Header Ads

চুরি হয়ে যাচ্ছে রান্নাঘর , বদলে যাচ্ছে রান্নাঘরের কনসেপ্ট


 আজ থেকে ৪০ বছর আগেও বাঙালি রান্নাঘরের যেমন ধারণা ছিল, একান্নবৰ্তী পরিবার ছিল। মায়েরা সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার দাবার এরপর রাতে কী খাওয়া হবে সমস্তটাই নিজের হাতে গুছিয়ে দেখাশোনা করতেন। পরিবারের প্ৰতি বাবার দায়িত্বটা ছিল অন্যরকম। সকাল হলেই চা খেয়ে ব্যাগ হাতে বাজার যেতেন দুপুরের জন্য মাছ বা শাকসব্জি কিছু পাওয়া যায় কিনা। ব্যাগ ভৰ্তি বাজার আনতেন বাবা, বাড়িতে রান্নাঘরে শাক বেছে কেটে ধুয়ে, মাছের ঝোল রান্না থেকে শুরু করে ছেলেময়েদের খাবার বেড়ে দেওয়া সমস্ত দিকই দেখতেন মা। তারপর একান্নবৰ্তী পরিবারগুলো ভেঙে ছোট ছোট পরিবার হয়ে গেল। 


 দিন যত এগিয়েছে রান্নাঘরের কনসেপ্টটাই ধীরে ধীরে বদলে গেছে। বৰ্তমানে ট্ৰেডিশনাল খাবার দাবারের সঙ্গে মিশেছে ফিউজন। বিভিন্ন সংস্কৃতির খাবারের সঙ্গে মিক্সআপ-এর ব্যাপারটি কিন্তু আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। মানুষের কাছে সময় নেই হয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে খাবারের অৰ্ডার করলে একঘন্টার মধ্যে নিজের পছন্দের  খাবার দোড়গোড়ায় চলে আসছে। সেই রান্নাঘরের বদলে যাওয়ার বিষয় নিয়েই বই লিখেছেন উত্তরপূৰ্বাঞ্চলের প্ৰখ্যাত লেখিকা তথা সাংবাদিক সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া। বাংলাদেশের প্ৰকাশনা সংস্থা ‘সুবৰ্ণ ’বইটি সেদেশে রিলিজ করেছে। বইটি নিয়ে লেখিকা কথা বলেছেন ‘নয়া ঠাহর’-এর সহযোগী সম্পাদক রিংকি মজুমদারের সঙ্গে। সেই কথোপকথোনের কিছু অংশ ওয়েব পোৰ্টালটির পাঠকগোষ্ঠীর জন্য তুলে ধরা হল।

আমার ছেলে আকাশ যখন স্কুলে পড়তো। স্কুল ছুটির পর বায়না ধরতো এটা খাবো, ওটা খাবো। কারণ হাতের কাছেই ছিল বাজারের খাবার । কীভাবে বাইরের খাবারের হাতছানি থেকে বাঁচাতে ওর জীবনে রুটিনে পরিবৰ্তন আনতে হয়েছিল, সেটা এখনও মনে পড়লে হাসি পায়। বলা যায় এই বিষয়টা তখনই চিন্তায় ঢুকে পড়েছিল। তারপর দেখলাম, আমি বা আরও কেউ কেউ মা সজাগ হয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে, কিন্তু অনেকেই ভাবছে না। তারপর গত কয়েক বছরে দেখলাম, খাবার আর বাজার এই দুটো বিষয় একেবারে নিবিড় সখ্যতায় বাঁধা পড়ে গেছে।
রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘‘চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য, দেশ বিদেশে বিতরিছ অন্ন।’’ এখন বোধ হয় বিষয়টি বদলে গেছে। 


তবে ভারতবৰ্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্ৰভাবে দেশের খাদ্যসম্ভারকে বিশাল ক্যানভাসে পরিচয় করিয়ে দিতে পেরেছে। বিশেষ করে দুই বাংলার খাদ্য সম্ভারের প্ৰাচুৰ্য, আর আমি যখন কিশোরী ছিলাম, অৰ্থাৎ আশির দশক, তখন পৰ্যন্ত আমার মায়ের রান্নাঘর কিন্তু একটা অঘোষিত কারাগারই ছিল। রান্না শুরু করার আগের পৰ্বটাই ছিল বেশ কষ্টকর। জ্বালানি উনুন ধরানো। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের ছবিতে বদল এসেছে। গ্যাস এসেছে। ফ্ল্যাটের জীবনে ডাইনিং হল হয়েছে। যেখানে পিড়ি বা আসন নয়, ডাইনিং চেয়ার টেবিল। বাসনে বদল এসেছে। কাঁসা বা স্টিল থেকে ক্ৰকারিজ। মুক্ত বাজার অনেক উদার। লিঙ্গ বৈষম্যকে উৎসাহিত করে না একশ পৰ্যায় পৰ্যন্ত। এখন রান্নাঘর শুধু মেয়েদের বিষয় নয়। গৃহবধূ কনসেপ্টটাই বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে। এখন খাদ্য প্ৰাকৃতিক সম্পদ থেকে বাজারের পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারতবৰ্ষে প্যাকেট খাদ্য ব্যবহারে তিন নম্বরে রয়েছে। ২০২০ সালে এই পরিসংখ্যান গিয়ে দাঁড়াবে সাতচল্লিশ মিলিয়ন টন। আমেরিকা, চিনের পরেই ভারতবৰ্ষ। এদেশে একজন মানুষ বছরে ২৪ কিলোগ্ৰাম প্যাকেট খাদ্য খায়। এর মধ্যে প্যাকেট মাংস, বেবিফুড, চকলেট বিস্কুট, বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীদের মগজে  স্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছে। রান্নাঘরে ছয় রস যথাক্ৰমে কটু, তিক্ত, কষা,লবণ, অম্ল ও মধুর এখন উধাও। ‘ডাউন অডিট’ থেকে ‘ইটইন’ এটাই সুখাদ্যের পরিবেশ রচনা করে দিয়েছে।

 আমার মনে হয় বিশ্বের ধনতান্ত্ৰিক দেশগুলো নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে খাদ্য রাজনীতির বিষয়গুলি সুন্দর করে মেলাতে পেরেছিল। ‘ওয়েজেস ফর হাউজওয়াৰ্ক’ এই ধরনের স্লোগানকে উৎসাহিত করেছিল। জেন্ডার উন্নয়নের বিষয়গুলির সঙ্গে মুক্ত হয়ে আছে নারীর স্বাতন্ত্ৰ ও ক্ষমতার প্ৰশ্ন,নারীর মজুরি বিহীন কাজের স্বীকৃতি ইত্যাদি। ধনতান্ত্ৰিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠা সমাজ জীবনের একটি বিশেষ অবস্থান বাজার সেখানে প্ৰাথমিকভাবে বা ওপর থেকে দেখলে মনে হয় লিঙ্গ বৈষম্য নেই। নারী-পুরুষ দুজনেই একই কাজ করতে পারে, কিন্তু ধনতন্ত্ৰ টিকে থাকে বৈষম্যের রাজনীতির ওপরে, সুতরাং যে কোনও সমস্যার আৰ্থ -সামাজিক রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চয়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির নিরিখে দেবে না।


 জনগোষ্ঠীর মানুষ যদি নিজের খাদ্য ঐতিহ্য সম্পৰ্কে সচেতন হয়, খাদ্যের মাধ্যমেই আত্মপরিচয় আর আত্মপ্ৰতিষ্ঠার সংগ্ৰামকে ভাবতে চান, দেখা যাবে নিজস্ব রান্নাঘরকে বাঁচানোর সংগ্ৰামই আত্মপ্ৰতিষ্ঠার সংগ্ৰামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। এককথায় কী বলবেন?

কবি বীরেন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটাই মনে রাখবো,
অন্ন বাক্য অন্ন প্ৰাণ অন্নই চেতনা / অন্ন ধ্বনি, অন্ন মন্ত্ৰ অন্ন আরাধনা / অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সৰ্বধৰ্ম সার/ অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঙ্কার/ যে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে / ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তাকে...

রান্না হওয়ার পরে খাওয়ার পাতে আসা পৰ্যন্ত যেমন একটা অপেক্ষা থাকে, ঠিক তেমনি ‘চুরি হয়ে যাচ্ছে রান্নাঘর’ পাঠকদের পাতে পরিবেশনের অপেক্ষা শেষ। আমাদের কথাবাৰ্তায় তেমনটাই উঠে এল।

বইটা কোথায় পাওয়া যাবে? 

ভারতবৰ্ষের পাঠকদের বোধহয় অনলাইনে কিনতে হবে। বাংলাদেশের প্ৰকাশনা সংস্থা ‘সুবৰ্ণ’ বইটি প্ৰকাশ করেছে। কলকাতা আন্তৰ্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের প্ৰকাশনা সংস্থা মওলা ব্ৰাদাৰ্স-এ বইটি পাওয়া যাবে। এছাড়াও বইটি পড়তে ইচ্ছুক পাঠকরা সুবৰ্ণ প্ৰকাশনার সত্ত্বাধিকার মহাশয় মফুজ্জল হক-এর মেল আইডি bdsubarna@yahoo.com এ যোগাযোগ করলে হাতে অনায়াসে পেয়ে যাবেন।





কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.