Header Ads

ঐতিহাসিক ভুলের ঐতিহাসিক সংশোধন যে কোন মূল্যে জরুরি ছিল !! (৩)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

ভারতের বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষমাত্রেই জানেন যে, কাশ্মীর দখলের জন্যেই পাকিস্তান সামরিক শক্তিবৃদ্ধির ওপর নিজেদের অওকাতের চেয়েও বেশি পরিমাণে জোর দিয়ে থাকে এবং ভারতের হাতে বেদম মার খাওয়ার আশঙ্কা থেকেই চীনের সঙ্গে সখ্যতা তৈরির জন্যে বার বার ছোটাছুটি করে।


 ভারত যদি কাশ্মীরের ভারতভুক্তির মুহূর্তেই হায়দ্রাবাদ-গোয়া-কোচবিহারের মতো কাশ্মীরকে পুরোপুরি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করত তাহলে তখনই পাকিস্তান বুঝতে পারত কাশ্মীরের আশা ত্যাগ করাই ভাল--কারণ, কাশ্মীর দখলের একমাত্র উপায় থাকত ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে নামা এবং জয়ী হওয়া--যা কোনভাবেই পাকিস্তানের পক্ষে সেদিনও সম্ভব ছিল না--আজও নেই। কিন্তু ভারতের মানসিক অনিশ্চয়তার কারণেই পাকিস্তানের মনে কাশ্মীর দখলের সম্ভাবনা কোনদিন শেষ হয় নি। এই কারণেই পাকিস্তান বার বার রাষ্ট্রসঙ্ঘ-চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে গেছে। পাকিস্তান ভেবেছে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ভারত ছেলের হাতের মোয়ার মতো কাশ্মীরকে তাদের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু এটা কখনো ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করে নি যে, আইন ও সংবিধাসসম্মতভাবেই কাশ্মীর ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের স্বীকৃতী লাভ করেছে--সুতরাং কাশ্মীর কারুর বাপ-চোদ্দ পুরুষের জমিদারি নয় যে কারুর চাপে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের বেয়াদপি চিরকাল বরদাস্ত করে যাবে। কোথাও না কোথাও এর শেষ দেখা ছাড়া ভারতের সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। পাকিস্তান আলোচনার মাধ্যমে সমাধান কখনো চায় নি (যতই মুখে বলুক না কেন)--কারণ তারা জানে আলোচনার টেবিলে নথিপত্র সহ ভারতের যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্যের সামনে তারা দাঁড়াতে পারবে না। তাই নানান রকমের নাটকের আয়োজন করে তারা আলোচনাকে শর্তের মাধ্যমে বানচাল করার চেষ্টা করে এসেছে। ভারত এতদিনে বুঝতে পারছে--অখণ্ড কাশ্মীর তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড--সেখানে তারা কি করবে না করবে সেটা একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কাউকে নাক গলাতে তারা দেবে কেন? কেউ কেউ কাশ্মীরের জনগণের জন্য ডুকরে কেঁদে উঠছেন--কেউ বলছেন কাশ্মীর কোনকালে ভারতের ছিল না (কল্হন তো দূরের কথা এঁরা একটাও ইতিহাসের পাতা ওল্টান নি, এরা জানেন না--সম্রাট অশোক এবং কনিষ্কের সাম্রাজ্যের মধ্যে কাশ্মীর ছিল কিনা এবং কাশীরের শেষ রাজা গর্নদ বংশের হরি সিং-এর পূর্বপুরুষরা ভারতীয় ছিলেন কি না)--কেউ কেউ এমনও বলছেন--কাশ্মীরিদের ওপর অত্যাচার বর্বরতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তারা ভারতকে আপন ভাবতে পারবে না ! যারা বলছেন তাঁরা কিন্তু এটা বলছেন না--৭ দশক ধরে তারা কাশ্মীরিদের এত আলিঙ্গন-চুম্বন করার পরেও কতটা আপন হতে পেরেছেন? তারা কি ইচ্ছে করেই ভুলে থাকার ভাণ করছেন যে--তাদের আলিঙ্গন-চুম্বনের প্রতিদানে কাশ্মীরে ৪১ হাজার ৯০০ ভারতীয় সেনা শহিদ হয়েছেন?
কাশ্মীর ইস্যুতে অনেকের ধারণা নেহরু শান্তিপ্রিয় ছিলেন বলে কাশ্মীর জয় অসম্পূর্ণ রেখে রাষ্ট্রসঙ্ঘের দরবারে মীমাংসার জন্যে দৌড়ে গিয়েছিলেন। এই আজগুবি ধারণাকে আমি নস্যাৎ করে দিয়ে বলতে চাই--নেহরু অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে আগ্রহী ছিলেন না বটে তবে একমাত্র কাশ্মীর ছাড়া তিনি আর কোন আবশ্যক যুদ্ধ এড়িয়ে যান নি। হায়দ্রাবাদ-গোয়া-কোচবিহার-সিকিমের ভারতভুক্তির সময়ে তিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘের মুখাপেক্ষী হন নি। চীনা আক্রমণের মুখে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। শুধু কাশ্মীর দখলের সময়েই তাঁর হৃদয়ে ভারতের সংহতির চেয়েও শান্তির আকুলতা তীব্র হয়ে উঠেছিল--আমি অন্ততঃ তা মানতে পারছি না।
তাহলে কি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (উপত্যকা) কাশ্মীর ভারতের অঙ্গীভূত হবে কিনা তা নিয়ে তাঁর শংসয় ছিল? এটাও বিশ্বাসযোগ্য কারণ মনে হয় না। কারণ, নেহরু জানতেন, মুসলীম লীগ এবং ইংরেজ সরকারও জানত--ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত বিভাজন হয় নি। কারণ, বিভাজনের পরেও পাকিস্তানে প্রচুর হিন্দু এবং ভারতে কোটি কোটি মুসলমান থেকে গিয়েছিল। ভারতকে নিছকই বিশেষ উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করা হয়েছিল এবং এই বিভাজনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল দুই বিভক্ত অংশের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবেন। ভারত বিভাগ প্রকৃতপক্ষে ‘লিগ্যাল ডিভিশন’ মাত্র হলে কাশ্মীরের আইনসম্মত ভারতভুক্তিই যথেষ্ট ছিল--এ কথা সবাই জানত। কাজেই কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতের মানসিক অনিশ্চয়তার কারণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়। তাহলে আসল কারণটা কি?
কারণটা সত্যি সত্যি রহস্যাবৃত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যে সব গোপন আদানপ্রদান চলে তার প্রকৃত খবর কোনদিনই জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় না। এই অন্তরালবর্তী আন্তঃরাষ্ট্রীয় গোপন আদানপ্রদানের মধ্যেই নিশ্চিতভাবেই কাশ্মীর সমস্যার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে। আগের যে কোন সরকারের চেয়ে কাশ্মীর নিয়ে অত্যন্ত সজাগ ও সংবেদনশীল মোদী সরকার সেইসব আদানপ্রদানের নথিপত্র বিশ্লেষণ করেই এতবড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস দেখাতে পেরেছে বলেই আমার ধারণা। তারা হয়তো নিশ্চিত হতে পেরেছে--কাশ্মীর নিয়ে এই মুহূর্তে ভারত সরকারের গৃহীত কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই টুঁ-শব্দটিও করতে পারবে না আন্তর্জাতিক নেতারা। সেটা বুঝেই আগের সরকারগুলো যে পদক্ষেপের কথা স্বপ্নেও ভাবে নি সেই পদক্ষেপ নিচ্ছে মোদী সরকার। একটা বড় মাপের পরিবর্তনের ধাক্কা জনজীবনে এসে লাগে। কাশ্মীরেও লাগবে--কিন্তু আগেও যেমন সাধারণ কাশ্মীরিদের (মুসলিম) আর্থিক সমস্যা ছাড়া বিশেষ ক্ষতি হয় নি--এখনও হবে না। বরং যত দিন যাবে দরিদ্র বেকার কাশ্মীরি যুব সম্প্রদায় জঙ্গিদের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ পাবে। সমস্যা গভীরতর হবে পাকিস্তানী আতঙ্কবাদীদের হাতের তালুবন্দী পাকপন্থী নেতা-নেত্রীদের।
নানান কারণে কাশ্মীর উপত্যকার সামরিক গুরুত্ব খুব বেশি। ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তান চীন রাশিয়া--এই পাঁচ রাষ্ট্রের সংযোগস্থল হল কাশ্মীর। কাজেই কাশ্মীরের ওপর যে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির তির্যক শ্যেনদৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে তা বলা-ই বাহুল্য। আর এটাও সবাই জানে কম্যুনিজমের বিরোধিতাই মার্কিনী রাজনীতির মূল কথা। কিন্তু আমেরিকার অসুবিধে হল পুরনো পৃথিবী থেকে তার অবস্থান অনেক দূরে। সেখান থেকে কম্যুনিস্ট দেশগুলোর ওপর যথার্থ আঘাত হানা সহজ নয়। কাজেই তার লক্ষ্য হল প্রধান দুই কম্যুনিস্ট দেশের চারিদিকে বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলিে মধ্যে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা। প্রয়োজনে সেই সব ঘাঁটি থেকে আক্রমণ করা সহজ হবে। ফলে অনুমান করা শক্ত নয় যে সামরিক গুরুত্বের বিচারে কাশ্মীর আমেরিকান যুদ্ধঘাঁটি নির্মাণের পক্ষে খুবই উপযোগী।
ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভাল করেই জানে যে কাশ্মীর যদি পাকিস্তানের দখলে থাকে তাহলেই যুদ্ধঘাঁটি নির্মাণের জন্য সহজলভ্য হবে। তারা আরও জানে--স্বাধীন ভারতের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির ফলে। কাজেই পাকিস্তান যে পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা দিতে রাজি থাকবে ভারত বন্ধুত্ব বজায় রাখলেও ততটা সহযোগিতা দেবে না। কাজেই কাশ্মীর পাকিস্তনের দখলে আসুক এটাই ছিল ইঙ্গ-মার্কিন জোটের অভিপ্রেত। সম্ভবতঃ তাদের গোপন প্ররোচনাতেই একদিন কাশ্মীর দখলের আয়োজন করেছিল পাকিস্তান এবং তখন থেকেই তার কাশ্মীর দখলে নেওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু। কিন্তু কাশ্মীররাজ হরি সিংয়ের ভারতে যোগদানের ফলে এক আকস্মিক বাধা দেখা দেওয়ায় পুরোপুরি সে স্বপ্ন পূরণ না হলেও নেহরুর শুভেচ্ছা মাথায় নিয়ে শেখ আবদুল্লা কিছুটা হলেও কাশ্মীরের অংশ পাকিস্তানকে উপঢৌকন দিতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি এটাও চরম সত্যি যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করার মতো শক্তি এবং সাহস সেদিন নেহরুর ছিল না। (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.