রাজ্য রাজনীতিতে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ
রাজ্য রাজনীতিতে এনআরসি প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আজ সংসদে কোন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্তব্যের বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে নিতে হচ্ছে। অমিত শাহ বলেছেন---১) এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এক জিনিষ নয়। দুটি সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। ২) পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে যারা অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, ইসাই, পারসি ধর্মাবলম্বী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের আবেদনের ভিত্তিতে সকলকেই ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ৩) অসমে ফের এনআরসি করা হবে। ৪) সারা দেশেই এনআরসি করা হবে এবং তা ধর্ম নির্বিশেষেই করা হবে--তবে তা নিয়ে কোন ব্যক্তি বা বিশেষ ধর্মের মানুষকে ভয় পেতে হবে না।
কি থাকতে চলেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে তাতে এখন একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। অসমের ধাঁচে অতি তৎপরতা না দেখিয়ে আগে সংশোধনী বিলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধন আনতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার---
১) ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান-বাংলাদেশ-আফগানিস্তান থেকে যে সব হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-ইসাই-পারসি জনগোষ্ঠী ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তারা চাইলে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবে এবং তাদের আবেদনের ভিত্তিতে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
২) ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পাশাপাশি ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন ও ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স আইনেও সংশোধন প্রস্তাব আনা হচ্ছে।
৩) যারা বেআইনিভাবে এদেশে বসবাস করছে অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বিগত বছরগুলিতে এদেশে চলে আসা বাঙালি হিন্দুদের এই বিলটি পাশ হযে গেলে আর বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তকমা দেওয়া হবে না।
৪) বাঙালি হিন্দু অনুপ্রবেশকারীরা যাতে অযথা আতঙ্কিত না হন তার জন্যে এনআরসি’র আগে নাগরিকত্ব বিল সংশোধনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এই সংশোধনী বিল পাশ করানোর লক্ষ্যে মোদী সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চাইছে।
৫) ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিল অনুযায়ী কোনও বিদেশী যদি ভারতের নাগরিকত্বের আবেদন করে তা হলে তাকে আবেদনের আগে একটানা ১১ মাস ভারতে বসবাস করতে হবে এবং সব মিলিয়ে ১১ বছর ভারতে বসবাস করতে হবে। কিন্তু সংশোধনী বিলে সেই সময়সীমা কমিয়ে ৬ বছর করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে--অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরকেই নির্দিষ্ট সময়সীমা হিসেবে ধরা হচ্ছে !
এই নাগরিকত্ব বিল পাশ হয়ে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর আসা অনুপ্রবেশকারী ছাড়া কোন হিন্দু বাঙালিকেই নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্কে ভুগতে হবে না ! অসমে এই বিষয়টা স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি খেদাও-সর্বস্ব রাজনৈতিক কুশীলবদের বাড়া ভাতে যে ছাই পড়তে চলেছে সেটা উপলব্ধি করেই সেখানে সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠছে। সে যাই হোক, অসমের কথা থাক--বাংলায় এই বিলের অভিঘাত কি হতে চলেছে সেটা একবার ভেবে দেখা যেতে পারে।
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলার ১৮ আসন ছিনিয়ে নিয়ে রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে। তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি বিজেপি এই রাজ্যে তৃণমূলকে এইভাবে আঘাত হানার ক্ষমতায় উঠে আসতে পারবে কোন দিন। প্রাথমিক বিস্ময়াহতের শোক এখনও যে সামলে ওঠা সম্ভব হয় নি তৃণমূলের পক্ষে সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে জেলায় জেলায় তাদের সাংগঠনিক দিশেহারা ভাব লক্ষ্য করলেই। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ছারখার হয়ে যাওয়া সংগঠনকে কর্পোরেট কৌশলীর হাতে তুলে দেওয়ার ফলে কাল হরণের এবং শিথিলতার যে ছবি উঠে আসছে তাতে ভবিষ্যৎ খুব সুখের বলে আমার অন্ততঃ মনে হচ্ছে না।
পাশাপাশি এটাও ঠিক--লোকসভা নির্বাচনের পরে প্রচুর অক্সিজেন গিলেও বিজেপি তৃণমূলের সন্দেহাতীত প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসার যোগ্যতা প্রমাণে রীতিমতো এখনও ব্যর্থই হয়ে চলেছে বলা যেতে পারে। কারণটা খুবই স্পষ্ট--নিচু তলা থেকে প্রদেশ স্তরে চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি আওড়ানো বেশ কিছু নেতা থাকলেও ‘‘মাথা’’ নেই তেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। বেশ কিছু পঞ্চায়েত ও পুরসভা দখলের ধাষ্টামো সর্বস্ব যাত্রাপালায় মানুষ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিরক্ত বোধ করছে। এর ওপর এনআরসি নিয়ে কিছু মেধাহীন প্রগলভতা বিজেপিকে এক ধাক্কায় অনেকটা পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এনআরসি বিরোধিতায় তৃণমূল যেভাবে বাজার গরম তুলতে পেরেছে তাতে বিজেপি যে সাংগঠনিক দিক থেকেও বেশ কিছুটা দিশেহারা হযে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এইরকম একটা পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-ই বিজেপিকে অনেকটাই পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করে তুলতে পারে। উদ্বাস্তু বা অনুপ্রবেশকারী বাঙালি হিন্দু--যারা ইতিমধ্যে এনআরসি আতঙ্কে বেশ খানিকটা গুটিয়ে গিয়েছিল তারা আতঙ্কমুক্ত হয়ে ফের বিজেপিমুখী হতেই পারে। কিন্তু বিজেপি তাদের কতটা কিভাবে ব্যবহার করতে পারবে তার ওপর তাদের এই রাজ্যে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।
নাগরিকত্ব বিল পাশ হয়ে যাওয়ায় এনআরসি ইস্যু হাত থেকে বেরিয়ে গেলে তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই পড়ে যাবে বিপাকে। এনআরসি’র আতঙ্কই যদি মানুষকে ভীত স্বন্ত্রস্ত না করে তাহলে বিজেপি বিরোধিতার বড় অস্ত্রটাই ভোঁতা হয়ে যাবে।
তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধীদের হাতে তখন এই ইস্যুতে একটাই যুক্তি থাকবে--ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতা। সেখানেও একটা অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। বিজেপি নতুন উদ্যোমে বিশেষ করে মমতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের পক্ষে তাঁর অবস্থানকে তুলে ধরে মানুষকে বোঝাতে চাইবে তিনি যতটা না হিন্দুদের পক্ষে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যালঘুদের পক্ষে ! বিল পাশের মুহূর্তে সংসদে তৃণমূলের ভূমিকা যদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তোলার সময়ের মতো হয়--অর্থাৎ বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে ওয়াক-আউট করে তাহলে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। সংখ্যালঘুরা মনে করবে--দিদি ঘুরিয়ে মোদীকে সমর্থন করলেন ! আবার যদি তৃণমূল বিলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোটাভুটিতে অংশ নিয়ে ভোট দেয় তাহলে এনআরসি অতঙ্কে ভুগতে থাকা হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বিধানসভা নির্বাচনে।
এমনিতেই বেশ কিছুটা দেরিতে হলেও মমতা বুঝতে পেরেছেন--ভিন রাজ্যের সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতাদের কেউ কেউ এই রাজ্যে সংখ্যালঘুদের তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে চলেছে--তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত লোকসভা নির্বাচনে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। ফলে এই এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের রাজনৈতিক প্রভাব কিন্তু মারাত্মক হতে চলেছে রাজ্যের আগামী নির্বাচনগুলিতে ! এখন কে কিভাবে এই অতি সংবেদসশীল ইস্যুটিকে হ্যাণ্ডেল করতে পারে সেটাই দেখার !









কোন মন্তব্য নেই