Header Ads

অথ রাজ্যপাল কথা ও বাংলা সংষ্কৃতি প্রসঙ্গ !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভাল--আমি এ প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণ রাজনীতি ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রদর্শনের স্টাইল অধিকার এবং যোগ্যতা নিয়ে কোনও বিতর্কে যাব না। কারণ, আমি এবং আমার মতো আরও অনেকেই বিশ্বাস করেন, ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা-সংষ্কার-সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যেই প্রতিফলিত হয় তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের শিক্ষা-দীক্ষা-রুচি-প্রবৃত্তি-আচরণ ও সংস্কারের প্রকৃত চেহারাটা। চোখের সামনেই সকলের যা দেখার দেখছে ও যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে। প্রয়াত অত্যন্ত প্রভাবশালী সিপিএম কর্তা অনিল বিশ্বাসের সময়েই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাম ও উগ্রবামেদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে--তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-সংবিধান-স্বশাসনের প্রবক্তার ভূমিকা আজও প্রবল প্রতাপের সঙ্গেই পালন করে চলেছে।

 ছাত্রপরিষদ পারে নি, কংগ্রেসের শিক্ষক সংগঠন পারে নি, প্রবল দাপটের সঙ্গে গোটা রাজ্যটাকে তালুবন্দি করে তৃণমূল শিক্ষক সংগঠন বা তণমূল ছাত্র পরিষদও এখানে তাদের ন্যূনতম প্রভাব তৈরি করতে পারে নি। কিন্তু বিজেপি’র ছাত্র সংগঠন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধ জলাশয়ে মাঝে মাঝে ঢিল ছোঁড়ার সাহস  দেখাতেই তীব্র চাঞ্চল্য তৈরি হচ্ছে--যা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য তথা রাজ্য পালের পদার্পণে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। তৃণমূল ছাত্রসংগঠন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদকে কব্জা করতে না পারলেও অশিক্ষক সংগঠনে যে প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে তা গতকালের তথাকথিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বয়ং আচােের্য্যর আসন শূন্য রেখে এবং তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে না দিয়ে আটকে রাখার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে বা ঘটে চলেছে তা কতটা ভাল বা মন্দ তা নিয়েও আমার কোন বক্তব্য নেই।
আমি শুধু অবাক হচ্ছি মাননীয় রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে দেখে। এ রাজ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি এবং সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে এসেছেন। তিনি তাঁর সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিতভাবেই সচেতন--কারণ, তিনি একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবি ও প্রাক্তন বিধায়ক-সাংসদ ও মন্ত্রীও বটে ! তিনি অবশ্যই জানেন কোন্ পরিস্থিতিতে তাঁকে কোন্ সাংবিধানিক পদক্ষেপ নিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে এর আগে বহু রাজ্যপাল এসেছেন--তাদের মধ্যে অনেকেই এ রাজ্যে গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে চিহ্নিতও হয়েছেন। অনেকে রীতিমতো বিতর্কিতও হয়েছেন, কিন্তু বর্তমান রাজ্যপালের মতো কাউকে ‘কেঁদে মান যেচে সোহাগ’-এর রাজনীতিতে তলিয়ে যেতে আমি অন্ততঃ দেখি নি ! তাঁর কোনও দাবি রাজ্য সরকার মানছে না, তাঁকে সাংবিধানিক প্রধানের সম্মান কেউ দিচ্ছে না--দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরাও যা খুশি মন্তব্য করে যাচ্ছেন--তাঁর মান-সম্মান প্রতি মুহূর্তে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে প্রতিদিন তিনি গুচ্ছ গুচ্ছ টুইট করছেন। টুইটের মাধ্যমে তিনি কার বা কাদের কাছে বিচার চাইছেন? তাঁর এই টুইটি ক্ষোভ প্রকাশের কোনও প্রতিক্রিয়া কি রাজ্যসরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে? লোকে হাসাহাসি করতে শুরু করেছে। এসব বালকোচিত কাজ না করে তিনি তাঁর সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্বগুলো খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেই পারেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে এ রাজ্যের সাংবিধান হেনস্থার ঘটনাগুলি জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করতে পারেন। তাঁর যদি সত্যিই মনে হয় কেন্দ্র ও  রাজ্যের যুগ্মতালিকাবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রাজ্য একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করে দিয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনকে তুলে দিয়ে পুরোপুরি রাজ্যসরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে--আচার্য্য’র আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে--আচার্য্যকে পাত্তা না দিয়ে রাজ্যসরকার সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে তাহলে তিনি তাঁর অভিযোগ তথ্য-প্রমাণ সহ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকে জানাচ্ছেন না কেন? আইন-শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাজ্যপালের  ভূমিকাকে পাত্তা না দেওয়ার অভিযোগ টুইট না করে তিনি রাষ্ট্রপতি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাচ্ছেন না কেন? সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাঁর চেয়ার শূন্য রেখে তাঁকে বাইরে আটকে রেখে উপাচার্য্য যে সমাবর্তন করলেন এবং ডিগ্রীপ্রদানের মঞ্চে রাজনৈতিক প্রহসনকে অনুমোদন করলেন তার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি শিক্ষা মন্ত্রকে বা আদালতে অভিযোগ না করে কান্নাকাটি শুরু করলেন কেন? এতে কি তাঁর মানসম্মান বাড়ছে--ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে?
অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ততটা না চাইলেও তাঁর বশংবদদের একাংশ চাইছে--রাজ্যপালকে সাংবিধানিক প্রধানের মান্যতা না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকেই সেই মান্যতা দেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য রাজ্যপাল কেন হবেন? কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য যেমন প্রধানমন্ত্রী, ঠিক তেমনই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য্য মুখ্যমন্ত্রী হবেন না কেন? সমাবর্তনে বা স্বশাসনে তিনি কেন মুখ্য হবেন না? শিক্ষা যেহেতু যুগ্মতালিকার বিষয়--তাই রাজ্যপালের হাতে কিছু ক্ষমতা  দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব না মানলে--ধীরে ধীরে সবকিছু রাজ্যের হাতে তুলে নিলে কে বাধা দিচ্ছে? সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্যদের জবাবদিহির জায়গা আচার্য্য’র চেম্বারে আর থাকল না--নিয়ে যাওয়া হল রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর চেম্বারে ! মুখ্যমন্ত্রী না চাইলে এই আইন তৈরি হতে পারে? মুখ্যমন্ত্রী না চাইলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীসংগঠন রাজ্যপাল তথা আচার্য্যকে বাইরে দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে আচার্য্য’র আসন শূন্য রেখে উপাচার্য্য সমাবর্তন অনুষ্ঠানের পুরোহিত সাজার সাহস ও ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন? আচার্য্য যদি আইনের পথে যান তাহলে সুখরঞ্জনবাবু পারবেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ডিগ্রীকে সর্বভারতীয় বৈধতা দিতে? ভাবতে হবে না--মোদ্দা ব্যাপারটা কি হচ্ছে?
মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী হিসেবে মাস-হিস্ট্রিয়া যেভাবে এখনও তৈরি করতে পারেন তা কাঁসর-ঘন্টা--শঙ্খধ্বনি সহ বুলেট গতিতে তাঁর পদযাত্রায় সামিল মানুষের ব্যাপকতা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না। আমার মতো বেশ কিছু আহাম্মক তাঁর এই বিরোধী নেত্রী ভাবমূর্তিতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে কোনরকম চিন্তাভাবনা না করেই তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন করে এসেছি। এখন সত্যি সত্যি ভাবতে হচ্ছে প্রশাসক হিসেবে তিনি তাঁর বিরোধী নেত্রীর ইমেজকে টপকাতে পেরেছেন কি? আদৌ কি পারবেন? পারলে এ রাজ্যের রাজ্যপালকে কেন এত কান্নাকাটি করতে হয়--কেন তাঁকে নির্বাক্ করে সাংগঠনিক দিক থেকে প্রায় জিরো লেভেলে থাকা বিজেপি এক-আধটা নয়--১৮ টি আসন ছিনিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়? কেন তাঁকে নিজের ওপর ভরসা হারিয়ে কর্পোরেট ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের কাছে ভোটে জেতার কলা-কৌশল শিখতে হয়? সাংবিধানিক ডিগনিটি এবং পদমর্য্যাদা খোলাখুলি কেন প্রহসনের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে বা উঠছে ভাবতে হবে না?

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.