৭০ তম বন মহোৎসব নিয়ে কিছু কথা
বেঙ্গালুরু থেকে লিখেছেন আশিষ কুমার দে
গত ১লা জুলাই, শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ৭০তম বন মহােৎসব ; ১৯৫০ সালে প্রয়াত কুলপতি কানহাইয়া লাল মুনসী, তদানীন্তন কৃষিমন্ত্রী এই দেশব্যাপী বৃক্ষরােপনের সূচনা করেন। এই সময়কে বেছে নেওয়ার কারণ দেশে সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাটীতে গাছ লাগালে তা সহজেই বেঁচে ওঠে। কয়েকলক্ষ চারাগাছ এই সময়ে লাগানাে হয় ও বিতরণ করা হয় বনবিভাগের পক্ষ থেকে। বন সৃজনের এই বিশাল যজ্ঞ সম্পর্কে কিছু বলার অবকাশ আছে।
“অরন্য দয়া এবং বদান্যতার এক অপুর্ব জৈববৈচিত্র, যা নিজের বেঁচে থাকার রশদ জোগার করে ও অপরকে বেঁচে থাকার শক্তি ও সুরক্ষা দেয়, যে কাঠুরিয়া তাকে কাটবে তাকেও ছায়াদান করে’: গৌতমবুদ্ধ।
ছবি, সৌঃ আন্তৰ্জাল
মৎস্যপুরাণে একটি অধ্যায় সম্পূৰ্ণরূপে বৃক্ষরােপনের ওপর রচিত, বৃক্ষরােপনের উৎসবকে সেকালে ‘বক্ষোৎসব’ বলা হত, কথিত আছে যে একটি বৃক্ষরােপণ করলেও স্বৰ্গীয় আর্শীবাদ তার ওপড় বর্ষিত হত । বৃক্ষের সবুজ উৎসবকে আমি ভীষণ ভাবে উপভােগ করি। বৃক্ষরােপন করে সবুজের বিস্তৃতির প্রচেষ্টা আমরা করে থাকি । কত প্রজাতির বৃক্ষ । প্রত্যেকের আছে নিজস্ব স্বত্বী, স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট , ব্যক্তিত্ব । প্রত্যেক মানবসত্বা যেমন একক, বৃক্ষও ঠিক তেমনই । এই বৈশিষ্ট উপভােগ করে আমরা বৃক্ষকে বেশি মাহাত্ম দিতে পারি। এটাই বৃক্ষের প্রাপ্য। বৃক্ষ আমাদের কি না দেয় ? প্রাণ ধারণ করার জন্য অক্সিজেন, শারীরিক বৃদ্ধিরজন্য খাদ্য, শক্তি আহরনের জন্য সুস্বাদুফল, মানসিক ও স্বাত্বিক সন্তুষ্টির জন্য ফুল, বাসস্থানের জন্য কাঠ ও রােগের নিরাময়ের জন্য ঔষধ । সূর্যের তাপ এবং বৃষ্টির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে বৃক্ষ। পায়ের নীচে সবুজ ঘাসের গালিচা, প্রাকৃতিক ভাবে বায়ু বিশুদ্ধ করে আমাদের বেঁচে থাকার নির্মল পরিবেশ দেয়। এসকল দানের প্রতিদানে আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকা উচিৎ বৃক্ষের প্রতি।
হাজার বছর পূর্বে মানুষ গাছকে ভালােবাসতো, শ্রদ্ধা করতো, পুজোও করতো। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনধর্মে বৃক্ষের একটি স্বতন্ত্র স্থান আছে । ঋষি, মুনিরা ধ্যান করার জন্য পৰ্বত - পাহাড় বা অরণ্যে প্রবেশ করতেন। গাছের ফল দিয়ে নিজেদের শরীর ধারন করতেন এবং ছাল দিয়ে তনু ঢাকতেন। যখন লেখা শুরু হলাে তখন গাছের ছাল বা ভােজপত্রে বেদ-পুরান ও পৌরানিক কথা লিখে রাখা হয়েছিল । গৌতমবুদ্ধ নিৰ্বানলাভ করেছিলেন একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে, যাকে আমরা বােধি বৃক্ষ বলি।
বৃক্ষেরও জীবন আছে, মাটি, জল, বায়ু ও সূর্য রশ্মী থেকে নিজের আহার সংগ্রহ করে, মানুষের মতন শৈশব, কৈশাের এবং যৌবন প্রাপ্তি করে। ফুলে-ফলে তার জীবন উদ্ভাসিত হয়। কালের নিয়মে ক্রমাগত জরাগ্রস্ত হয়। অবশেষে এই পরােপকারী এবং অপরের জন্য নিবেদিত প্রাণের সমাপ্তি ঘটে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের মতন বৃক্ষের চারা, বীজ প্রতিটি প্রজাতির পরিচয় বহন করে। এক জায়গায় নিশ্চল হয়ে থাকা বৃক্ষ নিজের কাজ করে চলে। যদিও এর শাখা-প্রশাখা, লতা যেন চলা ফেরা করে, যেন অন্য বৃক্ষগুলিকে স্পর্শকরে বা তার নিকটে পৌঁছনাের চেষ্টা করে। আমাদের ছায়া ও অক্সিজেন দেওয়া, বৃক্ষও কিন্তু কাঁদে। বৃক্ষ কাটার সময় যে আওয়াজ আমরা শুনি তাকি তার কান্না নয় ? আবার বৃক্ষ আনন্দ করে ও অন্যকে আনন্দ দেয়।
সূর্যের আলােকে পাতাগুলি ঝলমল করে ওঠে ও হাসতে থাকে, ফুলফুটে একাকার হয়। জীবজগতকে ফুল দিয়ে তাদের জীবন ধন্য করে। এভাবেই বৃক্ষ নিজের সুখ-আনন্দ নিজে অনুভব করে ও আমাদের উপহার দেয়। রাতে বৃক্ষ বিশ্রামনেয় সন্ধ্যার পর থেকেই বৃক্ষ শান্তহয়ে পরে। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষ বৃক্ষের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারেনা। নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থ সিদ্ধি করতে বৃক্ষের ওপড় নির্বিচারে অত্যাচার চালায়। এই অপকারী মানুষদের বৃক্ষ কিন্তু ছায়া এবং ফল থেকে বঞ্চিত করে না । যতই ঝর-বৃষ্টি আসুক বৃক্ষ স্থির হয়ে থাকে। বৃক্ষের ডালে বাসা বাঁধা পাখিও তার সঙ্গ দেয়। আমাদের জীবনের বন্ধু বৃক্ষ ।
মন খারাপ হলে বা মনের কথা বলতে হলে আমরা বৃক্ষের কাছে চলে যাই বা মনের কোনাে চাপাকথা বৃক্ষের কাছে বলে মন হাল্কা করি । প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের ভাব আদানপ্রদান করে বৃক্ষের নীচে বসে। স্বাস্থ্যবান বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে আমরা নিজেদের মধ্যে প্রাণ শক্তি আহরণ করি। বাড়ির চৌহদ্দিতে থাকা একটি পরিনত নীম বৃক্ষ যেন আমাদের অভিবাবক, এর হাওয়া ও ছায়া আমাদের রােগ থেকে রক্ষা করে একজন চিকিৎসকের মত । বৃক্ষের এত উপকারিতা আমাদের পূৰ্বপুরুষেরা উপলব্ধি করেছিলেন, উঠানের মাঝখানে তুলসীর চারা লাগানাের প্রচলন করেছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস তুলসী বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করা বা স্পর্শকরলে শরীরে বা দেহমনে শক্তি প্রবাহিত হয় ও প্রশান্তিআসে। পুত্রহীন মানুষেরা আমএর বৃক্ষ লাগান তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। পৃথিবীর প্রথম বৃক্ষটি কি লাগানাে হয়েছিল না নিজে জন্মেছিল সেই বির্তকে না গিয়ে আমরা অরণ্য নিয়ে একটু ভাবি। বৃক্ষের চারা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়ে একসময় পরিণত হয় . অরণ্যের রুপে গন্ধে মাতােয়ারা করে পশু, পাখি, কীটপতঙ্গদের। পাখি বৃক্ষের বীজ একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায় ।
পশুপাখির বাসস্থানকে ধ্বংস করে মানুষ আশ্রয়হীন করেছে তাদের। প্রাকৃতিক সম্পদকে বিনষ্ট করা একজাতীয় মানুষের বিপরীতে কিছু হৃদয়বান মানুষ যত্ন সহকারে বৃক্ষরােপন করে আসছেন। এরা সবাই হল বনমহােৎসবের কুশীলব, ইচ্ছে হলে সবাই এদের মত অংশীদার হতেপারে এই মহান উৎসবের। নিজের এলাকায়, বাগানে টবে অন্তত একটি চারাগাছ লাগিয়ে বন মহােৎসবকে সবুজ করে তুলুন । বৃক্ষের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলুন। জীবনভার বৃক্ষের কাছ থেকে নেওয়া দানের প্রতিদানে প্রতিদিনই বৃক্ষকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে তার শ্রদ্ধাঞ্জলির’ নাম ‘বননামহােৎসব’ । যা একদিনের নয়, এক সপ্তাহের নয় অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।
কোন মন্তব্য নেই