Header Ads

অসম ও দুলাল পাল


অরুপ বৈশ্য
দুলাল পালের পরিবার মরদেহ গ্রহণ করলো, এটাই ছিল স্বাভাবিক। একটা পঙ্গু জরদগব সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য আর কতোদিন রাষ্ট্রীয় চাপ সহ্য করতে পারে, পিতার শেষকৃত্য ও শেষশ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি গরিব শ্রমজীবী পরিবার আর কতোদিন অপেক্ষা করতে পারে? যথারীতি এই শ্রমজীবী পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকার তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিল, পরিবারের ন্যায় সঙ্গত দাবি উপেক্ষা করে সরকার মামলা প্রত্যাহার না করেই বিদেশি তকমা নিয়েই স্বদেশের মাটিতে শেষকৃত্য করতে বাধ্য করা হলো।

স্বাধীন ভারত গড়ে উঠেছিলো ভারতীয় সভ্যতার যে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধারাকে স্বীকৃতি দিয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের প্রতিক্রিয়াশীল ধারাকে উপেক্ষা করে, সেই ধারার পরিণতি ছিল ভোটাররাই নাগরিক সেটা মেনে নেওয়া। সভাতার যে প্রগতিশীল ধারাকে মান্যতা দিয়ে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার যে ভিত রচনা হয়েছিলো তার মূল কথা ছিল - (১) অভিযুক্তকে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে, সরকার নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সরকারকেই অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। (২) একজন নিরপরাধের যাতে শাস্তি নাহয় সেটা সুনিশ্চিত করতে যদি দশজন অপরাধী পার পেয়ে যায় তথাপিও নিরপরাধ যাতে শাস্তি না পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে।

নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে সভ্যতা ও গণতন্ত্রের গোটা কাঠামোকেই যখন উলটে দেওয়া হচ্ছে, তখন আন্দোলকারী বিভিন্ন সংস্থা এই মূল জায়গায় আঘাত করার মতো কোনো দাবি উত্থাপন না করে একধরনের বিশুদ্ধ বাস্তববাদের আশ্রয় নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইনি দাবিসনদ তৈরি করে চলেছেন। সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অবশিষ্ট পরিসরের যারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের লড়াই তখনই অর্থবহ হয়ে উঠে যখন সভ্যতা ও গণতন্ত্রের মূল ভিতকে পাল্টে দেওয়ার যে আয়োজন চলছে তার বিরুদ্ধে সামাজিক চ্যালেঞ্জ গড়ে উঠে। অন্যথায় আইনি সংগ্রামের  সুদূরপ্রসারী সুফল অধরাই থেকে যায়, অথবা কোনো মোক্ষম সময়ে আইনি সংগ্রামের বিজয়ের বিপরীত যাত্রা আবারও শুরু হয়ে যায়। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে চলেছে, তাতে প্রতিপক্ষ নিশ্চিন্তে তাদের মূল কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রয়াত দুলাল পালের পরিবারের ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ের পরিণতি যা হওয়ার ছিল তা'ই হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হাজারো দুলাল পাল বেঘোরে প্রাণ দেবে।

ভারতের সর্বত্র গড়ে উঠছে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো ডিটেনশন ক্যাম্প। ওখানে কারা থাকবে? দুলাল চন্দ্র পাল, প্রভা রায়, হুশেন আলী, পুনা মুণ্ডার মতো যে শ্রমজীবী মানুষরা যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রাণ হারালেন, তাদের মতো শ্রমজীবী মানুষরা। তারা কী করবেন? তারা আমেরিকার জেল ব্যবসার কয়েদী কালো আদমির মতো বহুজাতিক নাইক কোম্পানীর জোতা বানানোর কাজে বেগার খাটবেন ও বেঘোরে তিলে তিলে প্রাণ হারাবেন। 

অসমিয়া গণতান্ত্রিক সমাজ ডিটেনশন ক্যাম্পের বিরোধী, তাঁরা অসমকে মানবতার বধ্যভূমি বানাতে চান না। ১৯ লাখ এনআরসি-ছুটদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মতো একটা বিপদজনক জায়গায় পাঠানোর তাঁরা বিরোধী কিনা এখনও জানা যায়নি। এফটি একটি ন্যায়িক ব্যবস্থা নয়, সেখানে এই গরিব মেহনতি মানুষের কী পরিণতি হবে তা অনিশ্চিত। কিন্তু দুলাল পরিবারের লড়াইয়ের মোক্ষম সময় তারা ডিটেনশন ক্যাম্পের বিরুদ্ধে সময়ের দাবির চাইতে কম সোচ্চার হওয়াটা সত্যিই পীড়াদায়ক।

অসমে দু'টি পক্ষ। একপক্ষ অসমিয়া হিন্দু - বাঙালি হিন্দু ঐক্যের আওয়াজ তুলছেন, তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বরাক - ব্রহ্মপুত্রের, অসমিয়া-বাঙালির এলিট ক্লাস ও তাদের সহযোগী শাসক শ্রেণির উমেদার তাবেদার বাহিনী। অপর পক্ষে নীপিড়িত শ্রমজীবী মানুষ, এখনো নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজ (যারা জনগোষ্ঠীর এক ক্ষুদ্র অংশকে প্রতিনিধিত্ব করেন), তাদের কোনো শ্রেণি নেতৃত্ব এখনও গড়ে উঠেনি। বাঙালিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, সেটা বাস্তব, কিন্তু কোন বাঙালি? শ্রমজীবী বাঙালি। একটি জনগোষ্ঠীর শ্রমজীবী মানুষ যখন অন্যদের তূলনায় বেশি আক্রান্ত হতে পারে, তখন সম্প্রসারণবাদের তত্ত্বটি কোন ভিতের উপর দাঁড়ায়, ভেবে পাই না। যখন শিবির বিভাজনের স্বরূপটি এরকম, তখন জাতীয়তাবাদী প্রকল্পটিই বা কোন ভিতের উপর দাঁড়ায়, তাও ভেবে পাই না। যখন সভ্যতা ও গণতন্ত্র আক্রান্ত, তখন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের পরিসরকে জাতীয়াবাদ ও সম্প্রসারণবাদের কল্পকাহিনী কী প্রতিরোধের সংগ্রামকে ধোঁয়াটে করে না, ভেবে পাই না। বামপন্থী জাতীয়বাদীদের কাছে হয়ত উত্তর আছে। কিন্তু উত্তর বাতাসে ভেসে বেড়ানো আগেই সভ্যতা ও গণতন্ত্রের কবর খোঁড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই, সাধু সাবধান।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.