Header Ads

পুর নির্বাচনের প্রাক্ মুহূর্তে তৃণমূল বিজেপি--কে কোথায় !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 

কর্পোরেট ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর নাকি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রায় ৫০% প্রার্থী বদল না করলে পুরনির্বাচনে তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়বে। সংখ্যাটা তিনি একটু কম করেই বলেছেন--আমার বিশ্বাসে ঐ শতকরা হারটা হওয়া উচিত ছিল কম করেও ৮০%। প্রশান্ত কিশোর তাঁর টিমকে নামিয়ে যতটুকু তথ্যাদি সংগ্রহ করেছেন (প্রচুর ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও) তার ২৫% শতাংশ সঠিক নির্ভেজাল তথ্যাদি ও খবর স্বয়ং মমতা ব্যানার্জী তো বটেই শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম সুব্রত বক্সী, পার্থ চ্যাটার্জী, শুভেন্দু অধিকারীদের কাছেও নেই। নেই--কারণ, তাঁরা সকলেই নিজের নিজের ঘনিষ্ঠ বলয়ের তৈরি খবরাখবরই পেয়ে থাকেন এবং সত্যি বলতে কি তেমনটাই পেতে আগ্রহী ও অভ্যস্ত। ঘনিষ্ঠ বলয়ের ভেতরে থেকে যারা নানান কৌশলে দিব্যি করে কম্মে খাচ্ছে তারা কেউ-ই চায় না যাদের দৌলতে তাদের এই দাপট ও ফুলেফেঁপে ওঠা, তাদের উদ্বেগ বাড়াতে বা বলয় থেকে ছিটকে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে। ফলে জেলায় জেলায় তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তোলাবাজি চাঁদাবাজি নিয়োগপত্র বিক্রি ব’কলমে ঠিকেদারি সিণ্ডিকেট প্রোমোটারি সরবরাহকারীদের মারাত্মক আত্মঘাতী দাপট বিন্দুমাত্র কমার নাম নিচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট এলাকায় এদের দাপট এবং অত্যাচারের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া জনমনে কতটা গভীর নেতিবাচক ছাপ তৈরি করে ফেলেছে তার কিছুটা বাস্তব আাঁচ পেয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। 

গালভরা পর্যবেক্ষক নামের কিছু তেল-চুকচুকে নেতা জেলায় জেলায় ‘পর্যবেক্ষণ’ করতে আসেন--কর্মীদের সভায় আগুনে ভাষণও দেন--কর্মীদের কথা বলতে দেন না--কথা শোনেন তাদেরই যাদের তাঁরা পছন্দ করেন এবং ‘‘বিশেষ কারণে’’ যাদের ওপর নির্ভর করেন! এই ধরণের অলৌকিক পর্যবেক্ষণের ফলেই বিজেপি উত্তরবঙ্গের আটটির মধ্যে বিশাল বিশাল ব্যবধানে সাতটিতেই তৃণমূলের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে নিজেদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়! বিজেপি তাদের সংগঠনের জোরে আটটির মধ্যে সাতটিতে জেতে নি। বীতশ্রদ্ধ বিরক্ত হতাশ মানুষের ভোটেই বিজেপি জিতেছে। এই জয়ের কারণ হিসেবে শীর্ষ নেতৃত্ব যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন সেগুলো যে কতটা হাস্যকর ও দুর্বল এবং বাস্তবেই যুক্তিহীন তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও নেতারা তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ক্ষমতা হারিয়েছেন বলেই লোকসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে তড়িঘড়ি যে সব সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তা শুধু বিস্ময়করই নয়--রীতিমতো হঠকারী। বোঝা যাবে পুরনির্বাচন ও বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে। পরাজয়ের অঙ্কের হিসেবে জেলা নেতাদের রদবদলের সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি--গোষ্ঠীবাজদের শলাপরামর্শকে মান্যতা দিয়ে রদবদল করা হয়েছে, যার মারাত্মক নেতিবাচক ফল প্রতিফলিত হতে বাধ্য আগামী নির্বাচনগুলিতে।
প্রশান্ত কিশোর গত তিনটি উপনির্বাচনে দলকে জিতিয়েছেন বলে বিশ্বাস করেছেন অনেকেই--আসলে এই তিনটি আসনে প্রশান্ত কিশোরের কেরামতি কিছুই ছিল না--জিতিয়েছে এনআরসি বিরোধী ঢেউ। এ জয় আদৌ চমকপ্রদ ছিল না। প্রশান্ত কিশোর যে পদ্ধতিতে দলকে গুছিয়ে ফের গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন তাতে খুব আহামরি ফল ফলাতে গেলে তুণমূলস্তর থেকে শীর্ষস্তরের রাজনৈতিক মেধা ভাষ্য আচার-আচরণ এবং গণতান্ত্রিকবোধ ও চেতনাকে আগে পালিশ করে নেওয়া দরকার ছিল--প্রথম শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল এই দিকটাতেই। সেটার চেষ্টাও যে করছেন না তা নয়--কিন্তু যে অভ্যাস এবং ক্ষমতার অহঙ্কার ও উন্নসিকতা চেতনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তা থেকে তাদের মুক্ত করা এত তাড়াতাড়ি যে সম্ভব নয় সেটা প্রশান্ত কিশোর নিজেও বুঝতে পারছেন। তাই পুর নির্বাচনে ৫০% প্রার্থী বদলের কথা জানিয়ে তিনি নিজেও নিজেকে যথেষ্ট নিরাপদ ‘জোন’-এ রাখতে পারছেন। তিনি জানেন ৫০% প্রার্থী বদল করলে প্রার্থী বাছতে পুরসভা উজোড় হয়ে যাবে--গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দলের ভেতর থেকে সংগ্রহ করা যাবে না। ফলে খুব বেশি হলে ১৫-২০% প্রার্থী বদল করা হতে পারে--সেক্ষেত্রে দলের মুখ থুবড়ে পড়ার দায় প্রশান্ত কিশোরের ওপর চাপানো যাবে না! এটাই হল কর্পোরেট কৌশলের মূল কৌশল!
মানুষ মনে করছে, মমতা নিজের ওপর এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর ততটা আস্থা রাখতে পারছেন না যে আস্থার ওপর ভর করে তিনি সিপিএম তথা বামফ্রন্টের মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে মাটিতে শুইয়ে দিতে পেরেছিলেন। আস্থাহীনতা এতটাই দলকে গ্রাস করে ফেলেছে যে প্রশান্ত কিশোরের মতো এমন একজন ভোট প্রকৌশলীকে কয়েক’শো কোটি টাকার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হায়ার করতে হল যিনি এর আগে তাঁর চমকপ্রদ কৌশলে রাহুল গান্ধী লালুপ্রসাদ যাদব চন্দ্রবাবু নায়াডুর হাতে কৌটো ধরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন! দলের এই সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে রীতিমতো সাংগঠনিক আস্থাহীনতা ও দুর্বলতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে গেছে।
অন্যদিকে তিন তালাক, ৩৭০ ধারা, সিএএ-এর মতো মারাত্মক ইস্যুগুলিতে সংসদে তৃণমূলের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরণের ভূমিকায় মারাত্মক বিতর্ক তৈরি হয়ে গেছে। কেন্দ্রের ডাকে কোন বৈঠকে হাজির হয়ে রাজ্যের প্রতিবাদ রেকর্ড না করার প্রবণতাও মানুষ একেবারেই ভালভাবে নিচ্ছে না। মমতা তাঁর ‘‘দাবি-দাওয়া’’ সম্পর্কে রাজ্যসরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-অফিসিয়ালদের সঙ্গে না নিয়েই হঠাৎ হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করছেন, কিন্তু রীতি ও প্রথামাফিক সব রাজ্য যা করছে তিনি তা করছেন না! বেশ কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধে থেকে তিনি রাজ্যের মানুষকে বঞ্চিত করছেন বলেও জোরালো অভিযোগ উঠছে। তাঁর এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও আলোচনা চলছে--নানান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে--বিজেপি সেগুলোকে অস্ত্র হিসেবে রীতিমতো ব্যবহার করছে--অথচ এইসব জরুরি বিষয়গুলি নিয়ে জনসমীক্ষা করার মতো দলে কেউ না থাকায় বিজেপি বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি উঠে আসতে পারছে অতি সহজেই। এই পরিস্থিতিতে কতটা কী করতে পারবেন প্রশান্ত কিশোর?
সিএএ বিরোধিতায় দেশের প্রায় সব রাজ্যই (বিজেপি শাসিত রাজ্য ছাড়া) প্রতিবাদে মুখর হলেও কেন্দ্রের ডাকা বৈঠকে তারা সবাই হাজির হয়ে তাদের প্রতিবাদ নথিভুক্ত করল--অনুপস্থিত থাকল একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ--মানুষ কিসের ভিত্তিতে কোন ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে মেনে নেবে এই সিদ্ধান্ত দারুণ রাজনৈতিক মেধা সম্পন্ন সিদ্ধান্ত বলে? সিএএ বিরোধিতায় দিনের পর দিন নগরসংকীর্তন করে, ধর্ণায় বসে রাজ্যের মানুষকে কতটা প্রভাবিত করা গেল? জেলায় জেলায় বিজেপি’র অভিনন্দন যাত্রায় যেভাবে মানুষের ঢল নামছে--সেটা দেখেও কি সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে মানুষ সিএএ-বিরোধিতাকে পাত্তা দিচ্ছে? কিছু শিক্ষিত মানুষ কিছু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের গগণবিদারী আওয়াজে মানুষ কি সত্যি সত্যি প্রভাবিত হচ্ছে? মানুষকে কি বোঝানো যাচ্ছে ঠিক কোন্ যুক্তিতে সিএএ-বিরোধী মিছিল-মিটিং হচ্ছে? বিজেপি যে ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ লিফলেট ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে তাকে যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে খন্ডনের কোন চেষ্টা করা হচ্ছে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যদি সিএএ আইন সাংবিধানিক বৈধতা পেয়ে যায় তাহলে তাকে অসাংবিধানিক বেআইনি বলার মতো আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার কি রাজ্যের হাতে থাকবে--সাংবিধানিক পদে থেকেও কি বলা যাবে--সিএএ অসাংবিধানিক এবং বেআইনি? যদি বলা না যায় তাহলে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা কি করে করা সম্ভব হবে--অথবা তার প্রতিক্রিয়া ভোটবাক্সকে কি ভাবে প্রভাবিত করবে নেতারা না ভাবলেও মানুষ কিন্তু মনে মনে ভাবছে--আর ভাবছে বলেই বিজেপি’র অভিনন্দন যাত্রায় মানুষের অবিশ্বাস্য ঢল নামছে। টিভির পর্দায় মানুষ প্রতিদিন এই জনস্রোত দেখছে।
রাজ্য রাজনীতির (গোটা দেশেরও বলা যায়) এই ডামাডোলে তৃণমূলকে যতটা দিশেহারা মনে হচ্ছে--বিজেপিকে কিন্তু আর তা মনে হচ্ছে না। দিলীপ ঘোষের ভাষণ মানুষের কাছে সেইভাবেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে যেভাবে অনুব্রত মণ্ডল, আরাবুল ইসলাম, জিতেন তেওয়ারি. জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, ফিরহাদ হাকিম, দোলা সেন প্রমুখদের ভাষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়েই ফের একবার সভাপতির পদে বসেই দিলীপ ঘোষ ময়দানে ঝাঁপিয়েছেন। প্রচুর হাততালিও পচ্ছেন--এটাই এ রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি--দিলীপবাবু এই অস্ত্রেই বিরোধী শক্তিকে ঘায়েল করে এগিয়ে যেতে চাইছেন। প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে সেই সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেও দেওয়া হচ্ছে। দিলীপবাবু তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করছেন না। তাঁকে ঠেকানোও যাচ্ছে না!
পুরনির্বাচন যেহেতু শহরকেন্দ্রিক নির্বাচন--ফলে লড়াইটা একমুখী হবে না আদৌ। সমানে সমানে লড়াই হবে। সেক্ষেত্রে দাগী-পচা প্রার্থী যত থাকবে বিজেপি’র সুযোগ তত বাড়বে--বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। এখনই বলছি না উত্তরবঙ্গে কতগুলো পুরসভায় বিজেপি সফল হতে পারে--তবে ফলাফল যে খুব খারাপ হবে না তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
বিধানসভা নির্বাচনের প্রশ্নে প্রশান্ত কিশোর যদি বলেন ১৩০-৩৫ জনকে বাদ দিতে হবে, আমি একটুও অবাক হব না। আমিও মনে করি ১৩০-৩৫ জনকে বাদ না দিলে ভরাডুবি ঘটে যেতে পারে। কিন্তু ১৩০-৩৫ জনকে বাদ দেওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও কি কেউ ভাবতে পারবেন? একেবারেই মনে হয় না। কিন্তু নিদারুণ লজ্জাজনক পতনের চেয়ে তো গৌরবজনক হার যদি বেশ কিছু আসনে হয়ও তাতে দলটা অন্ততঃ বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচে যাবে বলে আমার বিশ্বাস!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.