গর্বের যাদবপুর এখন বাংলার লজ্জায় পরিণত হয়ে চলেছে
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম+উগ্রবাম ছাত্রদের মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গেছে। ওখানে প্রবল প্রতাপান্বিত টিএমসিপিও খাপ খুলতে পারে নি এখনও। মমতা ও উচ্চশিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্য হয়ে একদা ছুটে এসে বুঝে গিয়েছিলেন এ জমিতে ফুল চাষ খুব সহজ নয়। এর প্রধান কারণ, এই বিশ্ববিদ্যলয়ের কিছু বাম+অতিবাম শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতা। বাম আমলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্বাচন প্রায় হতই না--একচ্ছত্র অবৈধ অগণতান্ত্রিক আধিপত্য ছিল এসএফআইয়ের। বামফ্রন্ট কোমায় চলেও গেলেও যাদবপুরে এখনও এসএফআইয়ের স্বৈরাচার অটুট রয়েছে। এই ক্যাম্পাসের মধ্যে তাদের আধিপত্য অন্য কোনও ছাত্রসংগঠনের উত্থানে খর্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেই তাদের অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রী চেহারাটা প্রকট হয়ে ওঠে।
বিজেপি’র ছাত্রসংগঠন আয়োজিত নবীনবরণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এসএফআই আজ যে ভূমিকায় ময়দানে ঝাঁপালো গোটা দেশে তার দ্বিতীয় নজির নেই। বামপন্থীদের আমন্ত্রণে এখানে বাম নেতারা সেমিনার সহ নানান অনুষ্ঠানে এলেও বিন্দুমাত্র বাধার সম্মুখীন হন না। বিজেপি’র ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে তাদের দলের নেতা (শুধু নেতা নন--সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী) এলে তাকে ঘেরাও করে রাখা হবে--অশ্রাব্য গালিগালাজ করা হবে চুল ধরে টানাটানি করা হবে জামা ছিঁড়ে দেওয়া হবে চশমা খুলে দেওয়া হবে লাথি থাপ্পর ঘুঁষি মারা হবে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হবে চূড়ান্ত নৌটঙ্কির মাধ্যমে পিলে চমকানো সব অভিযোগ আনা হবে--এইসব আচরণ বামসংস্কৃতিতে রীতিমতো প্রশংসনীয় বিবেচ্য মনে হলেও অন্য যে কোন সংস্কৃতিতে অত্যন্ত ঘৃণ্য আচরণ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ওপর যে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো হল তা সম্ভবত এই রাজ্যেই সম্ভব। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনুষ্ঠানে আসছেন এ সংবাদ উপাচার্য জানতেন--জেনেও তিনি তাঁর নিরাপত্তার কোনও রকম ব্যবস্থা রাখেন নি। অনেক আগে থেকেই তাঁর উত্তেজনার আঁচ পাওয়ার কথা তবু তাঁর বিস্ময়কর নিষ্ক্রিয়তায় যে ঘটনা ঘটল তার সম্পূর্ণ দায়ভার তাঁর ওপরেই বর্তায়। রাজ্যপাল বার বার তাঁকে পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরামর্শ দিলেও এই বিপ্লবী উপাচার্য সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি পদত্যাগ করবেন তবু পুলিশ ডাকবেন
না ! তাঁর এই অবস্থানকেও একেবারেই সন্দেহের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। সরাসরি আচার্যর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি হাসপাতালের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকেও এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে উন্মত্ত পড়ুয়ারা ঘিরে রাখল ! সঙ্গত কারণেই অজস্র প্রশ্ন উঠছে--কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর আসার কথা থাকলেও পুলিশি নিরাপত্তা কেন ছিল না। চার ঘন্টা পরে স্বয়ং রাজ্যপালকে যখন ছুটে আসতে হল বাবুল সুপ্রিয়কে মুক্ত করতে তখন পুলিশকে দেখা গেলেও তাদের সেভাবে সক্রিয় হতে দেখা গেল না কেন--যেভাবে রাস্তাঘাটে পুলিশের অতিসক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়।
দলেরই এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সাংসদকে ক্যাম্পাসের ভেতর আটকে রেখে যখন চূড়ান্ত হেনস্থা করা হচ্ছে তখন দলের যুব-ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা বসে বসে তামাশা দেখবে এটা যারা ভাবছিল তারা যে ঠিক ভাবে নি সেটা বোঝানোর জন্যে চার নং গেটের পাশের এসএফআইয়ের অফিসে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। এই আচারণও অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সন্দেহ নেই--কিন্তু ভয়ঙ্কর প্ররোচনাটা ছিল এসএফআইয়ের দিক থেকেই। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ইট ছুঁড়লে পাটকেল খেতেই হবে।
ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাম্পাস জুড়ে চূড়ান্ত অভব্য তাণ্ডবের ছবি দেখছে সারা দুনিয়া। একজন সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর চুলের গোছা ধরে টান মারার দৃশ্যও বার বার দেখছে টিভির দর্শকরা। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে পুলিশ-প্রশাসন মন্ত্রীকে উদ্ধার করতে এল না। প্রচুর ফোনাফোনি হলেও কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় রাজ্যের যিনি সাংবিধানিক প্রধান, সংসদের স্পীকার ও গৃহমন্ত্রীর কাছে যাঁর জবাবদিহির দায়িত্ব রয়েছে, সেই রাজ্যপাল তথা আচার্যকে বড় কোন অঘটন ঘটে যাওয়ার আগে বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে আসতে হল।
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন--কিন্তু রাজ্যপাল উপাচার্য ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার ওপর যে ভরসা রাখতে পারেন নি সেটা স্পষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একজন বিজেপি নেতা হতেই পারেন--সেটা কোনও ক্রাইম হতে পারে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে সরকারকে কিছু না জানানোর প্রয়োজন যদি উপাচার্য অনুভব না করেন তার দায় তো অন্য কেউ নিতে পারে না। বাবুল সুপ্রিয়কে ঘিরে ধরে তাণ্ডবের সূচনাতেই তো উপাচার্য সরকারের সাহায্য চাইতে পারতেন--তাহলে তো জল এতদূর গড়িয়ে সমুদ্রের নোনা জলে গিয়ে মিশে যেত না।
রাজ্যপাল বিজেপি নেতাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন এবং বিজেপি সমর্থকদের গুণ্ডামি নিয়ে নীরব থাকলেন--এইসব অভিযোগের বিশেষ সারবত্তা থাকছে না। ক্যাম্পাসের বাইরে বিজেপি সমর্থকরা যা করেছে বা করার সুযোগ পেয়েছে তার দায় কে নেবে? কেন এই সুযোগ তারা পেল? সাধারণ মানুষ তো প্রশ্ন করতেই পারে--এসব হচ্ছেটা কি? রাজ্য সরকার নিজেই কি নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে না আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে তারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে? বিজেপির হাতে নাচতে নাচতে হাতিয়ার তুলে দিলে তারা তার ব্যবহার করবে না--এই আত্মপ্রত্যয় কি ক্রমশঃ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে না?
কোন মন্তব্য নেই