Header Ads

আমরা সবাই নাগরিক--কেউ কেউ নাগরিক নই !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে সারা দেশ এখন উত্তাল এবং কেউ স্বীকার করুন আর না-ই করুন আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ থেকেই সিএএ বিরোধী আন্দোলনের আঁচ গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে বাম, কংগ্রেস এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এটাই--সিএএ বিরোধী আন্দোলন যত দ্র্রুত এবং যেভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল সেভাবে কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বিরোধিতার চেহারায় দেখা যায় নি। 

দেখা যায় নি এবং যায় না বলেই বিজেপি দেশের ৮০% হিন্দুর আবেগকে ক্যাশ করে বিপুল সমর্থনে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। সিএএ’র ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত যে ঐ ৮০%-এর সিংহভাগই ক্রমে ক্রমে তাদের পাশেই ফিরে আসবে--কারণ, ১৮%-এর পুঁজি নিয়েই রাজনৈতিক ময়দানে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ারা বিজেপি বিরোধিতায় থাকবে--৮০%-এর সিংহভাগের কথা তারা ভাবতেই পারবে না--উপায় নেই বলেই ! জানি, আমার এই কথাগুলো এক্ষুণি অনেকেরই  বোধগম্য হবে না। একটু সময় লাগবে।

ভারত বিভাজিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে দু’খণ্ড হয়ে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। পাকিস্তানের ভাষা-সংষ্কৃতি-জীবনযাপন এবং বিশেষ করে পাকিস্তানী-বোধের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শুধুমাত্র ধর্মীয় মিল ছাড়া আর কোন মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে বেশিদিন থাকা যাবে না এটা মৌলবাদী কট্টর মুসলিম ছাড়া সবাই বুঝতে পারছিলেন বলেই মৌলানা ভাসানী-শরৎ বসু সহ বেশ কিছু বিশিষ্ট বঙ্গসন্তান চেয়েছিলেন ভারত তিনখণ্ড হোক--ভারত, পাকিস্তান ও গ্রেটার বেঙ্গল ! গ্রেটার বেঙ্গলের দাবি খারিজ হয়ে গেলেও পাকিস্তানের সঙ্গে গোটা বাংলা প্রদেশকে যখন যুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাচ্ছিল তখনই শ্যামাপ্রসাদ-বিধানচন্দ্র রায়-নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ বাংলার বহু অগ্রণী বিশিষ্টজন বঙ্গ-বিভাজন চাইলেন। ধর্মের ভিত্তিতে যখন দেশভাগ ঠেকানোই যাচ্ছে না তখন হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গকে কেন মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে হবে? যখন দেশভাগ হয় তখন পাকিস্তান এবং অধুনার বাংলাদেশে ৩০% হিন্দু নাগরিক ছিল। এখন পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু মাত্রই ৩% এবং বাংলা দেশে প্রকৃতপক্ষে ৫%-এরও কম। ভারত যখন ভাগ হয় তখন ভারতে ৮৫% হিন্দু এবং ৯%-এর মতো মুসলিম থাকলেও এখন সেই শতকরা হিসেবটা দাঁড়িয়েছে ৮০% এবং ১৮%--অর্থাৎ হিন্দুর সংখ্যা (অগণিত হিন্দু শরণার্থী এলেও) উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে--অন্যদিকে মুসলিমদের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেড়ে গেছে। এদেশে সংখ্যালঘুরা কী গভীর সঙ্কটে এবং বিপদে আছে তা এই হিসেব থেকেই স্পষ্ট ! এ দেশে সংখ্যালঘু (মুসলিম) সম্প্রদায়ের মানুষ রাষ্ট্রপতি-রাজ্যপাল-কেন্দ্র এবং রাজ্যের মন্ত্রী তো বটেই সেনা-রাষ্ট্রপুঞ্জ ও পুলিশের উচ্চ পদে বসতে পারেন--বসছেনও--কারণ, এই দেশটার নাম ভারতবর্ষ। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা এ কথা ভাবতেই পারে না--কারণ, তারা পাকিস্তানে এবং অনেকটা বাংলাদেশেও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকের জীবন কাটাতে কাটাতে প্রায় লুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
বৃটেন-আমেরিকা-জার্মানি-ফ্রান্স-চিনের মতো ভারতের প্রশাসন ভারতীয় নাগরিকত্ব পরিচিতি দিতে পারে নি--কিন্তু সাবালক সমস্ত ভারতবাসীকে ভোটাধিকার দিয়েছে। র‌্যাশনকার্ড-ড্রাইভিং লাইসেন্স-ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিসের পাশবই-পাসপোর্ট-ইলেক্ট্রিক বিল-বাড়ি ভাড়ার রসিদ--এসবের যে কোন একটা দেখালেই ভোট দিতে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু এ সবের একটাও নাগরিকত্বের পরিচয় বহন করে না ! পরে এল ডেট অফ বার্থ ও র‌্যাশনকার্ড-এর প্রমাণ দেখিয়ে আধার কার্ড--যা মূলতঃ একজন ভারতবাসীর সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান, তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং ধর্মীয় পরিচিতি সম্বলিত তথ্যাদি একটা ক্লিকের মাধ্যমে জেনে নেওয়ার একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা যুক্ত ব্যক্তি পরিচিতি কার্ড। এরও আগে অবশ্য জন্ম তারিখ ও র‌্যাশনকার্ড পেশ করে মানুষ ভোটাধিকারের জন্য একটা এপিক কার্ডও পেয়ে গেছে--যার মধ্যে শুধুই ইলেকশন শব্দটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে--সিটিজেন শিপের কথা কোথাও লেখা নেই। প্যানকার্ড তৈরি করেছিল আয়কর দপ্তর।  পরে সরকার আধারকার্ডকে ব্যাঙ্ক ও প্যান কার্ডের সঙ্গে যুক্ত এই জন্যে করে নি যে প্যান বা আধারকার্ডকে সিটিজেনশিপ কার্ড হিসেবে মান্যতা দেওয়া হবে। যুক্ত করা হয়েছে ভারতবাসীর নির্ভেজাল ফিনান্সিয়াল স্ট্যাটাস চোখের নজরে রাখার জন্যেই। এপিক-প্যান-আধার--এর কোনটাতেই নাগরিক পরিচিতিকে সুনিশ্চিত করে নি। কারণ একটাই--আমাদের দেশে নাগরিক চিহ্নিত করণের কাজটাই এখনও পর্যন্ত কোন সরকার করে উঠতে পারে নি। পূর্বতন সরকারগুলো বুঝেছিল এ কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক--সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝেছিল এ দেশে হু-হু করে অনুপ্রবেশ (হিন্দু ও মুসলমান) ঘটতে থাকলেও তাদের তাড়াতে দেবে না রাজনৈতিক দলগুলোই--কারণ এ দেশে শরণার্থীদের  খুব সহজেই ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে নাগরিকত্ব পরিচিতি কাউকেই দেওয়া হয় নি বলেই।
তার মানে এই নয় যে আমরা ভারতের নাগরিক নয়। ভারত ভাগের সময় যারা এ দেশ ছেড়ে কোথাও যায় নি তারা বংশপরম্পরায় এদেশেরই বৈধ নাগরিক। কিন্তু ৪৭-এর পর যে কয়েক কোটি শরণার্থী এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে (রাষ্ট্রীয় সংবিধানের নিয়মে) তারা কেউ  এপিক-প্যান-আধার থাকলেও নাগরিক নয়। ভোটাধিকার আর নাগরিকত্ব কোন দেশেই সমার্থ নয়। কিন্তু এ দেশে গত ৭৩ বছর ধরে চলে আসা এই নাগরিকত্ব বিতর্কের অবসান ঘটাতে কাউকে ভাবনা চিন্তা করতে দেখা যায় নি। এনডিএ সরকার ভাবছে এ ব্যাপারে। পাকিস্তান-বাংলাদেশ-আফগানিস্তান তাদের সংবিধান মোতাবেক ইসলামিক রাষ্ট্র--এবং এই তিন দেশের সঙ্গে অতীত ও ভৌগোলিক সম্পর্ক থাকায় (কিছু আঁতেল যদিও মরিশাস-শ্রীলঙ্কা-নেপাল-ভূটান নিয়েও আবেগে উথলে উঠছেন) এই তিন দেশের ধর্মীয় নিপীড়নে জেড়বার সংখ্যালঘুরা সাগরে ভেলা ভাসিয়ে অন্য কোনও দেশে যাওয়ার কথা না ভেবে এই দেশেই ছুটে আসে। মুসলিম অনুপ্রবেশকারীও কিছু কম আসে নি--কিন্তু তারা কেউ তাদের রাষ্ট্রীয়ধর্ম মুসলিম সংখ্যাধিক্যের অত্যাচারে এ দেশে জান-প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছে এমন দাবি করে নি--আমরা চাই তারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সেই দাবি করে ভারত সরকারের কাছে নাগরিকত্ব প্রার্থনা করুক। তারা তা করবে না। কারণ তারা জানে এদেশে তাদের শুভার্থী কিছু কম নেই--তারাই তাদের জন্যে লড়ে যাবে !
সিএএ’র ধারা-উপধারা নিয়ে আমি আগেই লিখেছি, নতুন করে আর কিছু লেখার নেই--তবে এই আইন যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে তৈরি হয় নি (দেশের যে কোন আইন দেশের আইনসভাতেই সংবিধান নির্দেশিত পথেই তৈরি হয়) সেহেতু সুপ্রিম কোর্টের এ ব্যাপারে কতটা কি করার আছে সেটা আগে দেখতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট যদি এই আইনকে সংবিধানসম্মত আইন বলে মান্যতা দেয় তাহলে বিজেপি বিরোধিতা যতটা মুখ থুবড়ে পড়বে ততটাই গা ঝেড়ে ময়দানে উঠে আসবে বিজেপি--এটা বিজেপি খুব ভাল করেই জানে। সুতরাং যে পথে ও পদ্ধতিতে সিএএ-বিরোধিতা চলছে তাতে সিএএ বা এনআরসি ঠেকানো যাবে বলে আমার অন্ততঃ মনে হচ্ছে না। অসংখ্য জনবিরোধী কাজ করেও বিজেপি’র কিন্তু দুঃসাহস একটুও কমছে না--কেন? বিজেপি বিরোধীদেরই এটা গভীরভাবে ভেবে দেখার কথা হলেও তারা তা ভাবতে রাজি নয়--যা খুশি তাই করতে দেওয়াই বিরোধীদের প্রধান লক্ষ্য মনে হচ্ছে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.