Header Ads

প্রসঙ্গ : এ দেশের গণতন্ত্র, ভাবনা চিন্তা না করেই যা খুশি বলা যায় !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 

এ দেশের গণতন্ত্র মানুষকে কোন কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই যা খুশি বলার অধিকার দিয়েছে। নির্বাচনে ৫০%-এর বেশি ভোট না পেলেও শাসন ক্ষমতায় বসার অনায়াস সুযোগ দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বাসের সুযোগ দিয়েছে যে, এ দেশটা আমেরিকা-জার্মান-বৃটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া-চিন-ইরাণ-ইরাক-তুরস্ক-আরব-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যাণ্ড-ব্রাজিল-স্পেন, এমন কী পাকিস্তান-বাংলাদেশও নয়। 
 
এ দেশের সংখ্যালঘুরা (মুসলিম-খৃষ্টান-জৈন-শিখ-পারসি ইত্যাদি) দাপটের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার শরিক হিসেবে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সমান নাগরিক অধিকার নিয়ে জীবন যাপন করে, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা একটু বেশি সুযোগ ও অধিকার পায়। পাকিস্তান-বাংলাদেশ-আফগানিস্তান-চিন-রাশিয়ার সংখ্যালঘুরা প্রায় ডিটেনশন্ ক্যাম্পের জীবন যাপন করে--তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকের অধিকারও সর্বক্ষেত্রে তাদের জন্যে সুরক্ষিত নয়। তবু রাহুল গান্ধী-সীতারাম ইয়েচুরি-সেলিম মহম্মদরা চিনের উইঘুরের মুসলিম-তিব্বতের বৌদ্ধ-হংকংয়ের স্বাধীনতাকামীদের সম্পর্কে টুঁ-শব্দও করেন না। এঁরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন ইসলামিক রাষ্ট্রে মানবেতর দুঃসহ জীবন যাপনে অক্ষম সংখ্যালঘু, যারা এদেশে জান-প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নে। কেন ইসলামিক রাষ্ট্রে যারা সংখ্যালঘুদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না--এই দাবিতে এদেশের কিছু গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষকে এ দেশের গণতন্ত্র যত্রতত্র আগুন জ্বালিয়ে জাতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত করে আন্দেলনের অধিকার দিয়েছে !
সিএএ, পিএনআর, এনআরসি’কে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করবে কি করবে না তা নিয়ে এখানে কোন বিতর্ক তৈরি আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমি জানি কি হতে চলেছে এবং হবে। এখন সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। এ দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা নিয়ে দু’চার কথা বলতেই এই লেখা !
ক’দিন থেকেই লক্ষ্য করছি--কেউ কেউ আকাশে ঘুঁষি পাকিয়ে বা তর্জনি নাচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন--মনে রাখবেন দেশের ৬২% মানুষ আপনার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে ! তাতে কি হয়েছে এ প্রশ্ন অবশ্য কেউ করছে না--করলে দেশের গণতন্ত্রের চেহারাটা একটু ভদ্রস্থ দেখাতো। এ দেশে কেন্দ্র বা রাজ্যে কবে কখন ক্ষমতাসীন দল বা জোট সরকারের শরিক দলগুলো ৫০%-এর বেশি মানুষের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে তার তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহ করতে মহাফেজখানায় বেশ কয়েক দিন তন্ন তন্ন করে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।
এ দেশের অসংখ্য কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে--জয়ী ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধেই সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু এককভাবে ৫০%-এর অনেক কম ভোট পেয়েও একজনকে এ দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র বিজয়ী বলে ঘোষণা করে দিচ্ছে ! যিনি এ দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের দৌলতে জিতলেন তিনি পরমুহূর্তেই ভুলে গেলেন--সংশ্লিষ্ট এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁর বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছে--তাকে সর্থন জানায় নি। এই ভাবেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই শুধু নয়--কেন্দ্রেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন না পেলেও দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র তাদের ক্ষমতায় বসার সুযোগ দিয়ে চলেছে। কারণ সংবিধান এদেশে যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মান্যতা দিয়েছে তাতে ভোট মেশিনের সংখ্যা নয় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংখ্যাই এক ও একমাত্র বিচার্য
বিষয়। সংবিধানের এই নির্দেশেই সংসদে যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন পায় তারাই সরকার গঠনের অধিকার পায়।
আমেরিকায় এ সুযোগ নেই--কারণ সে দেশে হাজার হাজার রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নেই। শুধু তাই নয় ও দেশের দ্বি-দলীয় গণতন্ত্রে ডেমেক্র্যাটিক বা রিপাব্লিক্যান দল ইচ্ছে করলেই গরু-গাধা-ছাগলকে (সহজেই ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য) প্রার্থী হিসেবে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না। দলের প্রার্থীকে দলীয় স্তরে একেবারে নিচুতলা থেকে শীর্ষে উঠে আসতে হয় দলীয় সদস্যদের ভোটের মধ্য দিয়ে। এ দেশে এই ব্যবস্থা কখনো চালু হবে বলে মনে করার কোনও কারণ এখনও ঘটে নি। রাবণের গুষ্টির মতো অসংখ্য রাজনৈতিক দল যে দেশের গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করতে অভ্যস্ত সে দেশে এসব কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং মোদ্দা ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে, এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন কার পক্ষে থাকল কি থাকল না তা নিয়ে মুর্খের মতো কোন কথাই বলা চলে না। তবু কাউকে কাউকে ‘মাস হিস্টিরিয়া’ তৈরি করার জন্যে মেঠো সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কথা বলতেই হয়। মানুষ হাসাহাসি করলেও !
আমাদের দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রে বেশ কিছু অস্বস্তিকর ফাঁক-ফোকড় রয়েছে। এই ফাঁক-ফোকড়ের কারণেই ঘোড়া-গাধা কেনা বেচার অবাধ সুযোগ থাকায় রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রেও সরকার গঠন নিয়ে যে অসভ্যতা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়--সংবিধান ও গণতন্ত্রের পিণ্ডি চটকানো চলে তা রীতিমতো হতাশা তৈরি করে সাধারণের মধ্যে। কিন্তু তা নিয়ে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের কোন মাথা ব্যথা নেই--যে কোনভাবেই হোক--ক্ষমতা চাই !
এইসব অমার্জিত কাণ্ডকারখানা বন্ধ হতে পারে যদি সংবিধান সংশোধন করে বলা হয় একবার যাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত ঘোষিত করা হবে সে কোন ভাবেই কোন যুক্তিতেই ৫ বছরের মধ্যে দলত্যাগ করতে পারবে না--করলেও সাংসদ-বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করতেই হবে। এখানে কোনরকম সংখ্যার লীলাকেত্তনের সুযোগ রাখা হবে না। এ ব্যবস্থা ত্রিস্তর পঞ্চায়েত-পুরসভার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়--সংসদে বা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেই ৫ বছরের জন্যে ক্ষমতা দিতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও মতপার্থক্য সরিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য মিলেজুলে সরকার গঠনের অপপ্রয়াস (রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-কর্ণাটক-মহারাষ্ট্র-গোয়া-অরুণাচল-মেঘালয়) বন্ধ করা যাবে না এবং ঘোড়া-গাধা বেচাকেনাও বন্ধ করা যাবে না।
এই ব্যবস্থা চালু হলে দেশের রাজনৈতিক চালচিত্রে এত ঘন ঘন কালির ছিটে লাগবে না। ১০-১৫% ভোট পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে ক্ষমতার সুযোগ দেওয়াটাই অত্যন্ত অসঙ্গত পদ্ধতি--যার অবলুপ্তি অবিলম্বে প্রয়োজন হলেও রাজনৈতিক দলগুলোই তা হতে দেবে না। প্রচুর মানুষ ভোট না দিলেও অল্প মানুষের ভোটে জিতে চেয়ারে বসার এই অদ্ভূত অলৌকিক সুযোগ কে আর হাতছাড়া করতে চাইবে ! তাই যখন কাউকে তর্জনি নাচিয়ে হুঙ্কার দিতে শুনি--আপনার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নেই--সাবধানে কথা বলবেন, তখন জনমনে যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তা জনমোহিনী দলগুলো কল্পনাই করতে পারে না।
সংসদে বা বিধানসভায় সদস্যদের সংখ্যার হিসেবই যেখানে শেষ কথা এবং সংবিধান যাকে চূড়ান্ত মান্যতা দেয় সেখানে ময়দানি সমর্থনের সংখ্যার হিসেব তুলে লোক হাসানো ছাড়া আর কোন লাভ হয় বলে তো মনে হয় না ! হুঙ্কার তখনই মূল্য পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে যখন সংখ্যাধিক্যে সংসদে বা বিধানসভায় এগিয়ে থাকার যোগ্যতা তৈরি হয়। এর উল্টোটাই এ দেশের সাংবিধানিক বিধি ও গণতান্ত্রিক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.