হে পিতামহ, আপনি কি ভারতীয় ছিলেন?
আশীষ কুমার দে, বেঙ্গালুরু : এই মাসের শেষ দিকে কয়েক লক্ষ আসামবাসী জানতে পারবেন তাদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছেন কিনা। যারা ৩১শে আগস্ট এনআরসি-র তালিকায় থাকবেন না, তাদের সরকার দ্বারা গঠিত Foreigners Tribunal-এর সম্মুখীন হতে হবে। এই তাদের শেষ সুযোগ নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার। এরপরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে গেলে আর্থিক ক্ষমতা থাকতে হবে। এরপরেও যদি অকৃতকার্য হন, তাহলে তাদের জন্য জেল হেফাজত ও বাংলাদেশে প্রত্যার্পণ। এ বিষয়টি মনে হয় খুব সরল প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে অবৈধভাবে বসবাসকারী বা মাইগ্রান্টসদের চিহ্নিত করে নির্বাসিত করা। যারা আসামের আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি করছেন ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার পক্ষে ক্ষতিকারক।
কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী এদের 'উইপোকা' ও 'অনুপ্রবেশকারী' বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এদের 'ব্যাগ গুছিয়ে' পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বধ্যপরিকর। মহামান্য উচ্চতম ন্যায়ালয় এদের চিহ্নিত করে আটক করার বিষয়ে তৎপর। ১৯৮০ সাল থেকে এযাবৎ এক লক্ষ সতেরো হাজার বাংলাভাষীকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা অনেক বেশী। রোহিণী মোহন একজন স্বাধীন সাংবাদিক, তথ্য জানার অধিকার আইনের মাধ্যমে তিনি ২০১৮ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত একশোটি ট্রাইবুনাল-এর রায়ের কপি চেয়েছেন। কপিগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ অভিযুক্তকে বিদেশী সনাক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে এই ট্রাইবুনালের রায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই একতরফা যদিও এই প্রথম ট্রাইবুনালের রায়কে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে যা আগে কখনও হয়নি। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঁচটি গুরুতর বিষয় উঠে এসেছে। যা সত্যিই আশঙ্কাজনক।
১) ১১৩ জন অভিযুক্তের মধ্যে প্রতিজন বাংলাভাষী। উকিল জজ সবাই বাঙালি।
২) মুসলিমদের বিদেশী চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায় অসমঞ্জতা দেখা যাচ্ছে যা অভিযুক্তের ৮৩ শতাংশ। মুসলিমদের দশ জনের মধ্যে নয়জন ও হিন্দুদের চারজন। ৩) রায়গুলির মধ্যে ৭৮ শতাংশ আদেশ একতরফা (ex-parte), তার মানে অভিযুক্তকে তার পক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি বা ট্রাইবুনালের সামনে হাজির হননি।পুলিশের বক্তব্য, এই অভিযুক্তদের সমন পৌছানো সম্ভব হয়নি, তারা তাদের ঠিকানায় থাকেন না অথবা অন্যত্র চলে গেছেন। মানবাধিকার কর্মীদের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে এদের সমন দেওয়া হয়নি। এরা সবাই নিজের নিজের বাসস্থানেই ছিলেন ।
৪) এই ট্রাইবুনালে অভিযুক্তকে তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রমান করতে হবে তার বৈধতা, যা ফৌজদারি মামলার বিপরীত।তিনি যতক্ষণ না নিজের বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন ততদিন তাকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে। অভিযোগকারীর কোনো দায়িত্ব নেই তার অভিযোগ প্রমাণ করার।
৫) অনেক অভিযুক্ত যারা এই ট্রাইবুনাল থেকে সসম্মানে মুক্তি পেয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নতুনভাবে অভিযোগ দায়ের করে হেনস্থা করা হচ্ছে।
সামসুল (আসল নাম নয়) একজন পঞ্চাশ বছর বয়সী ব্যবসায়ী, তাকে ২০০৫ সালে এই ট্রাইবুনাল মুক্তি দেয়। ২০১৬ সালে আবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। তার প্রশ্ন, গত দশ বছরের মধ্যে তিনি কিভাবে আবার অবৈধ নাগরিক হলেন। এবারও তিনি মুক্তি পান। তারপরও তার নাম এনআরসির তালিকায় নেই। যদিও কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রালয়ের দাবী এই ট্রাইবুনালের কাজকর্মের পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটি নেই তবে বাস্তবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কিছু কিছু ট্রাইবুনাল নির্ধারিত প্রটোকল মানলেও অন্যেরা তা মানেন না। একটি ট্রাইবুনাল প্রতিটি অভিযুক্তকে বিদেশী আখ্যা দিয়েছেন, অন্য একটি সব অভিযুক্তকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কোথায় কি ধরনের প্রমাণ গ্রহণ করা হবে, দলিলে কি লেখা হবে, মাতৃকুলের তথ্য গ্রহণযোগ্য কিনা তা নির্ভর করে জজের উপর। কোন কোন জজ নামের বানান, বয়স, পদবী এবং উপাধিকে বিশেষ করে বিবাহিতা মহিলাদের ক্ষেত্রে যুক্তিযোগ্য সমর্থন মনে করেন। অনেকেই মনে করেন এই কেরানিকৃত ভুল বিদেশী গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই আইনের জাঁতাকলে পিষছেন বেশীরভাগ অশিক্ষিত মহিলারা, বয়স্ক মানুষ ও হতদরিদ্ররা।বিশেষ করে প্রত্যন্ত চর অঞ্চলের মানুষেরা, বন্যার সময় জলে ডুবে থাকা এলাকার বাসিন্দারা। সরকারি ত্রুটিপূর্ণ নথিপত্র ও রেকর্ড এদের বৈধ নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কমবয়সী বিবাহ, শিশুদের জন্মের প্রমাণপত্র তৈরী করতে না পারা ও স্কুলে ভর্তি না হতে পারার ফলে বয়স প্রমাণ করতে অপারগতা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাইবুনালের শীর্ষে আছেন আইনজীবী ও আমলা। আসাম বর্ডার পুলিশ নামের একটি বিভাগ থাকলেও তা সীমান্তে না থেকে জেলা ও শহর থেকে কাজ পরিচালনা করেন। এবং বিনা অনুসন্ধানে অভিযোগ দায়ের করেন,
গ্রামের মুরুব্বী ও গাও বুড়াদের মতামত নেওয়ার ধার ধারেন না।
এনআরসির প্রক্রিয়ার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, তত চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কয়েক লক্ষ বাংলাভাষীদের কপালে। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের এই ত্রুটিপূর্ণ একপেশে ট্রাইবুনালের সামনে হাজির করা হবে। এবং এরাই নির্ধারিত করবে কয়েক লক্ষ আসামের লোক পরিবার ও জমি জায়গা নিয়ে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকতে পারবেন কি না? কেন্দ্রীয় সরকার এদের পাকাপাকি ভাবে বিদেশী চিহ্নিত করতে একহাজার নতুন ট্রাইবুনাল গঠন করতে প্রস্তুত।ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরী হচ্ছে আরো দশটি।
সরকারের উচিত নতুন ট্রাইবুনাল গঠন না করে বর্তমানের 'ফরেন ট্রাইবুনালের' কর্মপদ্ধতিকে ত্রুটিমুক্ত করা ও বিচার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল করা। একটি মানবিক ও গ্রহণযোগ্য প্রটোকল তৈরী করা, যা প্রচলিত দন্ডবিধির পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। পুলিশকে প্রমাণযোগ্য অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা বা অভিযুক্ত করা থেকে বিরত থাকা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নিয়ম বলবৎ করা জরুরি। বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মতে, ট্রাইবুনালের বিচারকদের আইনি অভিজ্ঞতার অভাব আছে। ভারতবর্ষে কয়েক দশক ধরে সরকারি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ, এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের। যারা নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করতে অপারগ থেকে সহজেই অবৈধ নাগরিক হিসেবে তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ট্রাইবুনালের নিয়মে আমাদের দেশের অনেক পূর্বপুরুষ তাদের বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না ।।
কোন মন্তব্য নেই