Header Ads

ঐতিহাসিক ভুলের ঐতিহাসিক সংশোধন যে কোন মূল্যে জরুরি ছিল !! (২)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

কাশ্মীর সমস্যার গভীরে ঢোকার আগে আরও দু’চারটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে কাশ্মীর মুসলিম শাসিত বা অধ্যুষিত রাজ্য ছিল না। কাশ্মীরের রাজধানী আধুনিক শ্রীনগর-এর বয়সও ১২/১৩’শ বছরের কম নয়। কাশ্মীরের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে কল্হনের রাজতরঙ্গিণীকেই মান্যতা দেওয়া হয়। চীনা পরিব্রাজকদের লেখা গ্রন্থ থেকেও কাশ্মীরের ইতিহাস অনেকটাই জানা যায়। যাদের ‘নীরস ইতিহাসের কচকচানি’ পছন্দ নয় তাদের অবশ্যই পাঠ করা উচিত সুবোধ চক্রবর্তীর ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ ভ্রমণউপন্যাসের কাশ্মীর পর্বটি। এখানে লেখক কোনরকম আরব্যরজনী মার্কা লেখা পরিবেশন করেন নি। রীতিমতো তথ্য-পরিসংখ্যান সহ কাশ্মীরের ধারাবাহিক ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রশংসনীয় কাজ করে গেছেন। কোনরকম ‘বায়াসনেস’ তাঁর লেখায় ছিল না। তাই এই মুহূর্তে ঐ বইটি আগ্রহীদের অবশ্যপঠ্য বলে আমি মনে করি। কাশ্মীরের ভৌগোলিক চেহারাটা লক্ষ্য করলে একটু অবাক হতেই হয়।
অখণ্ড কাশ্মীর রাজ্যের দুটি প্রভিন্স বা প্রদেশের একটি হল জম্মু এবং অন্যটি হল কাশ্মীর। এই দুই প্রদেশের জেলার মোট সংখ্যা ছিল আট--কাশ্মীরের শ্রীনগর-বারামুলা-অনন্তনাগ-লাদাখ এবং জম্মুর--জম্মু-কাঠুয়া-উধমপুর-ডোডা। সাংস্কৃতিক বিচারে কাশ্মীরকে সমাজবিজ্ঞানীরা তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন--জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ। জম্মু চিরকালই হিন্দু প্রধান, একসময়ে--শেখ আবদুল্লা ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে পর্যন্তও কাশ্মীরে হিন্দুদের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। অন্যদিকে লাদাখীদের ধরনধারণ ছিল অনেকটাই তিব্বতীদের মতো--ফলে জম্মু সহ লাদাখের বিপুল এলাকায় আজও মুসলিম কাশ্মীরিরা প্রধান অধিবাসী নয়।
এটা তারা উপলব্ধি করে বলেই ভেতরে ভেতরে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং উপত্যকা থেকে অমুসলিমদের নানাভাবে উৎখাত করে আসছে।
এই প্রবণতাটা তৈরি হয় তথাকথিত আজাদ কাশ্মীরি বাহিনীর (আদতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী) আগ্রাসনের মুহূর্ত থেকেই। অনেকের ধারণা--শেখ আবদুল্লা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং তার জন্যেই নাকি কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে ! কিন্তু ইতিহাস এই ধারণাকে সমর্থন করছে না। প্রথমতঃ আবদুল্লা গোষ্ঠী যে কোন উপায়ে হরি সিংকে ক্ষমতাচ্যুত করে কাশ্মীরের রাজপাট হস্তগত করার লক্ষ্যেই তাদের ঘুঁটি সাজিয়ে আসছিল। আগেই বলেছি, আবদুল্লা-নেহরু সম্পর্কের মধ্যে একটা রহস্যাবৃত আত্মিক সম্পর্ক থাকার কারণে আবদুল্লা নেহরুর উদার পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরকে হাতের মুঠোয় তুলে আনার চেষ্টায় সফল হতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে হরি সিং মনপ্রাণে মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধ অবস্থানে থেকে পকিস্তানের সঙ্গে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন নি। ফলে তিনি ভারতের সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। আবদুল্লাও পাকিস্তানের অধীনে যেতে চান নি--কারণ তিনিও জানতেন ইসলামাবাদ (বিশেষ করে প্রবল শক্তিশালী পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা) তাঁকে কাশ্মীরের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করবে না। কিন্তু যদি ভারতের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত থাকা যায় যাতে ভারতের সঙ্গে থেকেও ভারতের অধীনতা মানতে না হয়। কাশ্মীরের ভারতভুক্তি তাই চূড়ান্ত সাংবিধানিক নিয়মেই হয় বটে--কিন্তু আবদুল্লার লীলাখেলাটা শুরু হল তার পরেই। পাকিস্তানের সৌজন্যে হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনে কাশ্মীরের একটা অংশ বেদখল হলেও ঐ বেদখল ভূখণ্ড কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে পাকিস্তান এবং আবদুল্লা বাহিনী। কাশ্মীরের ইতিহাসে সেই প্রথম মুসলিম নেতাদের হাতে রাজ্যের শাসন ভার চলে যায়। কাশ্মীরকে মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ হিসেবে দেখানোর তাগিদে শুরু হয় ব্যাপক হারে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশ। শুরু হয়ে যায় অমুসলিম অধিবাসীদের ওপর নির্মম অত্যাচার। ভিটেমাটি ছেড়ে দলে দলে তাদের কাশ্মীর ছাড়তে হয়। মুসলিম জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।
এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতেই আবদুল্লা ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার পরিকল্পনা করেন। নেহরুর সৌজন্যে এই কুখ্যাত দেশবিরোধী ধারা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে--সংসদে আলোচনা বা বিল পাস প্রথাকে এড়িয়ে--কাশ্মীর ও ভারতীয়দের মতামত না নিয়েই বলবৎ হয়ে যায়। এখনও কিছু অর্বাচীন মুর্খ-পণ্ডিতরা এর মধ্যে গণতন্ত্র-সংবিধান-জনমতামত-এর পূত পবিত্র সুগন্ধ টের পাচ্ছেন-- অথচ অগণতান্ত্রিক সংসদঅবমাননা জনমত অস্বীকারের দুর্গন্ধ টের পাচ্ছেন এই দুই ধারা প্রত্যাহারের মুহূর্তে ! ধারা বলবৎ-এর চুক্তিইে স্পষ্টভাষায় উল্লেখ ছিল--এই দুই ধারা চিরস্থায়ী নয় এবং রাষ্ট্রপতি যে কোন মুহূর্তে তা রদ করতে পারেন--তবুও নাকি তা অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধান বিরোধী ! যাইহোক, এবারে মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।
যে অধিকার ভারত নিজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারত সে অধিকারের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘকে মোড়ল মানার কারণে ভারতবাসীর মনে হয়েছিল--কাশ্মীরের অধিকার সম্পর্কে আমাদের মন দ্বিধামুক্ত নয়। কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকে আমরা চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় মনে করছি না। বিশ্ববাসী রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও পাকিস্তানকে এ কথাই ভাবতে সুযোগ দিয়েছি যে, কাশ্মীর একটি ‘ওপেন কোয়েশ্চেন’ অর্থাৎ বিতর্কিত প্রসঙ্গ ! বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীর সম্পর্কে রাষ্ট্রসঙ্ঘে যে মুরুব্বিয়ানা প্রকাশ পেয়েছে তার লক্ষ্য এটা ছিল না যে, কাশ্মীরকে কি করে হানাদার-আততায়ী মুক্ত করা যায়--আলোচনার লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ--এবং সেটা বার বার কুখ্যাত কালা ধারার সামনে এসেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ! তাই এই মুহূর্তেও কংগ্রেস সংসদীয় দলনেতা এই বিষয়টিকে অসঙ্কোচে আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করার ধৃষ্টতা দেখাতে দু’বার ভাবেন নি !
ভারতীয় অবিজেপি নেতাদের এই মানসিক অনিশ্চয়তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত বিষাক্ত আবহকে লালন করে চলেছে। এই মানসিক অনিশ্চয়তা এত গভীর যে ভারত কাশ্মীরকে একটি বিতর্কিত ইস্যু বলে কার্যতঃ মেনেই নিয়েছিল। তাই কোন একটা সম্ভাব্য সমাধানকেই জোরের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করতে পারে নি। ভারতের শত্রু, অল্পস্বল্প মিত্র নির্বিশেষে সাধারণ বুদ্ধিতে কাশ্মীরের চারটি বিকল্প সমাধান সামনে উঠে এসেছে--১) কাশ্মীর চূড়ান্তভাবে ভারতের তাই অনধিকার প্রবেশকারীদের অপসারণ করতে হবে। ২) গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরবাসীদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ। ৩) স্বাধীন সার্বভৌম কাশ্মীর। ৪) বর্তমান যুদ্ধবিরতি রেখা বরাবর কাশ্মীর বিভাজন। কাশ্মীর প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘে লক্ষ লক্ষ কথার তুফান ছুটলেও এই চারটি (ভারতের কাছে প্রথমটি ছাড়া বাকি তিনটিই অপ্রাসঙ্গিক) সমাধান ছাড়া অতিরিক্ত আর একটাও অলৌকিক সমাধাানের ইঙ্গিত কেউ দিতে পারে নি।
প্রথম সমাধানটি ভারতের পক্ষে গ্রহণ যোগ্য হলেও বাকি তিনটির একটিও গ্রহণযোগ্য তো নয়-ই বিবেচনাযোগ্যও নয়। কারণ, এর একটিকেও সমর্থনযোগ্য মনে করলে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি অসংবিধানিক হয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে কাশ্মীরের মর্যাদা আর ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মর্যাদা এক নয়। নেহরু-আবদুল্লার সৌজন্যে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার কল্যাণে কাশ্মীর ভারতের পালিতপুত্রের মর্যাদার অধিকারি হয়েছে। ফলে এই পালিতপুত্রটি যাতে ঘর ছেড়ে না পালায় তার জন্যেই হাজার হাজার কোটি টাকা খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হয় নিঃশর্তে ! কিন্তু খয়রাতি সাহায্যের বিপদ এই যে, তা অবিলম্বেই হকের পাওনা বলে গণ্য হয় এবং তা কখনো পরকে আপন করে না। ফলে কাশ্মীরিরা আজও নিঃশংসয়ে এ কথা ভাবতে আগ্রহী নয় যে, তারা ভারতের নাগরিক। দেনা-পওনার মনোবৃত্তি নাগরিকত্বের ভিত্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পায় নি। তাদের বিশ্বাস ভারতের সঙ্গে শুধু তাদের পাওয়ার সম্পর্ক--বিশেষ করে যেহেতু টাকার জোরে ভারত তাদের আনুকূল্য কিনতে এত ব্যগ্র সেহেতু তাদের ধারণা টাকা নিয়ে তারা ভারতকে কৃতার্থ করছে ! বলা বাহুল্য--এ ধরণের মনোভাব সুস্থ জাতীয়তাবাদী নাগরিকত্বের একেবারেই পরিপন্থী।
প্রকৃতপক্ষে, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কাশ্মীর প্রসঙ্গ রাষ্ট্রসঙ্ঘে তুলে বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীর বিতর্কে অংশগ্রহণ করে কাশ্মীরকে ভারতের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সমপর্যায়ভুক্ত (৩৭০ ও ৩৫এ ধারার প্রতিবন্ধকতায়) বলে গণ্য না করে ভারত বিশ্ববাসীকে এবং পাকিস্তানকে ভাববার সুযোগ দিয়ে এসেছে যে কাশ্মীর একটি ‘ওপেন কোয়েশ্চেন’। ফলে পাকিস্তান যদি মনে করে থাকে যে ভারতের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারলে কাশ্মীর তাদেরই হস্তগত হবে তাহলে তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় কি?
এই অলীক আশার বশবর্তী হয়েই পাকিস্তানের ক্ষমতাপ্রিয় শাসনকর্তারা তাদের সমস্ত অর্থনৈতিক সামরিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কুচকাওয়াজকে কাশ্মীর দখলের লক্ষ্যে বিন্যাস করে আসছে। কাশ্মীরের ভেতর থেকে ভারতবিদ্বেষী শক্তির সাহায্যও তারা পাচ্ছে বা আদায় করে নিচ্ছে। নিয়মিত জঙ্গি হামলা চালিয়ে এবং স্থানীয় বেকার ও আত্মধ্বংসী ও উচ্চাকাrঙ্ক্ষী সন্ত্রাসী নেতাদের কব্জা করে পাকিস্তান কাশ্মীরকে আতঙ্কবাদীদের স্বর্গ বানাবার চেষ্টা করে আসছে। মোদী সরকার পাকিস্তান ও ভারতের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর এই শয়তানির শেষ চেয়েই যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে যুক্তিসঙ্গত কারণেই যেমন কিছু শয়তানি মগজ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে তেমনই ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ খুশিতে ফেটে পড়ছেও বটে ! (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.