আনন্দে আত্মহারা হওয়ার আগে অঙ্কটা বুঝে না নিলে পস্তাতে হতে পারে !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ
পশ্চিমবঙ্গের সদ্য অনুষ্ঠিত তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল শিবিরে বাঁধনহারা উল্লাসের ছবি ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে। গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন দখল করার সঙ্গে সঙ্গে যেমন বঙ্গ বিজেপি ধরেই নিযেছিল একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় তারা বসেই গেছে--শপথ নিতেই যা দেরি--ঠিক তেমেনই আত্মপ্রত্যয় দেখা যাচ্ছে তৃণমূল শিবিরে। কিন্তু সত্যি সত্যি কি বাঁধনহারা আনন্দে মেতে ওঠার মতো ফলাফল সামনে এল এই তিনটি উপনির্বাচনে? একবার অঙ্কটা বুঝে নেওযা যাক।
গত লোকসভা নির্বাচনে শতাংশের হিসেবে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রদত্ত মোট ভোটের (৫,৯৫,০৯৪) মধ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল ৪৭.৯৭% (২,৮৫,৪৯৩) এবং তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল ৩৩.২৬% (১,৯৭,৯৩৯)। বাম-কং-এর প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ছিল ১৫.৭৯% (৯৩,৯৩৭)। এই হিসেবে বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে ১৪.৭১% ভোট বেশি পায়। এই পরিমাণটা তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের হিসেবে একেবারেই কম নয় এবং মনে রাখতে হবে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কিন্তু করিমপুরে এগিয়ে যেতে পারে নি।
সদ্য সমাপ্ত তিনটি উপনির্বাচনে শতাংশের হিসেবে কিন্তু তৃণমূল উল্লেখযোগ্য অঙ্কের ব্যবধান তৈরি করতে পারে নি। উপনির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শতাংশ হল ৩৯.৩২% (২,২৬,৪০৭) এবং তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ সেখানে ৪৭.৫% (২,৭৩,৫৯৯)--অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে তৃণমূল এই উপনির্বাচনে বিজেপি’র চেয়ে ৭.৭৩% ভোট বেশি পেল--কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে সেটা বিজেপি ও তৃণমূলের ব্যবধান ১৪.৭১%-এর প্রায় অর্দ্ধেক ! তার মানে, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে ভোট পেয়েছিল তৃণমূল সেই ভোট অতিক্রম করতে পারে নি। প্রাপ্ত ভোটের তুলনা করলেই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে (২,৮৫,৪৯৩ - ১,৯৭,৯৩৯) ৮৭, ৫৫৪ ভোট বেশি পায়। উপনির্বাচনে সেই হিসেবটা দাঁড়াল এই রকম--তৃণমূল কংগ্রেস ২,৭৩,৫৯৯ - বিজেপি ২,২৬,৪০৭ = ৪৭,১৯২ যা কিনা লোকসভার ব্যবধানের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। শতাংশের হিসেবেও তৃণমূলের অগ্রগতি মাত্রই দশমিক ৯২ (০০.৯২) শতাংশ !
শুধু তাই নয়--লোকসভা নির্বাচনে করিমপুরে বিজেপি’র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৭৩,১৭৩ এবং উপনির্বাচনে বিস্ময়করভাবে সেটা একটুও না কমে বেড়ে গিয়ে হল ৭৯,৩৬৮ ! এই হিসেবে পিকে’র কেরামতি কারা কতটা খুঁজে পাবেন আমি জানি না--আমার মতে পিকে এখানে ডাহা ফেল--এনআরসি আতঙ্ক না থাকলে ফলাফল এখানে উল্টে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
কালিয়াগঞ্জে গত লোকসভায় তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ব্যবধান
ছিল ১,১৮,৮৯৫ - ৬২,১৩৩ = ৫৬,৭৬২ ভোটের। উপনির্বাচনে
সেই ব্যবধান গিয়ে দাঁড়াল মাত্রই ২,৪২৯ ভোটে। এই ভোটটা যদি তৃণমূলের ইভিএমে না ঢুকে বাম-কং-এর ইভিএমে চলে যেত
তাহলে ফলাফল উল্টে যেত। এনআরসি আতঙ্কই এখানে তৃণমূলের তুলনায় বিজেপিকে প্রায় আড়াই হাজার ভোটে পিছিয়ে দিয়েছে--পিকের কেরামতি এখানেও ডাহা ফেল ! অন্ততঃ অঙ্ক তাই নির্দেশ করছে !
সামগ্রিকভাবে বাম-কং জোটকে যে মানুষ এখনও একেবারেই
পাত্তা দিতে প্রস্তুত নয় সেটা বোঝা গেল লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট ৫%-এরও বেশি কমে যাওয়ায় ! কয়েক হাজার ভোটের ফ্যাক্টর হতে পেরেছে শুধুমাত্র প্রায় কসমোপলিটন সদর খড়গপুরে !
‘‘আমি নয় আমরা’’ কিংবা ‘‘ব্যক্তি নয় দল’’ ইত্যাদি যে ধরণের বাতেলাই সামনে তুলে আনার চেষ্টা করা হোক না কেন খড়গপুরের জয়ের সিংহভাগ দাবিদার শুভেন্দু অধিকারী। এখানে অসম ব্যক্তিত্ব ও অসম সংগঠনের লড়াইয়ের সামনে দিলীপ ঘোষ দাঁড়াতে পারেন নি। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এই কেন্দ্রে এবারে বাম-কং জোট প্রায় ৬ হাজার বাড়তি ভোট কেটে বিজেপিকে বুঝিয়ে দিয়েছে বেশ কিছু সিপিএম-কং দলছুট কর্মী সমর্থক বিজেপিকে ছেড়ে এসেছে। দিলীপবাবুরা যখন আত্মপ্রত্যয়ের তুঙ্গে থেকে অসংলগ্ন বাচালতায় বাজার তাতানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন--শুভেন্দু তখন তাঁর নির্ভরযোগ্য টিম নিয়ে সংগঠনকে কিভাবে চাঙ্গা করে জয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হয় নিরন্তর সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। প্রায় নিঃশব্দেই তিনি ঘর গুছিয়ে কিভাবে খড়গপুর ছিনিয়ে নিতে পারলেন তা আমি খুব ভাল করেই জানি। শুভেন্দুর এই সাংগঠনিক মেধার ধারে কাছে থাকছেন না শুধু দিলীপ ঘোষ অ্যাণ্ড সম্প্রদায়-ই নয়--তৃণমূলেরও বাক্ সর্বস্ব কিছু নেতাও। একুশের নির্বাচনে খড়গপুরকে বিজেপির জন্যে পুরোপুরি অনিশ্চিত করে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। উপনির্বাচনের ফলাফল-ই বলছে--খড়গপুর ছাড়া বাকি দুটি আসনে কোন ব্যক্তিক্যারিশমা নয়, পিকে নয়, সংগঠন নয়--এনআরসি আতঙ্কই তৃণমূলকে খাদের কিনারা থেকে সরিয়ে এনেছে। সুতরাং ফলাফলের এই অঙ্ক চোখের সামনে রেখে বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে যদি দলেরই কিছু সুযোগসন্ধানী ঠ্যাঙারে মতলববাজ ও শত্রুপক্ষেরই মেঘনাদদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা না করা হয় তাহলে যে কোন মুহূর্তে লড়াইটা মারাত্মক কঠিন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকছেই !
কোন মন্তব্য নেই