Header Ads

প্রসঙ্গ : এনকাউন্টার বিতর্ক !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

চিতায় যখন কোন শবদেহ লেলিহান আগুনে পুড়তে থাকে তখন সেই জ্বলন্ত শরীর থেকে নানা ধরণের শব্দ কানে বড় বাজে ! প্রিয় শরীর ধীরে ধীরে পুড়ে ছাই হতে থাকা ব্যাপারটা অনেকেই সহ্য করতে পারে না--কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরিণতিটা মানুষ কষ্ট হলেও মেনে নেয়। কিন্তু জীবন্ত একটা শরীর যখন আগুনে পুড়তে থাকার কিংবা জ্বলন্ত অবস্থাতেই বাঁচার চেষ্টায় প্রাণপণে ছুটতে থাকার ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পিত ভাবে তৈরি দৃশ্যটার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তার বিশদ ব্যাখ্যার নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই। আগুনে পুড়িয়ে মারার আগে ধর্ষণের ব্যাপারটাও  মাথায় রাখতে হবে। কিল-চড়-ঘুঁষি ও মাথার চুলের গোছা উপড়ে নেওয়া ছাড়াও দু’পা চিড়ে ফেলার মতো ঘটনাগুলোর মধ্যে যারা মানবিকতা বা মানবাধিকার অনুসন্ধান করেন আমি তাদের সকলকেই ধর্ষক ও খুনি বলে মনে করি। আমি মনে করি, মানবাধিকার তাদের জন্যেই সুরক্ষিত থাকা উচিত যারা জীবন যাপনে মানবিক। দুর্ভাগ্যবশতঃ সব মানব মানবিক হয় না। অমানবিকতার মাত্রাভেদে তাদের জন্যে বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা থাকে সভ্য সমাজে।

ভারতবর্ষও নিঃসন্দেহে সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ এবং এদেশের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তো বটেই ! তবু সেই সামাজিক ও পারবিারিক বন্ধনের মধ্যে বেড়ে ওঠা কেউ কেউ ভয়ঙ্কর রকমের অসামাজিক ও অমানবিক কাজকর্ম করে থাকে বেশ ঠাণ্ডা মাথায়। তাদের অমানবিক কাজকর্মের কারণ সম্পর্কে রীতিমতো যুৎসই ব্যাখ্যাও দিয়ে থাকেন সমাজতাত্ত্বিক বিজ্ঞরা। তারাই বলেন--দোষ তাদের নয় দোষ সামাজিক অবক্ষয়ের মূল্যহীনতার এবং শিক্ষার অভাবের ! বিজ্ঞরা এমনভাবে ব্যাখ্যা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন তাঁরা কেউ এই সমাজের অংশ নন--তাঁদের কিছুই করণীয় নেই শুধু লেকচার মারা ছাড়া ! মানবেতর হিংস্র ক্ষ্যাপা যৌনলালসা কাতর ধর্ষক খুনিদেরও মানবাধিকার নিয়ে গলা ফাটান শুধুমাত্র তাদের শরীরগুলো মানুষের মতো দেখতে বলে ! 

তাদের সুবিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার দাবিতে তাঁরা সোচ্চার হন ! বিচার ব্যবস্থার পক্ষে আমার ব্যক্তিগত অবস্থানও যথেষ্ট দৃঢ়। একইসঙ্গে আমি এদেশের বিচারক-উকিলদের কর্মপদ্ধতির  ওপর আস্থাশীল নই। কারণ, এদেশে বিচার ব্যবস্থার সিংহভাগই রাজনীতির কালোবাজারীদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তাই অন্যান্য দেশে যেখানে ধর্ষণ-খুন-সন্ত্রাসের বিচার ব্যবস্থার গতি দিনে হাজার কিলোমিটার সেখানে আমাদের দেশে তার গতি দিনে এক মিটারের চেয়েও কম। প্রতিটি আদালতে জমে থাকছে মামলার হিমালয় পর্বত ! কোনও হেলদোল নেই কোথাও।
বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি হায়দ্রাবাদ এনকাউন্টারের বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন আমি তা অযৌক্তিক মনে করি না বটে তবে একেবারেই অর্থহীন মনে করি। অন্য রাজ্য ছেড়ে দিয়ে শুধু বাংলার কথাই যদি ধরি তাহলে কামদুনি, কাটোয়া, মেদিনীপুর, মালদহ, বক্সিরহাট, ধূপগুড়ি, কুমারগ্রাম সহ অসংখ্য নৃশংস ধর্ষণ-খুনের দ্রুত বিচার হয়েছে কি? এখনও বিলম্বিতলয়ে বিচারের নামে নির্লজ্জ কালহরণের খেলাই চলছে। আদালত সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবি ও আইনবিশারদরা সব সময়েই  বিচার ব্যবস্থার সুমহান পদ্ধতির প্রতি প্রবল আস্থাজ্ঞাপক বক্তব্য রাখবেন-ই--সেটাই স্বাভাবিক। তা সে ধর্ষণ ও খুনের বীভৎসতা যত অমানবিক ও ভয়ঙ্কর হোক না কেন ! আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা বহু ব্যবহারজীবিকে যথেষ্ট পরিমাণে রোজগারের সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর এই ধরণের তীব্র মানবিকতা বিরোধী ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানার সিংহভাগই নিজেদের হাতে তুলে নেয়  রাজনীতির কালোবাজারীরা। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে বিচার ও পুলিশ প্রশাসনকে--চার্জশিটে কার কার নাম থাকবে কার কার থাকবে না, কাকে সহজেই জামিন দিয়ে বাইরে বের করে এনে অভিযোগকারীদের হাড় হিম করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে --এ সবই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং এই জঘন্য পচাগলা সিস্টেমের দোহাই পেড়ে সুবিচারের আশায় থাকার কথা এদেশের স্ত্রী-কন্যা হারানো মা-বাবারা-ই শুধু নয় ছোট ছোট মেয়েরাও ভাবছে না। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাতে। রাজনৈতিক কালোবাজারী ও তাদের পাদুকা চাটা বশংবদদের মন্তব্য নিয়ে আমার কিছু বলার রুচি ও ইচ্ছে নেই।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই পুলিশের ‘এনকাউন্টার যাত্রাপালা’য় খুন হয়েছে এমন নকশাল-কেএলও’র সংখ্যাটাও কিন্তু যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে করা উচিত মানবাধিকার সংগ্রামীদের পক্ষে। ঘটনাগুলোর বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না--কমবেশি সকলেই জানেন। শোকে উথলে ওঠার নাটকীয় নাচন-কোঁদন ক্ষেত্রবিশেষেই যে বাড়াবাড়ি রকমের প্রকট হয়ে ওঠে তার দৃষ্টান্তও কম নেই। চিন-রাশিয়া প্রজাতির এদেশের আঁতেল রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিরা কি জানেন--ঐ দুই দেশের এনকাউন্টারের অসংখ্য ইতিহাস এবং তার পেছনের কারণগুলো? জানা না থাকলে এই দুইদেশের সঙ্গে আমেরিকা সহ আরবদুনিয়ার বেশ কিছু দেশের এনকাউন্টারের ইতিহাসের পাঠও নিয়ে নিতে পারেন--নেওয়া উচিতও। ঐসব দেশে ধর্ষক-খুনিদের কতদিন বিচার ব্যবস্থার মধ্যে জামাই আদরে পুষে জনতার রক্ত জল করা পয়সার শ্রাদ্ধ করে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয় সে ব্যাপারেও তাদের খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
হায়দ্রাবাদ এনকাউন্টারের ঘটনার পর রাজ্যে রাজ্যে, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেল তা মানবাধিকার কর্মীদের চোখ-কানকে অসুস্থ করে তুলতে পারে হয়তো--কিন্তু তাতে মেয়েদের উচ্ছ্বাস থামানো যাবে না। যে মেয়েটি ধর্ষিতা হল খুন হল--প্রকৃত পক্ষে সে একা শেষ হয়ে গেল না--সুমহান বিচার ব্যবস্থার অন্তর্জলিযাত্রার সঙ্গী হয়ে তাদের পরিবারও প্রতিদিন ঘর-আদালতের যাতয়াতের পথে মানসিক ধর্ষণ ও নির্য্যাতনের শিকার হল ! এত অমানবিক চাপ নেবার ক্ষমতা সকলের থাকে না। তারা দ্রুত শাস্তি চাইবেই--দেশ-আদালত-প্রশাসন যদি তা দিতে না পারে তাহলে সংবিধান-গণতন্ত্র-মানবাধিকারের বুলি কপচানোর কোনও অর্থই থাকে না ! যে দেশের আদালতকে পুলিশের পেশ করা চার্জশিটের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় সেই দেশের পুলিশের বক্তব্যকে অবিশ্বাস করার কোন সুযোগ থাকে কি? বিশেষ করে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এনকাউন্টার যখন পুলিশের অধিকারের মধ্যে পড়ে তখন কে কিভাবে প্রমাণ পেশ করবে যে পুলিশ মিথ্যে নাটক সাজিয়েছে? পুলিশের পেছনে যদি রাজনীতির কোলোবাজারীরা থাকে তাহলে তো আর কোন কথাই থাকে না ! এদেশের ক্ষাপা ষাঁড়-বাবাদের হাজতে রেখে (এনকাউন্টার না করে) তাদের সেবা করার নিয়মটা দেখেও কি বিশ্বাস করা সম্ভব এ দেশের বিচার ব্যবস্থা সরকার ও প্রশাসন নির্য্যাতিতা ও তার পরিবারের প্রতি মানবিক ও সংবেদনশীল হবে?
এনকাউন্টারের ঘটনা একই সঙ্গে কাম্য না হলেও ধর্ষক-খুনিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ হিসেবে তাই সর্বজন প্রশংসিত হয়ে উঠল।
নরপিশাচদের চরিত্র সংশোধন করার মতো উপযুক্ত বিচার ব্যবস্থা
ও সংশোধনাগার এদেশে এখনও গড়ে ওঠে নি--মানুন আর না-ই মানুন !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.