ-বৈভব-লোকবলে অনেক এগিয়ে থাকা বিজেপি প্রার্থীরা বহু ক্ষেত্রেই স্বল্প ব্যবধানে হেরে যাবে এবং আপ ৭০-এর মধ্যে ৬৮-টি আসনে জিতে যাবে ‘‘উন্নয়ন’’-এর রাজনীতিতে? আসলে মানুষকে চৈতন ও অশিক্ষিত ভাবাটা কংগ্রেসের মজ্জাগত হয়ে উঠেছে। এ ধরণের ভাবনা অবশ্য বাম ও তৃণমূলের মধ্যেও কম কিছু নেই। কংগ্রেসের এই বিপুল ‘‘স্যাক্রিফাইস’’ না থাকলেও হয়তো কেজরীওয়াল জিততেন--কিন্তু সে জয় খুব স্বল্প ব্যবধানেই আসতো। কংগ্রেস যেহেতু স্যাক্রিফাইস করেছে সুতরাং তার লড়াই নিয়ে বেশি কথার প্রয়োজন নেই।
বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল নোটা। নোটার বিরুদ্ধে লড়েও বাম (সিপিআই, সিপিএম, ফঃব্লক) নোটার কাছেও জামানত রক্ষা করতে পারে নি! দেশের গোটা কয়েক এলিট বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাল বানিয়ে যে নক্ক্যারজনক রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা বাম-উগ্রবামপন্থীরা করে চলেছে তার ফলাফল কি হচ্ছে সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছে। বামেরা অনেক আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে--তাদের সঙ্গে সঙ্গে ১৩৫ বছরের একটা সর্বভারতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ দলও আজ প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাহলে থাকছে কে? একমাত্র বিজেপি এবং বিজেপিকে সেই সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে বিজেপি বিরোধী দলগুলিই।
কেজরীওয়ালের জয়ে যারা উদ্বাহু হয়ে কাছা খুলে নাচনকোদন শুরু করে দিয়েছে--তাদের বলুন আগামী লোকসভা নির্বাচনে কেজরীওয়ালকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তার নেতৃত্বে সবাই লড়াই করুন বিজেপি’র বিরুদ্ধে। সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন--মায়াবতী-অখিলেশ-চন্দ্রবাবু-স্ট্যালিন-কারাত-সনিয়া-তেজস্বী সহ সকলেই বেঁকে বসবেন। মমতাকেও প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে প্রোজেক্ট করে তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী লড়াইতে এরা কেউ এক কাট্টা হবেন না। যত বড় বড় বুলি-ই এরা কপচান না কেন--সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার স্বার্থে কেউ কোনরকম সমঝোতা এরা কোন মূল্যেই করবেন না। ফলে স্টেট-লসের ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও বিজেপিকে কেন্দ্র থেকে সরানো প্রায় অসম্ভব। রাজ্যের নির্বাচনে মানুষ আঞ্চলিক দলের পাশে থাকলেও সর্বভারতীয় নির্বাচনে মানুষ এইসব আঞ্চলিক দল বা তাদের নেতাদের পাশে থাকতে এখনও ভয় পায়।
বিজেপি’র স্টেট-লসের মূল কারণ হল--রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক লোকজনের বদলে আরএসএস নির্ভরতা। গোবলয় ছাড়া আর কোনো রাজ্যই রাজনীতিতে আরএসএস সদস্যদের ছড়ি ঘোরানো পছন্দ করে না। কারণ তারা বোঝে--আরএসএস তাদের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও জাতপাতের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে একটুও নড়বে না। অন্যদিকে আরএসএসের সাংগঠনিক সহায়তাও বিজেপি’র প্রয়োজন। বিজেপি তাই আরএসএসের নির্দেশেই বেপরোয়াভাবেই ধর্ম ও অর্থ--এই দুই শক্ত খুঁটির গোড়ায় কুড়ুল চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বা উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিজেপি সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করতে দ্বিধা করছে না। মানুষ সব দেখছে--মানুষ সব জানে--তবু নরেন্দ্র মোদী একবার নয় পরপর দু’বার এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন! পরবর্তীতেও হবেন--বিজেপি বিরোধী নিম্নমেধার ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্ব প্রায় অশিক্ষিত নেতা-নেত্রীদের জন্যেই। সুতরাং কেজরীওয়ালের জয় নিয়ে তুর্কীনাচনের কোনও কারণ আমি অন্ততঃ এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.