Header Ads

ঐতিহাসিক ভুলের ঐতিহাসিক সংশোধন যে কোন মূল্যে জরুরি ছিল !! (১)



 বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বলবৎ-এর তীব্র বিরোধী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর প্রতিবাদ জানাতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা আজও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি রহস্যাবৃত বিয়োগান্তক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কাশ্মীরের তদানীন্তন ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আবদুল্লার ‘ভিসা’ (পারমিট) ছাড়াই কাশ্মীরে প্রবেশ করায় তাঁকে জেলবন্দী করা হয়েছিল। শোনা যায় সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঠিক সেই ইঞ্জেকশন্ দেওয়া হয়েছিল যাতে তাঁর শরীর তীব্র অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। যে নার্সকে দিয়ে ঐ ইঞ্জেকশন্ দেওয়ানো হয়েছিল তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় নি ! তাঁর অপ্রত্যাশিত ও রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত দাবি করে তাঁর মা যোগমায়া দেবী বার বার চিঠি লিখেছিলেন নেহরুকে--বলাবাহুল্য নেহরু সেই চিঠিকে পাত্তা দেন নি। শ্যামাপ্রসাদের ঐ মর্মান্তিক পরিণতি আজও মেনে নিতে পারে নি তাঁর উত্তরসূরী বিজেপি। বিজেপি তাদের দলের প্রতিশ্রুতি হিসেবে সুযোগ পাওয়ামাত্র যে ঐ কালো দুই ধারাকে বিলুপ্ত করবেই এটা শুধু বিজেপি নয় বিজেপি বিরোধী দলগুলোরও অজানা ছিল না।
অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসের এক কলঙ্কিত ভুলকে শোধরাতে পারেন নি শুধুমাত্র সংসদে তাঁর নিজস্ব সেই সংখ্যা ছিল না যার বলে তিনি তা করতে পারতেন। বাজপেয়ী অত্যন্ত দৃঢ় মনের মানুষ ছিলেন--পাশাপাশি প্রগাঢ় স্থিতধীও বটে ! ধর তক্তা মার পেরেক জাতীয় অস্থিরতা তাঁর মধ্যে ছিল না।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী অত্যন্ত সাহসী হলেও বাজপেয়ীর মতো স্থিতধী নন--যেটা করা দরকার বলে মনে করেন--সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিনি তা করে থাকেন। করলেনও তাই। প্রথম সুযোগেই কাশ্মীর থেকে তুলে নিলেন ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা। আক্ষরিক অর্থেই কাশ্মীরের ভারতভুক্তি চুক্তিকে বাস্তবায়িত করলেন মোদী-অমিত শাহ জুটি।
কাশ্মীরে ঢোকার আগে দু’চারটি জরুরি কথা সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই। কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের দরবারে যখন ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন কাশ্মীরের মানুষের মতামত যেমন নেওয়া হয় নি--তেমনই ভারতীয় সংসদে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয় নি। যেমন হয় নি গোয়া-হায়দ্রাবাদ-কোচবিহারের ভারতভুক্তির মুহূর্তেও। অনেকেই ৩৭০-এর সঙ্গে ৩৭১কে এক সারিতে বসিয়ে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য জাহির করতে চাইছেন--তাদের প্রতি বিনম্র পরামর্শ--একটু পড়াশোনা করুন--দুটো যে এক জিনিষ নয় তা বুঝে উঠতে বিষম খেতে হবে না।
ভারতভুক্তির পর কাশ্মীরের প্রথম ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে শপথ নিয়েই শেখ আবদুল্লা পাকিস্তানের হাতে তামাক টানার লক্ষ্যে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা তৈরি করলেন এবং নেহরু-আবদুল্লার রহস্যাবৃত আত্মিক সম্পর্কের সৌজন্যে এই ধারা সংসদকে এড়িয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতি’র স্বাক্ষর-সীলমোহর সহ বলবৎ করে ফেললেন ! কাশ্মীরের মানুষের মতামত নেওয়া হল না--ভারতের সংসদে বিল হিসেবে পেশ হল না--আলোচনা হল না তবু রাষ্ট্রপতির অনুমোদনেই ঐ দুই কালো ধারা বলবৎ হয়ে গেল। তখন গণতন্ত্র-সংসদ-সংবিধানপ্রেমীরা প্রায় নিশ্চুপ ছিলেন কেন এবং আজ-ই বা তারা আর্তনাদ শুরু করলেন কেন তার উত্তর একদিন মহাকাল আদায় করে নেবে।
মন্দের ভাল (বলতে গেলে ভীষণই ভাল) বলতে গেলে ঐ বিলে খুব স্পষ্ট করেই লেখা রয়েছে--এই দুই ধারা চিরস্থায়ী নয় রাষ্ট্রপতি যে কোন মুহূর্তে এই ধারা রদ করতে পারবেন। এখানে সংসদ ও সংবিধানের দোহাই পেরে যতই নাচানাচি করা হোক না কেন--এই বিলুপ্তিকরণ পদ্ধতিকে খারিজ করার ক্ষমতা কারুর থাকছে না। মোদী সরকার সংসদ ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করে কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল রাজ্যসভা ও লোকসভায় পেশ করে বিপুল সমর্থনে পাস করিয়ে নিয়েছে। অনেকেই ভাবছে আদালতে গেলে এই বিল খারিজ হয়ে যাবে। যাবে না--কারণ, এই বিল দেশের আইনসভার দুটি কক্ষেই পাস করানো হয়েছে--রাষ্ট্রপতিও সেটা অনুমোদন করেছেন--এই ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেরও একটা নির্দিষ্ট লক্ষণরেখা রয়েছে যা অতিক্রম করার স্বাধীনতা তার আছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
৩৭০ ও ৩৫এ ধারা কাশ্মীরকে নিজস্ব পতাকা-সংবিধান-আদালতের অধিকার দিয়েছে। যার বলে কাশ্মীরে ভারতের জাতীয় পতাকার কোনও মূল্য নেই। ভারতের সংবিধান কাশ্মীরের মানুষ মানবে না। ১৯৩৪ সালের পর যারা কাশ্মীরে বসবাস শুরু করেছে তাদের ভূমিপুত্র হিসেবে (হিন্দু-খ্রীষ্টান) গণ্য করা হবে না। কাশ্মীরে যে কোন বয়সের মেয়ের বিয়ে বৈধ এবং কোন কাশ্মীরি মেয়েকে বাইরের কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কাশ্মীরিদের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ থাকবে--কাশ্মীরি ও ভারতীয় ! বাইরের কেউ কাশ্মীরে এক ছটাকও জমি কিনতে পারবে না--শিল্প স্থাপনের জন্যেও নয়। বাইরের কেউ কাশ্মীরে কোন ব্যবসা করতে পারবে না--কিন্তু হাজার হাজার কাশ্মীরি শাল ও ফলমূলের ব্যবসা করতে পারবে সারা ভারত জুড়ে। কাশ্মীরের নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠাবে--ওয়েষ্টার্ন কালচারে আমোদ-ফূর্তিও তারা করতে পারবে--কিন্তু নেতাদের নির্দেশে কাশ্মীরি বেকার দরিদ্র যুবসম্প্রদায়কে পাথরবাজ হতে হবে--হাতে পাকিস্তানে তৈরি মরণাস্ত্র তুলে নিয়ে জঙ্গি হতে হবে। ভারতবর্ষ কাশ্মীর রাজ্যটাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কোটি কোটি টাকা (ভারতীয়দের রক্ত জল করা) সরবরাহ করবে কিন্তু কোন হিসেব দিতে বাধ্য থাকবে না কাশ্মীর রাজ্য ! কিন্তু কেন এবং কাদের জন্যে এই ব্যবস্থা ভারতবাসীকে মেনে নিতে হচ্ছে বছরের পর বছর? কি তারা পাচ্ছে? পাওয়া তো দূরের কথা--এখনও পর্যন্ত কাশ্মীরে মৃত্যু হয়েছে ৪১ হাজার ৯০০ সেনাকর্মীর ! এ দায় কার? গত ৭০ বছর ধরে কাদের মেরুদণ্ডহীন রাজনীতির খেসারৎ দিতে হচ্ছে ভারতীয়দের?
’৬৫’র যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেছিলেন--কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কাশ্মীরের ভারতভুক্তি চূড়ান্ত। এই কথাটাই আরও ১৭ বছর আগে নেহরুর বলা উচিত ছিল--যদি বলতে পারতেন তাহলে আজ আদৌ কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল লোকসভা রাজ্যসভায় পেশ করতে হত না। কাশ্মীররাজ হরি সিং ভারতরাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার পর ভারতীয় বাহিনী আততায়ী আজাদ কাশ্মীরি (আসলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী) বাহিনীকে অর্দ্ধেকের বেশি তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েও নেহরু’র নির্দেশে স্বেচ্ছায় যুদ্ধবিরতি স্বীকার করে নিয়েছিল এবং দেশবাসীকে হতচকিত বিমূঢ় করে কাশ্মীর প্রসঙ্গকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কোর্টে তুলে নিয়ে গেল ! এই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘকে মোড়ল মানার মধ্যেই ভারত-পাক বিষাক্ত সম্পর্কের মূল নিহিত রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন নেহরু অ্যাণ্ড কোম্পানী এমন একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
কাশ্মীর আইনসঙ্গতভাবেই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হায়দ্রাবাদ-গোয়া-কোচবিহারের মতোই। কিন্তু সেই আইনসঙ্গত অধিকারকে রক্ষা করতে নেহরু যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞই ছিলেন তাহলে এইরকম হঠকারী কাজ কি খুব যুক্তিসঙ্গত ছিল? একটা দৃষ্টান্ত দিলেই ব্যাপারটা বুঝতে সহজ হবে মনে হয়।
আমার বাড়ির সীমানার মধ্যে যদি আমার প্রতিবেশী কয়েকটা বাঁশ পুঁতে রেখে যায় তাহলে আমি নিশ্চিতভাবেই সেই বাঁশ উপড়ে ফেলে দেব এবং ফের যাতে বাঁশ না পুঁততে পারে সেদিকে কড়া নজর রাখব। আমার এই স্বাভাবিক অধিকার প্রয়োগের জন্যে আমি কখনোই তৃতীয় পক্ষকে মাতব্বরি করার জন্য ডাকব না যদি না আমার প্রতিপক্ষ অত্যন্ত বলশালী হয়। প্রতিবেশী বেশী শক্তিশালী হলে অবশ্য তৃতীয়পক্ষকে ডেকে অনুরোধ করা যেতে পারে--স্যার, দয়া করে আমার এই জায়গা থেকে অনধিকার প্রবেশকারীকে তাড়িয়ে দিতে আমাকে সাহায্য করুন !
এই শেষ পন্থাটি অবশ্য ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য ছিল না। কারণ, ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে আততায়ী মুক্ত করার ক্ষমতা সেদিন ভারতের ছিল। তবু অধিকার রক্ষার স্বাভাবিক ও সঙ্গত সক্রিয়তা থেকে মাঝপথে ভারত কেন প্রতিনিবৃত্ত হয়েছিল তা আজও একটি রহস্য হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। হয়তো চিরকাল রহস্যাবৃতই থাকবে। একটু পরে আমি এই রহস্যের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। 
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.