Header Ads

মোদী-মমতা সাক্ষাৎ, রাজ্যরাজনীতিতে তুমুল বিতর্ক !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

বাক্ স্বাধীনতার অধিকারে যে কেউ এ দেশটাকেই তার বাপ-চোদ্দপুরুষের জমিদারি ভাবতেই পারে। কে কোথায় যাবে আসবে সে সম্পর্কেও ফতোয়া জারি করতে পারে। কিন্তু দেশের সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আইন তা অনুমোদন করে কিনা সেটা সুস্থ মস্তিষ্কের লোকজনই ভেবে দেখেন--অসুস্থ মানসিকতায় এসব ভেবে দেখার কোন সুযোগ নেই। নরেন্দ্র মোদী সংবিধানসম্মতভাবেই জননির্বাচিত এ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি অন্য যে কোন নাগরিকের মতোই দেশের যে কোন প্রান্তে যেতে পারেন এবং যাবেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব যাদের পছন্দ নয় তারা তাঁর কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতেই পারেন--কিন্তু তাঁকে কোথাও মাটিতে পা রাখতে না দেওয়ার হুমকি কেউ দিতে পারে না--এ ধরণের হুমকি দেওয়ার অধিকার কারুর নেই। কোনও দেশেই শাসকের সর্বজনগ্রাহ্যতা থাকে না। কিন্তু সংবিধান ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রায় সকলেরই থাকে--যাদের থাকে না তারা দেশের পক্ষে ভীষণভাবেই বিপজ্জনক। 

মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-রাজ্যপাল-রাষ্ট্রপতি’র চেয়ারগুলো সাংবিধানিক চেয়ার। এইসব চেয়ারে বসার আগে সংবিধানকে সাক্ষী রেখে শপথ নিতে হয়। শপথবাক্যের প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলা বাধ্যতামূলক হয় ঐসব সাংবিধানিক চেয়ারে বসার শর্ত হিসেবে। এ দেশের সংবিধান সাধারণতঃ দল-ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থের ওপরে জায়গা পায় না অন্যান্য সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো। ফলে এ দেশের রাজনীতিতে অসভ্যতা অশ্লীলতা এবং লুচ্চামির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটতে কোন বাধার মুখোমুখি হয় না। গতকাল এক মহিলা (হয়তো ছাত্রী) একটি পোস্টার (ভাইরাল) যে ভঙ্গিতে দন্তবিকশিত করে নাচাচ্ছিলেন এবং ঐ পোস্টারে উচ্চারণ অযোগ্য যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তা বিশ্বের কোন প্রকৃত মার্ক্সবাদী দেশেও কখনো কল্পনা করা যায় না। এ দেশে অনায়াসে কল্পনা করা যায় এবং মানুষ এসব দেখতে  ও শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
নরেন্দ্র মোদী গত ছ’বছরে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন দূরে থাকুক একবারে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কর্মসংস্থানের সমস্ত সুযোগ প্রায় লোপাট হয়ে গেছে। কিছু ধর্মীয় আকাটমুর্খ ষণ্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চর্চার স্বাধীনতাটুকুও। জীবনযাপনের ব্যক্তিগত রুচি-ইচ্ছার স্বাধীনতাও এই এনডিএ সরকার কেড়ে নিচ্ছে মারাত্মকভাবে--যা ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। গরিব মানুষ আরও দ্রুত গরিব হচ্ছে--বৃহৎ পুঁজিপতিরা আরও ফুলে-ফেঁপে ঢোল হচ্ছে।মোদী জাতীয়তাবাদী বিপ্লব করতে গিয়ে একেবারেই বেসামাল হয়ে গিয়েছেন। কোন দিকটাই সামলাতে পারছেন না। ফলে মানুষকে দিশেহারা করা ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় নেই। এটা সকলেই বুঝতে পারছে এবং এটাও বুঝতে পারছে এই সরকারকে সরাতে না পারলে সমস্যার সমাধান (এর চেয়ে খুব ভাল না হলেও একটু সহনীয় এবং ভদ্রস্থ হতে পারে) সম্ভব নয়। কিন্তু খিস্তিবাজি করে চূড়ান্ত অসভ্যতার মাধ্যমে বাংলার মাথা হেঁট করে তুর্কিনাচন নাচলেই মোদীকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে জেতার কোনও সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা রাজ্যসভায় সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও মোদী কিভাবে একের পর এক বিল পাস করিয়ে নিচ্ছেন তা নিয়েও মোদীবিরোধীরা ভাবতে রাজি নন। বিরোধিতার ভূমিকায় তাদের মোটা দাগের কমেডিয়ানের ভূমিকায় বিষাক্ত ও কুৎসিত রাজনীতির ধারাবাহিকতা আড়াল করতেই তারা বিরোধিতার নামে কয়েকটি রাজ্যে যেভাবে নাচনকোদন করে চলেছে সেটাও মানুষকে বিভ্রান্ত করারই কৌশল মাত্র। সাধারণ নির্বাচনে মোদীর দলকে হারাতে হবে--এটাই একমাত্র বিকল্প রাস্তা। কিন্তু সেটা করতে গেলে বিরোধীদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে তোলা দরকার মোদী তা সুকৌশলে গত নির্বাচনের আগেও তছনছ করে দিয়েছেন। অখিলেশ-মায়াবতী কংগ্রেসকে অনুকম্পা করতে চাইছে--এমন কী নিজেরাও নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করছে। প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি নিয়ে তীব্র মতভেদ তৈরি হচ্ছে। কেউ কারুর জন্যে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি নয়। বিজেপি ছাড়া আক্ষরিক অর্থে একমাত্র সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসকেও কৌটো হাতে এলিতেলি দলের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে ! রাজীব গান্ধীর পর কংগ্রেস রাজ্যে রাজ্যে নিজেদের সাবলম্বী করে তোলার সাহসটাই হারিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। রাজ্যে রাজ্যে এককভাবে একবারও লড়ে তাদের প্রকৃত শক্তি কতটুকু টিকে আছে জানার চেষ্টা করছে না। আঞ্চলিক দলগুলোও (ব্যক্তিকেন্দ্রিক) নিজেদের দলের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কিছু ভাবতেই পারছে না। মোদী এই বিরোধিতার কথা জানেন এবং এটাও জানেন রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক বিভাজনকে কিভাবে কতটা বাড়িয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে বজায় রেখে আরও বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গে মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস মোদীর কাছে বেশ বড় মাপের চ্যালেঞ্জ--কাজেই ক্ষমতায় বসেই প্রশাসনিক দিক থেকে মমতাকে যতটা বিব্রত করা যায় নিয়মিত করে চলেছেন। মাঝে মাঝে সিবিআই-ইডি আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছেন--রাজ্যের দাপুটে সাংসদ-হাই পুলিশ অফিসিয়ালকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন--বিশেষ বিশেষ মহলে ত্রাসের সৃষ্টি করছেন। আবার সময় বুঝে ঝুপ্ করে সিবিআই-ইডির লাল আলো নিভিয়ে রাখছেন ঠিক তখনই যখনই মমতা তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে ‘‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’’করছেন, রাজ্যে ‘‘সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা’’ পালন করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করছেন এবং রাজভবনে গিয়ে একাকী দেখা করছেন! রে-রে করে উঠছে এ রাজ্যের আইসিইউতে প্রায় ভেন্টিলেশনে থাকা বাম-কংগ্রেস নেতারা। তারা আওয়াজ তুলছে--‘সেটিং হল তলে তলে, দিদি তুমি কার দলে!’ মোদী ঠিক এই চিত্রনাট্য রচনা করেই রাজ্যে এসেছিলেন। তিনিও এই রাজ্যেই বসে শুনলেন, রাজভবনে বৈঠকের জন্য বরাদ্দ ৩৫ মিনিটের মধ্যে মাত্র ১৫ মিনিট হাই-হ্যালো করে বেরিয়ে মমতা বাধ্য হয়ে বলছেন--‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি এখানে বিশেষ কিছু কর্মসূচী নিয়ে এসেছি। এসব কথা বলার জন্যে আপনি দিল্লিতে আসুন, তখন কথা হবে।’ এর পরেই টিএমসিপি’র ধর্ণামঞ্চে এসেই তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ভোকাল কর্ডের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করে তিনি নানারকম হুঙ্কার দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুটা দূরেই বামপন্থী ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ছুটে আসতে লাগল নানান ধরণের মমতা-মোদী বিরোধী মন্তব্য ও স্লোগান। ধীরে ধীরে মমতার মধ্যে হতাশার ছাপ ফুটে উঠছিল। ইতিমধ্যেই কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর বাহবায় উজ্জীবিত হয়ে ঐশী ঘোষ সাংবাদিকদের সামনে বলে দিলেন ‘মমতা-মোদী হাত মিলিয়েছেন!’ মোদী সবসময়েই এটা চান যে রাজ্যের মানুষ এ বিশ্বাস যেন না হারায় যে--মোদীর সঙ্গে দিদির তলে তলে সেটিং আছেই !
মমতার তখন ঠিক কি মনে হচ্ছিল আমি জানি না। তবে তাঁকে মোদীর সঙ্গে সেটিংয়ের অভিযোগে কাঠগড়ায় তোলার এই পুরো চিত্রনাট্যটা যে ধরতেই পারেন নি তা কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেছে। এ রাজ্যের বামপন্থীদের সম্পর্কে তাঁর বহু সিদ্ধান্তই হিতে বিপরীত হয়ে গেছে বার বার এবং তার জন্যে চড়া মাশুলও গুণতে হয়েছে তাঁকে। কলকাতায় মোদী বিরোধী তাণ্ডবের চেয়ে মমতাবিরোধী তাণ্ডবই মোদী দেখতে চেয়েছিলেন। চালে তাঁর একটুও ভুল হয় নি। কেন না মমতাও শেষপর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন গতকালের টিএমসিপি ধর্ণামঞ্চের সামনে যারা মমতাবিরোধী আওয়াজ তুলেছে স্লোগান দিয়েছে তারা বিজেপি’র দালাল ! এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই রাজনৈতিক মুন্সিয়ানার কাছে এ রাজ্যের বাম-কংগ্রেস-টিমেসি সকলকেই হার মানতে হচ্ছে।
বামেদের কাগুজে অস্তিত্ব টিকে আছে যাদবপুর, কিছুটা প্রেসিডেন্সি এবং দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাসের মধ্যে। মমতা যাদবপুরকে আজও নিতে পারলেন না--কয়েকবার সুযোগ এলেও ভিসি’র অপদার্থতায় তিনি সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন নি। যাদবপুরে বিজেপি সাংসদ যেদিন গিয়েছিলেন একটা অনুষ্ঠানের জন্য যেহেতু তিনি বিজেপি’র সাংসদ অতএব তাঁর যুক্তিহীন একমুখী তীব্র বিজেপি বিরোধিতার কারণে পাঁচ ঘন্টা ধরে বাম ও বহিরাগত উগ্র বাম ছাত্রদের তাণ্ডব চলতে দিলেন। রাজ্যপালের অনুরোধকে খারিজ করে দিলেন--বাবুল সুপ্রিয়’র হেনস্থা তৃণমূলের কাছে যতটা উপভোগ্য ছিল গতকালের মমতাবিরোধী তাণ্ডব কি ততটাই উপভোগ্য ছিল না বিজেপি’র কাছে? শিক্ষামন্ত্রী পার্থচট্টোপাধ্যায় রাজ্যপালের পদ্মপাল সংক্রান্ত ডিএনএ গবেষণায় সময় না কাটিয়ে যদি ভিসিকে পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করতেন তাহলে গতকাল ঐ ঘটনা ঘটতে পারত না। যাদবপুরে পুলিশ কখনো ঢোকে নি--এমনটা তো নয়! ভবিষ্যৎ ভাবা উচিত ছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের অস্থিরতা ও দৃঢ়তার অভাব ভোকাল কর্ডের শক্তি দিয়ে ঢাকা যায় না। চেষ্টা করলে এই রাজ্যে মমতা বিরোধী ঢেউ এইভাবে মোদীর পক্ষে তোলা সম্ভব ছিল না!
তাঁর একটা সিদ্ধান্তের অবশ্য প্রশংসা করতেই হবে। তিনি ১৩ তারিখের বিরোধীদের বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় রেখেছেন। বিরোধীদের একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা তিনি কম করেন নি। ব্রিগেড প্যারেডগ্রাউণ্ডে সে আয়োজন আমরা দেখেছি। তথাকথিত বিরোধী নেতারা এখানে মমতাকে বিরোধীদের মুখ হিসেবে মেনে নিয়েও নিজের নিজের কোটরে ফিরে মমতার বদলে কেউ রাহুলকে নেতুত্বে চেয়েছেন--কেউ বা চন্দ্রবাবুকে! ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একাধিক নাম ভাসিয়ে দিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছেন--মোদী-বিরোধিতার ন্যূনতম যোগ্যতাই তাঁদের নেই। তাই বিপুল শক্তিতে মোদী ক্ষমতায় ফিরেছেন মানুষেরই ভোটে। আগে তাঁরা সঠিক বিরোধিতার যোগ্য করে তুলুন নিজেদের তখন নতুন করে বিরোধীমঞ্চ নিয়ে ভাবার সুযোগ থাকবে।
রাজ্যে সমস্যা কিছু কম নেই। মমতা যদি নিজের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে সঠিক চিন্তা না করতে পারেন তাহলে বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে চড়া মাশুল গুণতে হবে। মোদী একের পর এক এমন সব পরিস্থিতি তৈরি করবেন যার প্রতিক্রিয়ায় মমতাবিরোধী শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠে তাঁকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। বিজেপি বিরোধিতা তাঁর প্রধান এজেণ্ডা হলেও তা যেন কোন সুযোগসন্ধানী শক্তির প্রভাবে দিশেহারা না হয়ে ওঠে। বিজেপি বিরোধিতার ব্যাটন যেন তাঁর হাত থেকে কেউ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যেতে না পারে এটা তাঁকে দেখতে হবে। দলের ভেতরের ভয়ঙ্করভাবে মেদ জমে যাওয়া বহিরাগত হার্মাদদের প্ররোচনা থেকেও সদা সতর্ক থাকতে না পারলে ভবিষ্যৎ খুব আশাব্যঞ্জক বলে ভাবার কোন উপায় থাকবে না।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.