Header Ads

প্রসঙ্গ : নাগরিকত্ব আইন ও তার প্রতিক্রিয়া !!



বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ সংশোধিত নাগরিক আইন এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন বিষয় হয়ে গেছে--আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই--আইন বিশেষজ্ঞও নই, তবু আমার সাধারণ বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে বুঝতে পারছি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় কি হতে পারে। কেন্দ্রের বা রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী নেতা বা দল সব সময়েই দাবি করে--টাকা ও প্রভাব খাটিয়ে এরা আইন-আদালত-বিধায়ক-সাংসদ সবকিছুই টপাটপ কিনে নেয়--সংখ্যার জোরে এরা আইন-কানুন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে যখন তখন। এই অভিযোগ যারা তোলে তারাই কিন্তু ক্ষমতালোলুপতায় অতি সহজেই বিকাও যোগ্য ক্রয়যোগ্য আইন-কানুন বিধায়ক-সাংসদদের নিয়েই ক্ষমতার লড়াই করে--কখনো বিরোধী আসনে বসে প্রলাপ বকে কখনো ক্ষমতায় বসে অসংসদীয় প্রগলভতায় উন্মাদ হয়ে ওঠে।
এই ধরণের রাজনৈতিক তামাশা দেশবাসী দেখেছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়, দেখেছে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময়, বেওকুফ ঘাতকের হাতে ইন্দিরা-রাজীব হত্যার সময়, শিখ-হিন্দু দাঙ্গার সময়, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময়, গুজরাত দাঙ্গার সময়, মরিচ ঝাঁপি-নন্দীগ্রাম-নেতাই হত্যাকাণ্ডের সময় ছাড়াও আরও অসংখ্য মুহূর্তে নির্লজ্জ ঘৃণিত রাজনীতি মানুষ দেখেছে--আজও নানা ঘটনায় মানুষকে দেখতে হচ্ছে। এদেশের রাজনৈতিকদলগুলো চিরকালই যে কোনও ঘটনাকেই নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থের দিক থেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে থাকে। এখন দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে নাগরিকত্বের প্রশ্নে !
সংখ্যার জোরে সংসদে সংবিধানসম্মত ভাবে বিল পাশ না করিয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বিল পাশের সুযোগ সংবিধানে থাকা উচিত ছিল কিনা সেটা আদালত নিশ্চয়ই জানাবে। দু’চার টুকরো এঁটো-কাঁটা ছুঁড়ে সহজেই গলায় ক্ষমতার শেকল পরিয়ে আইন-সংবিধান-সাংসদ-বিধায়কদের নিজেদের পাশে আনার সুযোগ সংবিধান কোথাও রাখে নি--তবু যদি এমন সব কাণ্ড হতে থাকে তাহলে তার দায় কার? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বা দেওয়ার দায় বর্তাচ্ছে সেই সহজেই কিনে নেওয়া যায় এমন আদালত বা আইনসভার--সাধারণ মানুষের নয়। একটা দেশকে চলতে হয় তার সংবিধানের নির্দিষ্ট নির্দেশিত পথেই--অন্য কোনও বিকল্প নেই--ঘন ঘন জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া। সুতরাং সংবিধান নির্দেশিত পথে নির্বাচিত সরকারকে দেশের সংবিধান ও সংবিধান সম্মত আইনকে মেনে চলতেই হবে। বিশেষ কিছু পছন্দ হোক বা না হোক। সংশোধিত আইন রাজ্য সরকারগুলো মানতে বাধ্য কি বাধ্য নয় তা সুপ্রিম
কোর্ট-ই জানাবে কিছু দিনের মধ্যেই। না মানলে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে। কেন্দ্র বা রাজ্য সেই সাংবিধানিক সঙ্কট কিভাবে মোকাবিলা করবে সময় মতো সেটা দেখা যাবে।
বিজেপি সরকার লোকসভা ভোটের আগে প্রকাশিত দলীয় ইশতেহারে বলেছিল--তিন তালাক, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা এবং নাগরিকত্ববিলে সংশোধনী আনবে। তাদের এই ঘোষিত অঙ্গীকার মানুষের রায়ে প্রত্যাখ্যাত হয় নি। বিজেপি বিরোধী দল ও নেতারাও এই ইশতেহারের কথা জানতেন--তাঁরা এইসব ‘‘জনস্বার্থ বিরোধী সাম্প্রদায়িক’’ প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারেন নি--উল্টে তাঁরা মানুষকে বিরক্ত বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছেন নিজেদের মধ্যেকার অনৈক্য ও ক্ষমতালোলুপতার প্রতিযোগিতার কারণে। মানুষ তাঁদের ভরসা করতে পারে নি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে (সংবিধান নির্দেশিত সংসদের সংখ্যার বিচারে--জনসংখ্যার শতাংশের বিচারে নয়) বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসার পর প্রতিমুহূর্তে নিজেদের অপদার্থতা ব্যর্থতা অক্ষমতাকে আড়াল করার তাড়নায় নির্লজ্জের মতো নিজেদের মাংস নিজেরাই খেয়ে চলেছে। তারা দাবি করছে--বিজেপি টাকার জোরে ক্ষমতার জোরে সংখ্যার জোরে সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে--আইন সংবিধান লঙ্ঘন করছে। কিন্তু একবারও বলছে না--তাদের এই সুযোগ কারা করে দিল !
১৪’সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে আজপর্যন্ত বিজেপি সাধারণ মানুষের যথার্থ বিকাশের লক্ষ্যে তেমন কোন কাজ করে নি। দেশের মানুষকে প্রতিদিন গাদা গাদা জেরক্স মেশিনের পাশে, ব্যাঙ্কের কাউন্টারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের গলা টিপে ধরেছে। ঘুম ভেঙে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষকে কতরকমের ট্যাক্স দিতে হচ্ছে বিজেপি সরকার তা বোঝার চেষ্টা করে নি। ব্যাঙ্কগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে--কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর বদলে সুযোগ নষ্ট করার মতোই একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে। মানুষ মাছ-মাংস-পেঁযাজ খাবে কি খাবে না, জয় শ্রীরাম বলে কুশল বিনিময় করবে কি করবে না, মেয়েরা তাদের সুবিধের কথা ভেবে স্কার্ট-প্যান্ট-কুর্তা পরবে না পরবে না, টুথপেস্টের বদলে নিম কাঠি দিয়ে দাঁত মাজবে কিনা, ড্রিঙ্ক করবে কিনা, সর্বধর্মের অনুষ্ঠান উৎসবে যাবে কিনা--এই ধরণের অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে বিজেপি বা তাদের তথাকথিত ধার্মিক চ্যালাদের নিরন্তর খবরদারিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও ইতিহাস নিয়ে মুর্খ পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও মানুষকে বিরোধী দল বা নেতারা বিজেপি’র বিরুদ্ধে সম্মিলিত করতে পারছে না--পারছে না, কারণ তারা নিজেরাই বিরোধের সেই জায়গাতে উঠে আসার যোগ্যতা হারিয়ে পথে বিপথে দিশেহারা পাগলার মতো ছুটে বেড়াচ্ছে ! ছুটছে বলেই গত লোকসভায় যাদের ফেরার কথাই ছিল না তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এল ! এ কৃতিত্ব কাদের? কে বলেছিল পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যার জোরে ক্ষমতার অনৈতিক দম্ভে ও ঔদ্ধত্যে টপাটপ বাম-কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের গিলে খেতে? কে বলেছিল এ রাজ্যে তৃণমূল মানেই সংবিধান--তৃণমূল মানেই আইন--তৃণমূল মানেই গণতন্ত্র--এমন একটা আত্মঘাতী ভয়ঙ্কর পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে? কে বলেছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক (বিশেষ করে বাম-কংগ্রেসের) মিনিমান গণতান্ত্রিক স্পেসটুকুও চেটেপুটে হজম করে ফেলতে? লোকসভা নির্বাচনে এক-আধটা নয়--১৮ টা আসন বিজেপি তুলে নিতে পারত যদি বাম-কংগ্রেসকে একেবারে বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত করা না হত? এখন হাপুস নয়নে কান্নাকাটি করতে করতে এস ভাই বাম এস ভাই কংগ্রেস বললে কিছু হবে?
নাগরিকত্ব বিল নিয়ে রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক পথেই দেখাতে পারত--আইন না মানার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করতে পারত--কিন্তু সে পথে না গিয়ে বিশেষ সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভয়ঙ্কর ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞ উপভোগের চরম আত্মঘাতী প্ররোচনার রাজনীতি কেন করতে হল? এর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপকতা অনুভব করার মতো মিনিমান মেধার এত অভাব নিয়ে ভাবনা চিন্তা কবে শুরু হবে--রাজ্যপাট হস্তচ্যুত হওয়ার পর? যে ঘটনা রাজ্যে ঘটল তার চড়া মাশুল দিতেই হবে রাজ্যকে। এমন ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেশের আর কোন রাজ্যেই দেখা গেল না--শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কেন? কোন ভয় বা আতঙ্ক কাজ করছে কি? নাকি কেন্দ্রের তুলনায় এক অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা কত বেশি সেটা যুক্তি-তর্কহীন অবস্থানে থেকেই প্রমাণের তাড়না ! যাই হোক না কেন--মানুষের চরম ভোগান্তি বা দুর্গতির দায় যে কার সেটা মানুষ বুঝতে পারছে--কোন যুক্তিতেই তাদের বিভ্রান্ত করা যাবে কি? সে চেষ্টায় নামলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.