আজ বাইশে শ্রাবণ !! মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের / মূল্য দিতে হয় / সে প্রাণ অমৃতলোকে / মৃত্যুকে করে জয়।
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
.’।
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুকে বড় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মাত্র
একচল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগের মধ্য দিয়ে। কবি যখন দূরে থাকতেন স্ত্রী
মৃণালিণী দেবীকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কবির সেই ‘ছুটি’ যখন
সংসার জীবন থেকে সত্যিই একদিন ছুটি নিয়ে চলে গেলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র
ঊনতিরিশ !
কিশোর বয়সের গাঢ় বন্ধুপ্রতিম বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু
ও আরও পরে স্ত্রীর মৃত্যু এবং একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী ও
মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভে সহায়ক হয়েছিল।
কবি
জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যুশোক’ পর্যায়ে অকপটে লেখেন, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং
সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া
দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের
ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড্ড মনোহর।’ আজ ২২ শে শ্রাবণ । বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৭ তম প্রয়াণ দিবস।
বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা
নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের অবাধ বিচরণ নেই। সাহিত্যকর্মের সূচনালগ্নে তিনি
বলেছিলেন , ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান। মৃত্যু-অমৃত করে দান। তুহুঁ মম
শ্যামসমান’! তিনিই আবার কিছুকাল পরে বলছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর
ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’! জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৬১ সালে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। আর তাঁর প্রয়াণ ঘটে ১৯৪১ সালে। এই দীর্ঘ জীবনে
রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা
করে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে।
তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ
ঠাকুর, আর বাবা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবড়ির বিশাল
চৌহদ্দিতে রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছিলেন ভৃত্যদের হাতে। জমিদার বাড়ির নানান
নিয়মকানুনে শিশু রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। সেই কড়া নিয়ম
কানুনে শিশু রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি দেখতেন অনেক দূর থেকে জানালা দিয়ে । সেই
জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্য নিয়ে তিনি লিখলেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে .., বৃষ্টি পড়ে
টাপুর টুপুর নদে এল বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যে দান! মনে করো
বিদেশ থেকে ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে!-- ইত্যাদি অসাধারণ শিশুতোষ
কবিতা। শিশু বয়স থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি নিজের সাহিত্য
প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসক ছিলেন। শৈশবে কবি পিতার সাথে
হিমালয় দর্শনে যেতেন। তপোবনের মুনি ঋষিদের ধ্যানী চেতনা তাঁর সৃষ্টি কর্মে
ঘুরে ঘুরে এসেছে নানান ব্যঞ্জনায়। এছাড়াও বৈষ্ণব কবিদের রচনা, শ্রী
চৈতন্যদেবের, লালন ফকিরের প্রভাব তাঁর সাহিত্যকর্মকে সমৃদ্ধ করেছে ।
বিশ্বপ্রকৃতি , প্রেম ,আত্মনিবেদন, পূজা, নারী, জীবন দেবতা, সমকালীন
সমাজব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ ও বিরহ মিলনের চিত্র অত্যন্ত
সার্থকভাবে আমরা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে দেখতে পাই। ১৯১৩ সালে তিনি
‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের
দর্শন ছিল সীমা আর অসীমের তত্ত্ব। সীমার মাঝে বসে অসীমকে বাবরবার ধরতে
চেয়েছিলেন। কবিতায় লিখেছিলেন ‘এ চির জীবন তাই, আর কোন কাজ নাই রচি শুধু,
অসীমের সীমা / আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে, তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী
প্রতিমা’ আবার বলছেন ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’!
তাঁর রচিত
সন্ধ্যা সংগীত, প্রভাত সংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, সোনার তরী, চিত্রা,
চৈতালী,কণিকা, ক্ষণিকা, কল্পনা, পূরবী, খেয়া, নৈবেদ্য, বলাকা প্রভৃতি
কাব্যগ্রন্থে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যাঙ্গন। একবার কল্পনার পাখায় ভর করে উড়াল
দিয়েছেন স্বপ্নপুরীর মনোজগতে, আবার একবারে মর্ত্যে নেমে এসে সাধারণ মানুষের
সুখ দুঃখ ও মিলন বিরহের মাঝে ডুব দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ঘরে
বাইরে, চোখের বালি, গোরা। নাটক রক্ত করবী, নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, তাসের
দেশ, কালমৃগয়া প্রভৃতি। আর অসংখ্য সার্থক ছোট গল্প ঠাঁই পেয়েছে গল্পগুচ্ছে।
সমসাময়িক সমস্যা, রাজনৈতিক সংকট, শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি ও
কুসংস্কারকে সমাজ থেকে দূর করতে তিন প্রচুর প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ আশি
বছরের জীবৎকালে মনে হয় একটি দিন ও তিনি বিরত থাকেননি সাহিত্যরচনা থেকে।
তাঁর স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ শান্তি নিকেতনে বসে ১৯৪১ সালের ৩০ বৈশাখ লিখেছিলেন
:
‘ প্রথম দিনের সূর্য, প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাকে কে তুমি ?
মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল। দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল,
পশ্চিম সাগর তীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--কে তুমি ? পেল না উত্তর–’!
জীবনের শেষ নববর্ষে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে। সে দিন
তাঁর কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও ক’দিন পর
১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি
হারা’।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি
শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভাল। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই,
শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ তিনি গ্রহণ করেন
তার উদয়ন গৃহের পূবের জানালার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে
ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠে কবিরই লেখা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ,আজি
প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।’
জানা যায়, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে
পর্যন্তও কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। জোড়াসাঁকোয় রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলতেন
রানী চন্দ তা কবিতার ছন্দে লিখে নিতেন। কবি বলে গেছেন, ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে
পরেছিলেন কবিতাটি বলতে বলতে। দিনটা ছিল কবির শেষ বিদায়ের কয়েক দিন আগে ১৪
শ্রাবণ। রানী চন্দ সে দিন সূত্রধরের মতো লিখেও নেন রবীন্দ্রনাথ উবাচ
কবিতাটি ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’।
রবীন্দ্রনাথের
মৃত্যুর বর্ণনা পাওয়া গেছে এভাবে --আগস্টের প্রথম দিন দুপুরবেলা থেকেই
রবীন্দ্রনাথের হিক্কা শুরু হয়। আগস্টের ৩ তারিখ থেকে কিডনিও নিঃসাড় হয়ে
পরে। ৬ আগস্ট রাখি পূর্ণিমার দিন কবিকে পূর্বদিকে মাথা করে শোয়ানো হল।
পরদিন ২২শে শ্রাবণ, ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মন্ত্র জপ করা হয়
ব্রাহ্ম মন্ত্র ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম..’ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়....
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন মৃত্যু পথযাত্রী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন
২২শে শ্রাবণের বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। কবি চলে গেলেন অমৃত আলোকের নতুন
দেশে !
কোন মন্তব্য নেই