Header Ads

‘উজান’র উন্মোচন অনুষ্ঠানে ‘নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্র’ নিয়ে কথা বললেন সমাজকর্মী ও লেখক হর কুমার গোস্বামী

উজান-এর ১৫তম সংস্করণ হাতে নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
নয়া ঠাহর প্রতিবেদন : তিনসুকিয়া থেকে প্রকাশিত বাংলা ছোট পত্রিকা ‘উজান’-এর পঞ্চদশ সংখ্যার উন্মোচন করলেন লেখক ও সমাজকর্মী হর কুমার গোস্বামী। ২৯ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যায় শ্রীপুরিয়ার চট্টেশ্বরী কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে উজানের নতুন সংস্করণের উন্মোচন হয়। জীবন কৃষ্ণ সরকারের পরিচালনায় উজানের শিল্পীদের পরিবেশিত ‘শুভ কর্মপথে’ এই উদ্বোধনী রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে সভা শুরু হয়। এতে অংশ নেন শীলা দেব দে সরকার, চন্দ্রা চক্রবর্তী, দীপ্তি গুহ, সুতনুকা ভট্টাচার্য, অপর্ণা ভট্টাচার্য। তাঁদের তবলাতে সঙ্গত করেন অধ্যাপক হিমাংশু বিশ্বাস। তার আগে নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে গিয়ে এন আর সি ছুট, ডি ভোটার হয়ে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়ে হতাশাতে মৃত্যুর মুখে পড়া মানুষ জন, সেই সঙ্গে মহালয়ার ভোরে দুর্ভাগ্যজনক পথ দুর্ঘটনাতে একাধিক মানুষের করুণ মৃত্যুকে শোক প্রকাশ করে এবং নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সভা এক মিনিট নীরবতা পালন করে।
এর পরে উত্তরীয় এবং সরাই দিয়ে অতিথি হর কুমার গোস্বামীকে বরণ করে নেন ‘উজান’ পত্রিকার সম্পাদক সবিতা দেবনাথ এবং ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র সম্পাদক ভানু ভূষণ দাস। সবিতা দেবনাথ এরপর স্বাগত ভাষণে উজানের অতীত কর্মকাণ্ড, সেই সঙ্গে বর্তমান সংখ্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিষদে বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান যে এবারের পত্রিকার বিষয় করা হয়েছে ‘নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্র’। প্রদেশ, দেশ এমন কি বিদেশ বাংলাদেশ থেকেও লেখা সংগৃহীত হয়েছে। একই বিষয়ে বক্তৃতা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হর কুমার গোস্বামীকে। তাঁর উপস্থিতি সভাকে গৌরবান্বিত করেছে। এর পরে রবীন্দ্র কবিতা ‘ভারত তীর্থ’ আবৃত্তি করে শোনান সুতনুকা ভট্টাচার্য। পর পর দুটি করে একক সঙ্গীতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন শীলা দেব দে সরকার, জীবন সরকার এবং পৌষালি কর। তাঁদের তবলাতে সঙ্গত করেন সৌম্য পাল। পৌষালিকে গিটারে সঙ্গত করেন কৌশিক দাস। 
এর পরেই ‘উজান’ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যার উন্মোচন করেন অতিথি হর কুমার গোস্বামী। তাঁকে সঙ্গ দেন উজান সম্পাদনা সমিতির সদস্যরা ছাড়াও ডাঃ কীর্তি দে, সমীরণ গুহ, রবিন ভাওয়াল, অধ্যাপক প্রাণকৃষ্ণ কর, অধ্যাপক হিমাংশু বিশ্বাস, সুশান্ত কর বর্তমান সংখ্যার পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘এ দৈন্য-মাঝারে, কবি, একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।’ উজান এই আহ্বানটি মনে রাখে। এবারে তাই কাগজটির এবং উন্মোচন অনুষ্ঠানের বক্তৃতার বিষয় ‘নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্র’। এবারের লেখক তালিকাতে আছেন অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা, অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য, সমাজকর্মী ও লেখক অরূপ বৈশ্য, ত্রিদিব নীলিম দত্ত, অনন্ত আচার্য প্রমুখ। পল্লব ভট্টাচার্য, দিলীপ কান্তি লস্কর, বিজয় কুমার ভট্টাচার্য, সপ্তর্ষি বিশ্বাস, শান্তনু গুপ্ত, রবিন ভট্টাচার্য, শ্রীভদ্র, আম্রপালি দেব, তমোজিৎ সাহা , নীলদীপ চক্রবর্তী, চিরশ্রী দেবনাথ, দেবলীনা সেনগুপ্ত প্রমুখ জনা ত্রিশেক কবির কবিতাতে সেজে উঠেছে। মলয় কান্তি দে, রণবীর পুরকায়স্থ, প্রলয় নাগ, আদিমা মজুমদার প্রমুখ গল্প লিখেছেন। এবারে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শতর্বষের কথা মনে রেখে তাঁকে নিয়ে একটি মনন সমৃদ্ধ নিবন্ধ লিখেছেন কবি গৌতম চৌধুরী। সঞ্জয় চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক কবিতার বই ‘দণ্ডবৎ মাতা’ নিয়ে একটি ছোট্ট আলোচনা করেছেন কবি অমিতাভ দেবচৌধুরী। এছাড়াও ত্রিদিব দত্ত, সিদ্ধার্থ গৌতম বসুদের ছবিতে প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরেও সংখ্যাটি হয়েছে অলংকৃত।
 হর কুমার গোস্বামীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, অসম আন্দোলনের দিন থেকে উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বহু প্রত্যাক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলেন লেখক, সমাজকর্মী হর কুমার গোস্বামী। এন আর সি প্রক্রিয়াতে দাবি আপত্তি পর্বের শেষ দিনে যখন ৮০০ আপত্তিকে ষড়যন্ত্র করে ৩ লাখে পৌঁছে দেওয়া হয় তখন হর কুমার গোস্বামীর বিরুদ্ধেও আপত্তি উঠেছিল তিনি বাংলাদেশি বলে। গোটা দেশের সংবাদ মাধ্যমে এই নিয়ে আলোড়ন উঠেছিল। অথচ তিনি নলবাড়ির অসমিয়া ব্রাহ্মণ। গণতন্ত্র এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ান বলেই এহেন হেনস্তার মুখে তাঁকে পড়তে হয়। হর কুমার গোস্বামী বলতে উঠে বলেন, এই কষ্ট কঠিন নাগরিকত্বের পরীক্ষাতে ইতি মধ্যে অসমে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, পশ্চিম বাংলাতেও শুরু হয়েছে মৃত্যু মিছিল। ইতিমধ্যে ষোলোহাজার কোটি টাকা অসমে এই পরীক্ষাতে ব্যয় হয়েছে, মানুষজনও নিজেরা শুনানিতে হাজিরা দিতে গিয়ে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। ফলে অসম জুড়েই অর্থনীতির পতন শুরু হয়েছে। লোকজন জীবন জীবিকা বাদ দিয়ে এন আর সি-র পেছনে ছুটছেন। ফলে কারো নাম উঠে গেলেই তিনি এই দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। এমনিতেও গোটা দেশের অর্থনীতি ভ্রান্ত নীতির জন্যে ডুবছেই। সেই সব কিছুকে নিয়েই যাতে মানুষজন না লড়েন, চিন্তা না করেন—সেই জন্যে দেশের মানুষকে ভাষা সম্প্রদায়ের নাম ধরে বিভাজিত করে রাখতেই এই অভূতপূর্ব নাগরিকত্বের পরীক্ষা। যে পরীক্ষার পরে বাংলাদেশিতে দেশ বিপন্ন করছেন এমন কিছুই বোঝা গেল না। উলটে যাদের কোনোভাবেই বাংলাদেশি হবার কারণ নেই সেরকম লাখো মানুষের নাম বাদ গেল। তাদের আবারও বিদেশি ন্যায়াধিকরণে ছুটতে হবে। এই বদনামের ভাগ নিয়ে যে তাঁরা বাংলাদেশি হলেও হতে পারেন। এই অন্যায় অপমান হতে দেওয়া হবে কেন? তাই তিনি বলেন, আমাদের দাবি জানানো দরকার। বিদেশি ন্যায়াধিকরণ নয়, গণ-শুনানিতে তার বাইরেই লোকজনের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হোক। তিনি বলেন, গেল বিশ বছরে ডি ভোটার প্রক্রিয়াতে তিনলাখ মানুষের বিচার প্রক্রিয়া সেরে এখন অব্দি একলাখ লোককেও বাংলাদেশি বানানো যায় নি। এখন যদি ১৯ লাখ এনআরসি ছুট মানুষের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, তবে দেড় শতক সময় লাগবে। ন্যায় বিচার অসম্ভব। উলটে মানুষ এই নিয়ে ব্যস্তই থাকবেন না, বিভাজিত জনতা অন্য কোনো নাগরিক সমস্যা নিয়ে ভাবতেও ভুলে যাবেন। এবং দেশের সম্পদের তো অপচয় হবেই’। তিনি সমান্তরাল ডি ভোটার প্রথার বিরুদ্ধেও অভিমত ব্যক্ত করেন। ডিটেনশন ক্যাম্পকেও হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন। এবং বলেন, বাকি ভারতে এনআরসি করবার কোনো যুক্তি নেই, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বিপন্ন করা ছাড়া।
সভা শেষে সভাপতি তাঁর ভাষণে আশা ব্যক্ত করেন তিনসুকিয়া শহর তথা জেলার মানুষজন ‘উজান’এর সঙ্গে থাকবেন। উজান স্রোতে ভাসে না, তার বিপরীতে কাজ করে। অসম তথা পূর্বোত্তরের, বাংলার এবং বাংলাদেশের যে লেখকেরা সাড়া দিয়েছেন উজানের আহ্বানে –তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন উজানের যে সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীরা ছবি দিয়ে বর্তমান সংখ্যাকে অলংকৃত করতে সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি। বিশেষ করে উজান সদস্য ত্রিদিব দত্তের উল্লেখ করেন যার ছবিতে প্রচ্ছদ সেজে উঠে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। 
সবার শেষে গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তথা সহসম্পাদক ত্রিদিব দত্ত সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনসুকিয়া শহর তথা জেলার শতাধিক দর্শক সভাতে উপস্থিত ছিলেন। 



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.