Header Ads

মহারাষ্ট্রে সময় ও প্রয়োজনের স্বার্থে বদলে গেল রাজনীতির নৈতিকতা !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ

প্রথমেই একটা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে চাই--মহারাষ্ট্রের ‘‘মহা বিকাশ আঘাড়ি’’ সরকার খুব বেশি হলে ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই ভেঙে যাবে। কেন যাবে সবিস্তারে সে কথায় পরে আসছি। তার আগে এ দেশের রাজনৈতিক নৈতিকতা সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নিতে হবে।



অনেকেরই হয়তো স্মরণ নেই (এ প্রজন্মের তরুণ রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের অনেকেই জানেন না)--আজকের শিব সেনা বলতে গেলে কংগ্রেসেরই মানস-সংগঠন। হ্যাঁ, খুব অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। মহারাষ্ট্রের প্রাদেশিক তথা আঞ্চলিক ভাবাবেগকে নিজেদের পাশে রাখার জন্য কংগ্রেস তৈরি করেছিল ‘‘বসন্ত সেনা’’ নামে একটা সংগঠন--কালক্রমে সেটাই রূপান্তরিত হয় শিব সেনা নামে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনে--যার ভিত্তি হল উগ্র হিন্দুত্ববাদ--বাল ঠাকরে থেকে উদ্ধব ঠাকরের গেরুয়া রঙ গেরুয়া পোষাকপ্রীতির কথা সবাই জানেন !
বসন্ত সেনা থেকে শিব সেনায় পরিবর্তিত কংগ্রেসের তৈরি সংগঠনটি উঠে আসে ঠাকরে পরিবারের হাতে--বাল ঠাকরে হন সর্বময় কর্তা। বাল ঠাকরের হৃদয়ে ছিলেন শিবাজী মহারাজ এবং তাঁর উচ্চারণে স্বপ্নে রাজনীতিতে মহারাষ্ট্র-মারাঠা-মারাঠী ছাড়া আর অন্য কিছুর বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। তবে বাল ঠাকরের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কের মধ্যে সদ্ভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে তিনি ইন্দিরার পাশে ছিলেন--সরব ছিলেন অকুণ্ঠ ইন্দিরা প্রশস্তিতে। ইন্দিরার পর থেকে শিব সেনা ও কংগ্রেসের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে প্রধানতঃ শিবসেনার প্রাদেশিকতা ও শারদ পাওয়ারের শিব সেনা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই।
অথচ ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস হল--১৯৮০ সালে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ারের সরকারকে কংগ্রেস মধ্যরাতেই বরখাস্ত করে দেয় ! শারদ পাওয়ার সনিয়া গান্ধী সীতারাম ইযেচুরি উদ্ধব ঠাকরে সঞ্জয় রাউত--এরা সবাই সেই মাধ্যরাতের ইতিহাস মনে রেখেও সকাল ৫.৪৭ মিনিটে রাজ্যপালের রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহারের পর সকাল ৮টায় বিজেপির ফড়নবিশকে শপথবাক্য পাঠ করানোর ঘটনাকে ‘‘মধ্যরাতের সাংবিধান হত্যাকাণ্ড’’ চিহ্নিত করে নাটক একটা মঞ্চস্থ করলেন বটে ! তারা বেমালুম ভুলে গেলেন কংগ্রেস প্রায় ১০০ নির্বাচিত সরকারকে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে বরখাস্ত করেছিল।
সেই সব নির্বাচিত সরকারকে যখন কংগ্রেস বরখাস্ত করে তখন সংবিধান ও গণতন্ত্রহত্যাকারী কংগ্রেসের পিণ্ডি চটকাতে কেউ এক সেকেণ্ডও দেরি করে নি। দীর্ঘকাল ধরে কংগ্রেস বিরোধী রানীতিতে যে বায়াসনেস দেখা গেছে (এখনও মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দেয়) ঠিক সেই একই বায়াসনেস দেখা যাচ্ছে বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতেও। আমি বলছি না যে, বিজেপি যা করছে তা নৈতিকতার বিচারে প্রশংসনীয়--না, কঠোর সমালোচনার যোগ্য বলেই আমি মনে করি। কিন্তু গতকাল যেটা সংবিধান ও গণতন্ত্র হত্যা ছিল আজ সেটাই চকচকে নৈতিকতার মলাটে মুড়ে ফেলা এত সহজ হচ্ছে কি করে?
একসময়ে যেমন কংগ্রেস বিরোধিতাই ছিল ওয়ান পয়েন্ট কালচার-প্রোগ্রাম--এখন হয়েছে বিজেপি বিরোধিতা। হতেই পারে, হওয়া উচিতও--কিন্তু কারা কাদের হাতে হাত রেখে এই কালচার-প্রোগ্রামে মত্ত হচ্ছে? শিবসেনা তথা ঠাকরে পরিবারের এক ও একমাত্র প্রাদেশিকতা কেন্দ্রিক আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় কংগ্রেসকে তার অবস্থান স্পষ্ট করতে হয়েছিল সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং ধরে রাখতে। এই দায় শিবসেনার কোনকালে ছিল না আজও  নেই। কংগ্রেসী কালচারে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে নিয়ে শারদ পাওয়ারও শিবসেনার প্রাদেশিকতার রাজনীতিকে মেনে নিতে পারেন নি। ঠাকরে পরিবার বা শিবসেনার নিজস্ব ‘‘মহা বিকাশ আঘাড়ি’’ সরকার শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র-মারাঠা-মারাঠীদের জন্যেই যখন মহা বিকশিত হতে শুরু করবে (যেমন চাকরিতে ৮০% মারাঠীদের জন্য সংরক্ষণ সহ আরও বহুবিধ প্রাদেশিকতা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত) তখন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নিয়ে চতুর্দিকে প্রশ্ন উঠবে। একনায়কতন্ত্রী  প্রাদেশিক রাজনৈতিক জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে সনিয়া তো বটেই--শারদ পাওয়ারও অস্থির হয়ে উঠবেন। আত্মগ্লানিতেও ভুগতে হবে তাঁদের। বিচ্ছিরি রকমের এক অনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতিকে প্রোৎসাহ দানের চড়া মাশুল তাদের অবশ্যই গুণতে হবে।
মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজেপি ও শিবসেনা সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছিল। রাজ্যবাসী তাদের জোটকে ক্ষমতায় বসার সুযোগ দিলেও এনসিপি ও কংগ্রেসকে দূরেই সরিয়ে রেখেছিল। এক চতুর্থাংশেরও কম আসন যারা পায় তারা ক্ষমতায় বসার জন্য এতদূর নীতি ও মতাদর্শগত অবস্থান থেকে কি করে নিজেদের নামিয়ে আনতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর রাজ্যের মানুষ অবশ্যই চাইবে। সুবিধাবাদী সুযোগ-সময়-প্রয়োজন রাজনৈতিক নৈতিকতাকে কতদূর নিচে নামাতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন সনিয়া গান্ধী  ও শারদ পাওয়ার। তাঁরা যদি জনতার রায় মেনে বিরোধী আসনেই অনড় থাকতেন তাহলে তাঁদের এই নগ্ন ক্ষমতালোলুপতা এভাবে প্রকট হত না।
একসময়ে যে কোন মূল্যে কংগ্রেসকে ঠেকাতে বিরোধীরা অনৈকতার নজির কিছু কম রাখেন নি। এখন বিজেপিবিরোধিতায় তার চেয়েও নিম্নস্তরের নজির এরা তৈরি করলেন। কিছুটা হলেও শারদ পাওয়ার ও সনিয়া গান্ধী নিজেদের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে রক্ষা করতে পারতেন যদি বিজেপিকে ঠেকাতে শিবসেনাকে বাইরে থেকে সমর্থন দিতেন। তাতে হয়তো রাষ্ট্রপতি শাসন উঠতো না--ছ’মাস পরে রাষ্ট্রপতি শাসনেই নির্বাচন হত--কিংবা ছ’মাসের মধ্যে গাধা-ঘোড়া বেচাকেনা হত। গাধা-ঘোড়া তো বেচাকেনার জন্যেই--এদের নিয়ে রাজনীতি করলে তার মূল্য দিতে হবে না?
মূল্য দিতেই হবে--দু’চারদিন যেতে দিন--গাধাঘোড়াদের অস্থিরতা টের পাবেন। আপনারাও শিবসেনাকে বেশিদিন বহন করতে পারবেন না--সে অওকাত আপনাদের কারুরই নেই ! বিজেপি বিরোধিতার যে ওয়ান-পয়েন্ট কালচার-প্রোগ্রাম আপনারা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তার ফলশ্রুতি তো গত লোকসভা নির্বাচনেই দেখলেন। বিরোধিতা না করে যখন কোন উপায় নেই তখন আগে যোগ্য বিরোধী হয়ে উঠুন--মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলুন না হলে আপনারাও একে একে হারিয়ে যাবেন ‘‘বিশিষ্ট কমেডিয়ান’’ হিসেবে নাচতে নাচতে পর্দার আড়ালে !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.