Header Ads

বৰ্তমান খাসি সমাজে মূল্যবোধের তারতম্য ঘটেছে

আসন্ন দেবীপক্ষের উৎসবে মাতোয়ারা সময়। গুয়াহাটির এক নিরিবিলি ক্যাফেতে মাতৃপ্ৰাধান্যের সমাজ নিয়ে আলোচনায় মুখোমুখি আমরা।

রিংকি মজুমদার

সদ্য প্ৰকাশিত হয়েছে অসমের বিশিষ্ট লেখিকা সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়ার ‘বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প’ শীৰ্ষক বইটি। বইটি লেখাকালিন তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা লেখিকা শেয়ার করেছেন। আমাদের কথোপকথোন চলতে লাগলো এইভাবে। সেখান থেকেই কিছু অংশ ‘নয়া ঠাহর’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। 


  •  ‘বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প’ বইটি সদ্য প্ৰকাশিত হয়েছে। অভিনন্দন।

- এখনও উন্মোচন হয়নি। পুজোর পরে দেশের বিভিন্ন প্ৰান্তে বইমেলায় পাঠকের মুখোমুখি হব। বইটি প্ৰথম উন্মোচন হবে শিলঙে। অক্টোবরের শেষের দিকে।
  • ঠিক কতদিন লাগলো বইটি লিখতে?
- মেঘালয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৮ সাল থেকে। বারে বারে বেড়াতে গিয়েছি। চেরাপুঞ্জি, ডাউকি, মাওলিংলং, লাইটুম, স্মিথ ভিলেজ নানা জায়গায়, নানা ঋতুতে। কিন্তু বারে বারে চোখের দেখা হলেও বইটি কিভাবে লিখবো, কি বলতে চাই এসব ঠিক করে বছর চারেক সময় লেগেছে।
  • বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প, এখানে কী বদলের কথা বোঝাতে চেয়েছেন?

- প্ৰথমেই বলি আমি গবেষক নই। একজন গবেষকের থেকে মানুষ যে ধরনের তথ্য সম্বৃদ্ধ বিষয় আশা করে তার যোগান আমি দিতে পারিনি। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক আর খাসি সমাজকে নিবিড়ভাবে জানতে চাওয়া মানুষ হিসেবে কিছু কথা বলতে চেয়েছি। গত কয়েক বছর ধরে আমি খাসি লোককথা, কবিতা, গল্প, মেঘালয় থেকে প্ৰকাশিত খবরের কাগজ, পত্ৰ পত্ৰিকা, খাসি সিনেমা, খাসি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া,  মিউজিয়াম, চাৰ্চ, লাইব্ৰেরি, সেংখাসিতে গিয়েছি। বারে বারে গিয়েছি স্থানীয় বাজারে, যেখানে প্ৰান্তিক খাসি মেয়েরা প্ৰতিদিন গ্ৰাম থেকে আসে। রেস্তোঁরা, কলেজে যেখানে যেভাবে পেরেছি দুটো কথা বলতে চেয়েছি। পাশাপাশি খাসি লেখকদের লেখা বই পড়েছি। সব মিলিয়ে মনে হয়েছে খাসি সমাজটা একটা বিশেষ সময়ে এসে পৌঁছেছে। দুটো মূল্যবোধ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একদিকে মাতৃপ্ৰাধান্যের সমাজ থাকুক, তার প্ৰতি শ্ৰদ্ধা আমার। আরেকদিকে নানা দ্বন্দ্ব, প্ৰশ্ন, নতুন করে ভাবতে চাওয়া। বাবার অস্তিত্ব এবং ভূমিকাকে প্ৰাধান্য দিতে চাওয়া। বলতে পারা যায় একটা ‘ট্ৰানজিশন পিরিয়ড’।


  • খাসি সমাজটা মাতৃপ্ৰাধান্যের ঠিক কী রকম?
-- ম্যাট্ৰিলিনিয়ল শব্দটা ল্যাটিন শব্দ। যেটা ম্যাট্ৰিস, মাদার থেকে এসেছে। একটি গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয় হল ম্যাট্ৰিলিনিয়ল কিন্তু আমাদের অন্যান্য সমাজের প্যাট্ৰিয়াৰ্কি বা পিতৃতান্ত্ৰিক ব্যবস্থার মতো নয়। পিতৃতন্ত্ৰ শব্দটার উৎপত্তি হল পিতা বা পণ্ডিতের শাসন। মাতৃধারা খাসি সমাজের নিয়ম ভারী সুন্দর। প্ৰাচীন খাসি সমাজে খাসি পুরুষরা সব সময় ব্যস্ত থাকতো রাজদরবার, যুদ্ধ, শিকারে। বাড়ির সব দায়িত্ব ছিল মায়েদের। সন্তান, নিজের ঘর, গোষ্ঠীর দায়িত্ব পালন করতো মেয়েরা। খাসি মেয়েরা। সেভাবেই একটি নিয়ম গড়ে উঠলো। মা বাজারে যাবে। উপাৰ্জন করবে, সন্তানের দেখাশোনা করবে এবং খাসি মায়ের পদবি নিয়ে বেড়ে উঠবে। পুরুষরা গ্ৰামের রাজনীতিতে, রাজদরবারে মতামত দেবে। গ্ৰাম প্ৰধানের নিৰ্বাচনে অংশ নেবে। উপাৰ্জন করলেও মায়েদের মতো সন্তানদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে না। অনেকটা ঠিক ‘অন্য মানুষের’ভূমিকায়। খাসি সমাজটা গড়ে উঠেছে আদি মাতা ‘ইয়াওয়ে টিনরাই’ থেকে। বড় সুন্দর লাগে শুনতে, পড়তে, ভাবতে।
  • কাজটি করতে নিশ্চয়ই সুবিধে-অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়েছে আপনাকে?
--আমি বারে বারে শিলং যেতাম। ধর একদিন সকালে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম ঘন্টা তিনেক পর পুলিশ বাজার। শিলঙের সবচেয়ে পুরনো বাজার ‘ইউডু’-তে যেতাম। আজকাল ওই বাজারটিকে ‘বড় বাজার’ বলে। শহর থেকে দূরের গ্ৰাম থেকে আসা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। কখনও শহরের বাসে উঠে পড়েছি। ঠিক কোথায় চলেছি স্পষ্ট জানা ছিল না। বাসে যেতে যেতে ইন্টারভিউ মানে আলাপ, কথা বলা এসব। লাইব্ৰেরি, মিউজিয়াম গিয়েছি। পুরনো খাসি সমাজকে বোজার চেষ্টা করেছি। সিনেমা দেখেছি। কখনও পথে মিছিলের পায়ে পায়ে হেঁটেছি। নিয়মিত শিলং টাইমস পত্ৰিকা পড়েছি। শুকনো মাছের চাটনি (‘টাঙট্যাপ’),  স্টিমড রাইস (জালি) খেয়েছি। একটা সম্পৰ্ক তৈরি করতে চেয়েছি। ‘দ্য শিলং টাইমস’, ‘দ্য মেঘালয়া গাৰ্ডিয়ান’আর ‘একলেকটিক নৰ্থইস্ট’, ‘নৰ্থইস্ট টু ডে’, ‘ইস্টাৰ্ন প্যানোরমা’ এসম নিয়মিত পড়তাম। এছাড়া বিভিন্ন খাসি লেখক লেখিকাদের বই পড়তাম।
  • বৰ্তমানে খাসি মেয়েদের কী ধরনের পরিবৰ্তন চোখে পড়ল?

- ছোট ছোট বিষয় কিন্তু ছোট নয়। খাসি বিয়ের নিয়ম, খাসি সংগীত এবং সিনেমায় বদল। সন্তান জন্মের পর নামকরণের অনুষ্ঠান, কিংবা খাদ্যাভাষ, নানাভাবে পরিবৰ্তন দেখা গিয়েছে। সব সমাজেই দ্ৰুত পরিবৰ্তন দেখা দিচ্ছে। সম্পৰ্ক, জমি, ক্ল্যান, পারিবারিক সম্পত্তির হস্তান্তর, সব কিছুই বদলে গেছে। আমি একটা বিষয় বুঝতে চেয়েছি। পুরো বদলটা অৰ্থাৎ এই যে উন্নয়নের জোয়াড়, গ্ৰেটার শিলং, গ্ৰাম থেকে শহরের দিকে ছুটে আসা। পরিবেশ দূষণ, গ্ৰামে ইটভাটা, সিমেন্ট কোম্পানি, ইউরেনিয়াম খনন, এসব থেকে সাধারণ মানুষ কীভাবে আক্ৰান্ত হচ্ছে এবং বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্ৰেণি সবসময় একটা সুবিধে জনক অবস্থায় থাকে। বাজারের ভালো ক্ৰেতা হতে চাওয়া এই শ্ৰেণি আগে খাসি পরিচয় না কী প্যান ইন্ডিয়ান হয়ে বাঁচতে চাইছে? একজন মায়ের শিকড় তার আৰ্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বাজার যদি সেই উপাদানগুলো নিজের মোড়কে সাজিয়ে বলে এ মুক্ত বাজারে সবাই এক, ভালো ক্ৰেতাই হয়ে ওঠা শেষ পরিচয়। তাহলে ভাবতে হবে।
  • এই বইয়ের টাৰ্গেট রিডার কারা?

- যারা প্ৰকৃতি, কৌমভিত্তিক সমাজ, মানবীবিদ্যা সম্পৰ্কে আগ্ৰহী, যারা বাজার জীবন নয়, সমাজ জীবনের প্ৰতি আস্থাশীল। মানুষকে যারা মানবিক সত্বা দিয়ে বোঝতে চায়। শিকড়ের প্ৰতি যাদের আস্থা আছে। তাদের জন্যে। আসলে মহিলারাই একটা ঘর, সমাজ, কৌমজীবনকে সুন্দর করে ধরে রাখে। তাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা দিয়ে যে সমাজ এগিয়ে যায় সেটাই সুস্থ আর সুন্দর সমাজ। পিতৃতন্ত্ৰ বৈষম্যকে টিঁকিয়ে রাখতে চায়। নারীর শ্ৰমকে শুধু ব্যবহার করে। এই মাতৃপ্ৰাধান্যের সমাজকে তাই পিতৃতান্ত্ৰিক পরিকাঠামোয় বদলে যেতে দেওয়া উচিত নয়।
বইটা বাংলা পড়তে পারা, বুঝতে পারা পাঠক, বিশেষ করে মহিলারা পড়লে ভালো লাগবে। আবারও বলি ভুলভ্ৰান্তি থেকে গেছে। একজন বাঙালি মহিলা আপ্ৰাণ চেষ্টা চালিয়েছে খাসি সমাজকে বুঝতে। এইটুকুই বলবো।  

কলকাতার ‘মনফকিরা’ প্ৰকাশক সংস্থা বইটি প্ৰকাশ করেছে। বইটিতে ২৪টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। শিলঙে ‘চিরব্লসম’ উৎসব খুব সুন্দরভাবে বৰ্ণানা করেছেন লেখিকা। বইটিতে গুরুত্বপূৰ্ণ পরিচ্ছেদ গুলি হচ্ছে ‘ইতিহাসের পাতায় মাতৃপ্ৰাধান্য’, ‘খাসি কারা’, ‘শিকড়ের খোঁজে’, ‘খাসি ক্ল্যান’ , ‘খাসি পরিবারে কা খাদু’, ‘খাসি দেশের রাজনৈতিক ক্যানভাস’, ‘খাসি মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’, ‘খাসি মায়েরা ছিন্নমূল হচ্ছে’, ‘ইউরেনিয়ামের লড়াইয়ে খাসি মায়েরা’, ‘উপসংহারের আগে’।  গুয়াহাটি এবং শিলঙে অক্টোবরের শেষের দিকে বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন হবে। বইটি পড়তে ইচ্ছুক পাঠকদের তার জন্য আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। পুজোর প্ৰাক্কালে সুপৰ্ণা দির সঙ্গে সদ্য প্ৰকাশিত ‘বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প’ বইটি নিয়ে আলোচনা করে প্ৰতিবেশী রাজ্য মেঘালয় আমার অনেক কাছে চলে এল। সুপৰ্ণাদিকে পুজোর শুভেচ্ছা জানিয়ে আমরা এদিনের মতো আলোচনা শেষ করলাম।










কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.