ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ২০০তম জন্ম-বর্ষপূর্তিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : বাংলা গদ্যের জনক, বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি তিনি হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ভারতের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে আজ থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে তাঁর জন্ম। সেটি ১৮২০ সালের কথা। তার পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতার নাম ভগবতী দেবী। খুব দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হলেও বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী ও সচেতন। ঈশ্বরচন্দ্র সন্ধ্যার পর রাস্তার পাশে জ্বালানো বাতির নিচে দাঁড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন ছাত্রাবস্থায়। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত, সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায় বেদান্ত ও স্মৃতি অলঙ্কার বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তার অসাধারণ প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে শিক্ষকরা তাকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি প্রদান করেন। তখন থেকেই ঈশ্বরচন্দ্রের নামের সঙ্গে বিদ্যাসাগর যুক্ত হয়।উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই লাভ করেন বিদ্যাসাগর উপাধি। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তাঁর। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। রচনা করেছেন জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা। বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন 'দয়ার সাগর' নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনই তাঁর দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থ সংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। পিতামাতার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।
বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তাঁরই নামে উৎসর্গিত।
পাঁচ বছর বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এ পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।
১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে আসীন হন। ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর। এ বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর পরিমার্জিত 'আখ্যান মঞ্জরী' পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাঁদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাঁকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে। বিদ্যাসাগরের এ আইনের ফলে বঙ্গ ভারতের কোটি কোটি বিধবার স্বামীর ঘরে আশ্রয় হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ কলেজের বর্তমান নাম 'বিদ্যাসাগর কলেজ।' কর্ম জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন কলেজ শিক্ষক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প-িত ছিলেন। এরপর তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক ও সংস্কৃতের অধ্যাপক হন। কিছুদিন পর তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্য পুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের ভাণ্ডার শক্ত করেছেন। তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এজন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তার বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো_ শকুন্তলা, বোধোদয়, আখ্যান মঞ্জুরী, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি ও সীতার বনবাস। শিমু শিক্ষার মান ও পাঠ সহজ করার জন্য লিখলেন 'বর্ণ পরিচয়'। সংস্কৃত ভাষা সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপনের জন্য লিখলেন 'ব্যাকরণের উপক্রমনিকা'। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এসব গ্রন্থ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পরিপূর্ণ।
মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মাকে তিনি দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে যেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন। তাও আবার ছিল ভরা বর্ষায়। বাংলার এই শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই মারা যান। কিন্তু তার বিভিন্ন সংস্কারের ফল বাংলাদেশ ও ভারতের কোটি কোটি মানুষ ভোগ করছে।
কোন মন্তব্য নেই