Header Ads

অজন্তা নেওগ কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধাচারণ করে বাঙালিদের অপমান করলেন



চিত্তরঞ্জন পাল, সাধারণ সম্পাদক,  অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি

"পাঁচ লক্ষ হিন্দু বাঙালি নাগরিকত্ব পেলে কুড়ি বছরে বেড়ে হবে ৪০-৫০ লক্ষ৷ হিন্দু বাঙালিদের জন্মের হার অতি ক্ষীপ্র৷" প্রাক্তনমন্ত্রী অজন্তা নেওগের এমন মন্তব্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী, প্রয়াত রাজীব গান্ধী, ডঃ মনমোহন সিঙকে অপমান করা হয়েছে৷ বিভাজিত দেশের স্বাধীনতার পর পণ্ডিত নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদানের জাতীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ এমন কী, পণ্ডিত নেহরু লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, "যদি দেশের প্রচলিত আইন সংখ্যালঘু হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ওই আইনটিকেই বদলে দিতে হবে৷" ফলস্বরূপে, তিনি হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের স্বার্থে "ইমিগ্র্যান্টস (এক্সপালশন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট,১৯৫০ প্রনয়ন করেন৷ এই আইনের ২(খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্মীয় নির্যাতনের বলি হয়ে আগত ছিন্নমূল বাঙালিরা নাগরিকত্ব পাবেন৷ বর্তমানেও এই আইনটি অসমে প্রচলিত রয়েছে৷ যদিও হিন্দু বাঙালিরা নাগরিকত্বের প্রশ্নে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ওদিকে, অসম আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী আইএমডিটি আইন, ১৯৮৩ প্রনয়ন করার পাশাপাশি ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ "ইন্দিরা-মুজিব" চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন৷ বলাবাহুল্য, ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রয়াত রাজীব গান্ধী ১৯৮৭ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেন৷ সংশোধিত এই আইন অনুসারে ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাই পর্যন্ত ভারতে জন্ম গ্রহণ করা সন্তান সন্ততিরা ভারতীয় নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবে৷ এছাড়া, ২০০৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর বিরোধী দলপতি ডঃ মনমোহন সিঙ রাজ্যসভায় উপ প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত৷ কারণ, তাঁরা ভারতের বিশ্বস্ত নাগরিক৷ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়মানুসারে মানবীয় কারণে তাঁদের খাদ্য,বস্ত্র,স্বাস্থ্য,শিক্ষা ইত্যাদি দেওয়া উচিত৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ১০ই মার্চ লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিঙ ১৯৭১ সালের পর আগত হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব প্রদান করার আশ্বাস দেন৷ অন্যদিকে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ২০১৪ সালের ১৬ই জুলাই ও ২০১৫ সালের ১৮ই আগষ্ট দুবার ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আসা হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন৷ ওদিকে, তরুণ গগৈ ২০১২ সালের ২০শে এপ্রিল হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব সম্পর্কে কেন্দ্রকে এক চিঠি দেওয়ার প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৯শে জুলাই দুই রাষ্ট্রের সচিব পর্যায়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ বৈঠকে ইন্দিরা মুজিব চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে পুনরীক্ষণ করা হয়েছে৷ পণ্ডিত নেহরু থেকে ডঃ মনমোহন সিঙের কার্যকাল পর্যন্ত রাষ্ট্র নায়কেরা হিন্দু বাঙালি শরণার্থী সম্পর্কীয় স্থিতির বিপরীতে গিয়ে অজন্তা নেওগ প্রকারান্তরে নেহরু পরিবারকেই অপমান করেছেন৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির কী ভূমিকা ছিলো, সে সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ এই নেত্রী আক্রোশমূলক ভাবে বাঙালি জাতিকে টার্গেট করেছেন৷ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলে আট জন সভাপতি হিন্দু বাঙালি ছিলেন৷ তারমধ্যে উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (দুবার), সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়(দুবার), আনন্দমোহন বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্রবসু (দুবার) আরও কয়েকজন বাঙালি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন৷ ১৯১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "জন গন মন অধিনায়ক" গীতটি প্রথম পরিবেশন করা হয়েছিলো৷ কংগ্রেস দল কোনো আঞ্চলিকতাবাদী চিন্তা ধারনার মঞ্চ নয়৷ ভারতের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীরও স্বার্থ সুরক্ষিত করার এক বৃহৎ দল৷ হাইকমাণ্ডকে চিত্তরঞ্জন পাল এ সম্পর্কে বিশদভাবে জানাবেন বলে এই প্রতিবেদক কে জানিয়েছেন৷ ধর্ম নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারনার পরকাষ্ঠা প্রাক্তনমন্ত্রী অজন্তা নেওগ বলেছেন, ১৯৬১ সালে ছ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ২০১১ সালে ৯০ লক্ষ বাংলাভাষী হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন পাল তাঁর এই অদ্ভূত যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, ১৯৫০ সালে রাজ্য পুনর্গঠনের সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলিমেরা অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করার দরুনই অসমিয়াভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ১৯৩১ সালের জনগননা অনুসারে বৃহত্তর অসমের সুরমা উপত্যকায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিলো ২৮,৪৮,৪৫৪ জন, অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ছিলো ৩,৬৯২ জন৷ বিপরীতে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিলো ১১,০৫,৫৮১ জন, অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ছিলো ১৯,৭৬,৮২৩ জন৷ অসমের মোট জনসংখ্যার বাংলাভাষী ৩৯,৬০,৭১২ জন, অসমিয়াভাষী ১৯,৯২,৮৪৬ জন ও উপজাতি ছিলেন ১২,৫৩,৫১৫ জন৷ ওদিকে, ১৯০১ সালে অসমে মোট অসমিয়াভাষী ছিলেন মাত্র ২২ শতাংশ, ১৯১১ সালে ২১.৭ শতাংশ, ১৯২১ সালে ২১.৬ শতাংশ, ১৯৩১ সালে ২১.৬ শতাংশ৷ ১৯৫০ সালে মুসলিমেরা অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করার দরুন ১৯৫১ সালের জনগননায় অসমিয়াভাষীর সংখ্যা হয়েছিলো ৫৬.৭ শতাংশ৷ অসমিয়া ভাষা গ্রহণের পরও ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি নেলী গনহত্যা সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিচলিত হয়ে ওঠেন! নানাভাবে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত অনুভব করে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালের জনগননায় ধীরে ধীরে বাংলাভাষীর পরিচয় দিতে শুরু করেন৷ গতবছর এক সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন যে বরপেটা জেলায় সত্তর শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার বিপরীতে হিন্দু মাত্র ত্রিশ শতাংশ৷ তারমধ্যে হিন্দু বাঙালি সর্বাধিক পনেরো শতাংশ৷ অথচ ২০১১ সালের জনগননায় বরপেটা জেলার বাংলাভাষীর সংখ্যা আটচল্লিশ শতাংশ৷ সেক্ষেত্রে, মুসলিমের একটা অংশ যে বাংলা মাতৃভাষার পরিচয় দিয়েছেন, তা নিশ্চিত৷ পূর্বের অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ছিলো ৫৬.৭ শতাংশ, যা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৩২ শতাংশে৷ বিপরীতে, বাংলাভাষীর সংখ্যা হয়েছে ২৮.৯২ শতাংশ৷ হিমন্তের অনুমান, বর্তমানে বর্ণহিন্দু অসমিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পঁচিশ শতাংশ৷ অজন্তা নেওগ এই জনবিন্যাস পরিবর্তনের সমস্ত দোষ হিন্দু বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন৷ বলাবাহুল্য, স্যার আশুতোষ মুখার্জি ১৯১৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন কমিটির সর্বভারতীয় চেয়ারম্যান হওয়ার পর মাত্র ২১ শতাংশ অসমিয়াভাষী হওয়া সত্ত্বেও ১৯১৭ সালে বৃহত্তর অসমকে অসমিয়াভাষী রাজ্যের স্বীকৃতি দিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ ওদিকে, অসমে ১৯০১-১১ সালে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিলো ১৪.৬ শতাংশ, ১৯১১-২১ সালে ১২.৮ শতাংশ, ১৯২১-৩১ সালে ১৫.৭ শতাংশ, ১৯২১-৩১ সালে ১৫.৬ শতাংশ, ১৯৩১-৪১ সালে ১৫ শতাংশ, ১৯৪১-৫১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ১৫ শতাংশ৷ ১৯৬০ ও ১৯৭২ সালের ভাষা দাঙ্গার মতো আবারও একটি দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চাইছেন অজন্তা নেওগ, এমন অভিযোগ তুলে চিত্তরঞ্জন পাল আরও বলেন, ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বাঙালির অনুপ্রবেশ ঘটে নি অসমে৷ এ সম্পর্কে লোকসভার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ আগষ্ট সাংসদ রবীন কাকতির এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী লোকসভায় জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসম,ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে যেসব হিন্দু শরণার্থীরা এসেছিলেন, তাঁদের ইতিমধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ এমন কী আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের ঘরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদেরও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ এছাড়া, ১৯৭০ সালের ১৬ই এপ্রিল সাংসদ হিম্মতশিঙ্কার প্রশ্নের উত্তরে পুনর্বাসন মন্ত্রী লোকসভায় জানান, ১৯৭০ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ২,২২০ জন শরণার্থী অসমে এসেছেন৷ ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সাংসদ বিশ্বনারায়ন শাস্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে পুনর্বাসন মন্ত্রী জানান, ১৯৬৪ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২০০০ শরণার্থী অসমে এসেছিলেন৷ হিন্দু বাংলাদেশীর আগ্রাসন বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, আসলে তা চায়ের কাপে ঝড় তোলার সামিল৷

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.