যাদবপুর কাণ্ডে বেশ কিছু সত্য প্রমাণিত হল !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপি’র ছাত্রসংগঠন যে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সেই অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে চিহ্নিত করা হল--অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কানাইয়ালালকে (এবং অসংখ্য বামপন্থী নেতা ও ‘‘বুদ্ধিজীবিদেরও) আমন্ত্রণ জানিয়ে কোন বিদ্যা-সংস্কৃতির চর্চা করা হয়েছিল বা হয় তা নিয়ে কোন ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠান হলে যাওয়ার পথেই বাবুল সুপ্রিয়কে আটকে দেওয়ার হিম্মত যারা দেখাল তারা কোন গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক কারণে বা অধিকারে এই ধরণের তাণ্ডব শুরু করে দিল সে সম্পর্কেও কোন যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপাারটা দু’দশ মিনিটের ছিল না--ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যেসব চূড়ান্ত নাটকীয় দৃশ্য সারা দুনিয়ার মানুষ প্রত্যক্ষ করল তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমা এবং উপাচার্যর প্রশাসনিক যোগ্যতা ও ভাবমূর্তি আরও কতটা উজ্জ্বল হল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের কাছ থেকে।
বাবুলের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে--কিন্তু তার কোনও অডিও রেকর্ড শোনানো যাচ্ছে না। উপাচার্যকে নাকি বাবুল অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগ করে অপমান করেছেন ! কথপোকথনের ভিডিও ক্লীপিংসে তাঁর ব্যবহৃত ভাষা ইতিমধ্যেই সকলের কর্ণগোচর হয়েছে। কিছু নির্লজ্জ সিকোয়েন্স তৈরি করে তার ছবি ভাইরাল করার মাধ্যমে বাবুলের চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়েছে। এসবই ঘটেছে উপাচার্যর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার সময়েই। অসহনীয় দীর্ঘ সময় ধরে যে অশালীন অসভ্যতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ভীষণভাবে দূষিত করছিল তা নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা এবং অসহায়তা স্বীকার করে নিয়ে ‘‘প্রথা’’ রক্ষার তাগিদে উপাচার্য পদত্যাগের হুমকি দিতে পারলেন কিন্তু পুলিশ ডাকতে পারলেন না। বাবুলের সঙ্গে যুক্তিগত তর্কে পিছু হটে তিনি হাসপাতালের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পসে চলমান অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে।
কেন্দ্রীয়মন্ত্রী হিসেবে বাবুল সুপ্রিয় জেড ক্যাটেগরীর নিরাপত্তা পান এবং সেই নিরাপত্তা নিয়েই শুধু তিনিই নন সবাই সর্বত্র যাওয়ার অধিকারী। রাজ্যপালও তাঁর নিরাপত্তা কনভয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। বাবুল যদি চাইতেন তাহলে ঘন্টার পর ঘন্টা অবর্ণনীয় হেনস্থা সহ্য না করে নিরাপত্তারক্ষীদের বলতে পারতেন শূন্যে গুলি ছুঁড়ে জোর করে অবরোধ ভেঙে দিতে। কিন্তু সেটা যে খুব বড়রকমের রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেত সেটা তিনি জানতেন বলেই এরকম কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেন নি।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের টিএমসিপিও আজপর্যন্ত একটা ঘাসও গজাতে পারে নি সেই তাদের দলীয় কোন মন্ত্রী, এমন কী কোনও বিধায়কের সঙ্গেও বামপন্থী+উগ্রবামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সংগ্রামী বিপ্লবীরা এ ধরণের সাহস দেখাতে পারত? ঘন্টার পর ঘন্টা এ ধরণের অরাজকতা তৃণমূল মন্ত্রী-নেতারা চলতে দিতে পারতেন? তাঁদের এই ধরণের অরাজক পরিস্থিতিতে রেখে উপাচার্য হাসপাতালে চলে যেতে পারতেন? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে রাজনীতির ছাড়পত্র দেওয়া রাজনৈতিক নেতারা ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচীকে রাজনৈতিক আখ্যা দেওয়ার নৈতিক অধিকার আছে কিনা আমি সে প্রশ্নে যাচ্ছি না--কিন্তু রাজনৈতিক দলেরই ছাত্রসংগঠন যদি রাজনৈতিক কথা বলে তাহলে তা আইন বিরুদ্ধ হয় কি করে? অসংখ্য নজির রয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক দল আয়োজিত রাজনৈতিক সভা-সেমিনার-কর্মসূচী পালনের। তাহলে একটাকে রাজনৈতিক আর একটাকে বিদ্যা-সংষ্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করার আসল উদ্দেশ্যটা কি? যারা বোঝার তারা ঠিকই বোঝেন।
ক্যাম্পাসে একটা ছাত্রসংগঠনের অনুষ্ঠান হচ্ছে যেখানে কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর আসার কথা উপাচার্য জানতেন--কিন্তু তিনি রাজ্যসরকারকে সে ব্যাপারে অবগত করার প্রয়োজন মনে করেন নি। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা (কিংবা অধিকার?) তাঁর নেই তখনও তিনি পুলিশ ডাকার কথা ভাবেন নি--ঠিক এই পরিস্থিতিতে যদি ক্ষমতাসীন দলের কোনও মন্ত্রী পড়তেন তাহলে তিনি তথাকথিত ‘‘প্রথা’’ না ভেঙে এই পরিস্থিতি চলতে দিতে পারতেন? তাঁর সামগ্রিক আচরণ একেবারেই উপাচার্য সুলভ বলে মনে করা যায় কি? বরং নানা সন্দেহের উদ্রেক করে।
দীর্ঘ পাঁচঘন্টা ধরে যে নিয়ন্ত্রণহীন নৈরাজ্য চলছিল তার নিরবিচ্ছিন্ন ফুটেজ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছিল। রাজ্যের শীর্ষ মন্ত্রী থেকে শীর্ষ আমলারাও তা দেখেছেন নিশ্চয়ই--তবু বিস্ময়করভাবে রাজ্যের মানুষকে দেখতে হল সরকারি প্রশাসনের নির্বিকল্প সমাধিতে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা। ঘন্টার পর ঘন্টা পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে না দেখে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাজ্যপাল উদ্বেগ বোধ করছিলেন--ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন--দিল্লি থেকে চাপও আসছিল বলে মনে করা যেতেই পারে। বাবুলের সঙ্গে যদি কোন অঘটন ঘটে যায় তাহলে রাজ্য সরকারের আগে তাঁকেই সংসদের স্পীকার ও গৃহমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করতে হত। প্রায় চারঘন্টা এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বাধ্য হয়েই নজিরবিহীনভাবেই রাজ্যপালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে আসতে হয়েছিল। তিনি শুধু রাজ্যপাল-ই নন--পদাধিকার বলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও বটে ! তাঁকে বিজেপি’র ক্যাডার হিসেবে কেউ কেউ ভাবতেই পারেন--কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলমাত্রেই তাদের ক্যাডার বা অনুগত ব্যক্তিকেই রাজ্যপাল পদে বসিয়ে থাকে--এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। রাজ্যপাল প্রকাশ্যে উপাচার্য বা নিষ্ক্রিয় থাকা রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করেন নি। চার নং গেটের কাছে বিজেপি কর্মীদের আচরণ নিয়েও কোন কথা বলার প্রয়োজন তাঁর ছিল না। সে সম্পর্কে যা বলার তা রাজ্য প্রশাসনেরই বলার কথা। রাজ্যপাল তাঁর সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকেই যা করার করেছেন--কিন্তু সাংবিধানিক পদে থাকা বেশ কিছু ব্যক্তি তাঁর রাজনৈতিক আইডেন্টিটি নিয়ে জোরদার ময়নাতদন্ত শুরু করে দিতে দেরি করেন নি !
বাবুল সুপ্রিয়র নিরাপত্তাকর্মীরা যদি ছাত্রদের জোর করে ছত্রভঙ্গ করতে চাইত--পরিস্থিতি তাতে আরও বিগড়ে যেত--রক্তপাতের সম্ভাবনাও ছিল--এরকম ঘটনা ঘটলে তার দায় নিতে হত ছাত্রদের এবং বিজেপিকেও। তাতে রাজনৈতিক মুনাফার অধিকারি কিন্তু বাম বা বিজেপি কেউ-ই হত না। এটা বাবুল সুপ্রিয় বা বিজেপি বুঝলেও বাম+অতিবাম ছাত্র সংগঠন বুঝতেই পারে নি। কোমায় থাকা তাদের দলের উত্থানশক্তি কতটা দুর্বল হয়ে গেল বা হয়ে যাচ্ছে তা বোঝার ক্ষমতা ঐসব মাথাধোয়া ছাত্রদের যে একেবারেই নেই তা আর বুঝতে বাকি থাকল না। বিজেপিকে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের এই মহান দায়িত্ব তাদের কে দিল তা ঈশ্বরই জানেন। নিজের দলের নেতা-মন্ত্রী মানেই দেবদূত--অন্য দলের নেতা-মন্ত্রী মানেই ক্রিমিন্যাল--এই নির্বোধ অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সময়মতো মানুষই নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নেবে। বিজেপি এখন এই রাজ্যে চতুর্দিকে অযাচিত নির্বোধ সুযোগ তুলে নিতে একটুও দেরি করছে না--প্ররোচনার ফাঁদও পেতে চলেছে রাজ্যব্যাপী--আর সেই ফাঁদে যারা নাচতে নাচতে পা বাড়িয়ে দিচ্ছে--তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষ ভাববে কেন সেটাই তো আগে ভাবা দরকার ! এভাবে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে না--বরং তাদের উপকারই করা হবে। হচ্ছেও তাই--কিন্তু অতি বিপ্লবীরা তা বুঝতেই পারছে না।
কোন মন্তব্য নেই