বিহারে শিশু মৃত্যুর মিছিল
আশীষ কুমার দে, সমাজকৰ্মী, বেঙ্গালুরু
ছবি, সৌঃ আন্তৰ্জাল
আমার এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত বিহারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাবে। আপনি যদি ভাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকায় শিশুর জন্ম অভিশাপ স্বরূপ তবে ভুল করবেন। কারণ তথ্য বলছে বিহারের মুজফফরপুর জেলা থেকে আফ্রিকার মতন গরীব অনুন্নত দেশের শিশু ও মাতৃসুরক্ষার বিষয়গুলো অনেক উন্নত মানের। গত ১৫ দিনে প্রায় দুই শতাধিক শিশুর মৃত্যুর কারণ Acute Encephalitis Syndrome(AES), বলা হলেও তার প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষায় পরীক্ষিত নয়, রক্ত ও বায়োলজিক্যাল নমুনা সংগ্রহ করার মতন পরিকাঠামো শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নেই। রাজ্য সরকার অভূক্ত শিশুদের মৃত্যুর জন্য লিচুকে দায়ী করে সাময়িক জনরোষকে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মনে করছেন শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও দীর্ঘক্ষণ অভূক্ত থাকা ও অতিরিক্ত গরমের জন্য এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি । একজন অভিজ্ঞ Epidemiologist (CMC Vellore ) যিনি মুজফফরপুরে আগেও শিশু মৃত্যুর পর গবেষণা করেছেন তার মতে, অভুক্ত ও অপুষ্টির কারণ শিশুদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য এই মৃত্যু। তিনটি Clinical সম্ভাবনার আশে পাশে ঘুরছে এই নিরীহ, দারিদ্র্য সীমার নিচে বা সমান্তরাল থাকা শিশুদের মৃত্যু, প্রথম, Acute Encephalitis Syndrome, দ্বিতীয়ত Japani Encephalitis ও তৃতীয়ত খালি পেটে লিচু খাওয়ার জন্য রক্তে Glucose এর পরিমান বৃদ্ধি Hyperglycaemia.
এরপর প্রশ্ন একটাই, ২০১০ সাল থেকে চলে আসা নিতিশ কুমার, সরকারের উপলব্ধি কি? সারা দেশে ‘সুশাসন’এর ঢোল পিটিয়ে ও সর্বব্যাপী উন্নয়নের মডেলের পঞ্চমুখে প্রশংসার দাবিদার, জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত বিহার সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২৫ জুন প্রকাশিত নীতি আয়োগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই দেশে স্বাস্থ্য সূচকের ২৩ টি প্যারামিটারের সবচেয়ে নীচে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িশা! ফাৰ্টিলিটি রেট বৃদ্ধি, Low Birth Weight rate, Sex ratio at Birth, যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় অসফল, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির মান উন্নয়নে ব্যর্থতা ।
বিহারকে বিমারু (বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যের তালিকায় আনা হয় ১৯৫০ সালে রাজ্যটিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোর অভাবে। লালু প্রসাদ ও রাবড়ী দেবীর সরকারকে জঙ্গল রাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন যারা তারাই গত একদশক ধরে ক্ষমতায় আছেন। এবং তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল সুশাসন, বিহারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক বৈষম্য দূর করা রাজ্যের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে বিহার সার্ভিস ডেলিভারি বেড়েছে, ক্রয় ক্ষমতার বৃদ্ধি হয়েছে বৈষম্য কমেছে । ২০১২ এবং ২০১৪ সালে Acute Encephalitis Syndrome এর ফলে ৩৯৫ এবং ৩৭২ টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুদ্ধিজীবী ও জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন ওই রিপোর্টগুলি ভিত্তিহীন। গয়া, পাটনা, ঔরঙ্গাবাদ, সারন, বৈশালী, সীতামাড়ী ও পূর্ব চম্পারনে এই রোগের প্রকোপ বেশী। ২০১২ সালে দাবি করা হয়েছিল হাইজিন ও নোংরা জল জমে রোগের প্রকোপ, ২০১৪ সালে বলা হয়েছিল কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক শুকর পালন করার জন্য মশাবাহিত এই রোগের সৃষ্টি হয়। এবার শিশু মৃত্যুর ঘটনায় লিচুকে দায়ী করা হয়েছে। জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তালিকায় স্বচ্ছতা, শুদ্ধ জলের ব্যবস্থা ও পুষ্টিকর খাদ্য ও সরবরাহ আছে যা রাজ্য সরকার দিতে বাধ্য ।
Unicef, WHO ও World bank এর রিপোর্ট মতে, বিহারের মুজফফরপুর জেলার স্বাস্থ্য সূচক যে কোন আফ্রিকান দেশের থেকেও খারাপ। NFHS-4 (National Health and Family Survey) এর রিপোর্টে প্রকাশ, এই জেলার ৪৮ শতাংশ পাঁচ বছর বয়সী শিশু Stunted ( বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম), ১৭.৫ শতাংশ শিশু Wasted ( উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম ) এবং ৪২ শতাংশ শিশুর জাতীয় স্বাস্থ্য সূচক অনুযায়ী ওজন যথেষ্ট নয়। যা তাদের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব প্রমাণ করে। বিহারের কোন জেলাই মাতৃ ও শিশু সুরক্ষার জাতীয় সূচকের ধারে কাছে যেতে পারে নি, তবে স্বস্তি পাই আফ্রিকার সুদানের অবস্থা বিহারের থেকেও খারাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্বে প্রায় ২৭ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয় অপুষ্টির কারণে। যা বিশ্বের মোট শিশু মৃত্যুর ৪৪শতাংশ।
ক্রমাগত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে উন্নত মানের ও স্থিতিশীল করা সম্ভব হয়েছে। হু'র মতে সঠিক পরিমাণে পৌষ্টিক আহার (০-৫ বছর) ও জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মুজফফরপুরে মাত্র ৭ শতাংশ (৬-২৩ মাস) বয়সী শিশুরা সঠিকভাবে পৌষ্টিক আহার পায়। হু'র ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে কুড়িটি আফ্রিকান দেশের শিশুরা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী পুষ্টিকর আহার পাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ঘানা ও রাওন্ডা। স্তন্যপানের ক্ষেত্রে প্রায় ৭৯ শতাংশ শিশু মাতৃদুগ্ধ পায় মুজফফরপুরে তা অবশ্যই আফ্রিকান দেশের থেকে অনেক বেশি, কিন্তু এই পরিসংখ্যান মুখ থুবড়ে পরে যখন আমরা জানতে পারি যে জন্মের ১-৪ ঘন্টার মধ্যে ৬৩ শতাংশ শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করার সুযোগ পায় না। জন্মের একঘন্টার মধ্যে মাতৃদুগ্ধে থাকা Colostrum পান করলে শিশুদের মধ্যে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তা ভবিষ্যতে যে কোন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। মুজফফরপুর জেলার শিশুদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার যা তাদের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে হয়।
এই জেলায় অসংখ্য মহিলা অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের Body mass index (BMI- উচ্চতা অনুযায়ী ওজনের পরিমাপ ) স্বাভাবিক থেকে অনেক কম। এছাড়া এই জেলার ৩৩ শতাংশ মহিলার ওজন জাতীয় স্বাস্থ্য সূচক থেকে যথেষ্ট কম। এর ফলে এদের গর্ভের সন্তানদের Low Birth Weight জন্ম হয়, (জন্মের সময় ২৫০০ গ্রাম স্বাভাবিক ), এই শিশুরা জন্মের পর বিভিন্ন ধরনের রোগের শিকার হয় বৃদ্ধিতে বাধা পায়। বিহারে শিশু মৃত্যুর হার ১০০০: ৩৮, মাতৃ মৃত্যুর হার ১০০০০০: ১৬৫, নবজাতকের মৃত্যুর হার ১০০০ : ২৮। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে শিশু জন্মের হার ১০০: ৭৪.৩। নীতি আয়োগের স্কোর অনুসারে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় ১০০ : ৩৮.৪৬ উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে ANMএর খালি পদ ৫৯.৩ শতাংশ, প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ANM এর খালি পদ - ৫০.৩ শতাংশ। প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিক্যাল অফিসারের খালি পদ - ৬৩.৬শতাংশ, জেলা ও কমিউনিটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞের পদ খালি - ৬১ শতাংশ, মাত্র ৫৫.৫ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা প্রসবপূর্ব সেবা পান, শিশুর জন্ম পঞ্জিয়ণ হয় মাত্র ৬৪.২ শতাংশ, First Referral Unit মাত্র ১১.৫ শতাংশ, পিএইচসি ও কমিউনিটি স্তরে Cardiac Care Unit একটিও নেই। মুজফফরপুর ও বিহারের বেশীরভাগ জেলায় নতুন নতুন কোন রোগের প্রাদূর্ভাগ মোকাবিলা করার কোনও পরিকাঠামো নেই।
মুজফফরপুরে ১০৩ টি PHCর অর্ধেকের বেশী সেন্টারে চিকিৎসক নেই, নার্সের সংখ্যাও কম। যেখানে চিকিৎসক আছেন তারা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে ঝুঁকি না নিয়ে জেলা বা মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিওন্যাটাল আইসিইউ নেই। নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে বেড, মহামারী প্রতিরোধের ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই। এই রোগের চিকিৎসার প্রটোকল জানেন না বেশীরভাগ চিকিৎসক। এর পরেও মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এর দায়িত্ব নিতে রাজি নন। তাদের কাছে অপুষ্টি, দারিদ্রতা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব কোনও সমস্যাই না। একটি শক্ত সরকারের রাজ্যে একটি শিশুর মৃত্যুও কাম্য নয়, কেন শিশুদের অপুষ্টির শিকার হতে হয় এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় তার জবাব দিতে পারছেন না ‘সুশাসন বাবু’। নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করতে না পারলে তার প্রতিকার করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য ২০১৪ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ হর্ষবর্ধন শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজে ১০০ বিছানা যুক্ত শিশু বিভাগ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা এযাবৎ বাস্তবায়িত হয়নি।
শিশু মৃত্যু, অপুষ্টি, রোজগারের অভাবে বিহারীদের লক্ষ দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, অসম সহ নিরাপদ স্থানে পলায়ন। এর ফলে ওই সব রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে দিল্লি, বেঙ্গালুরু ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর রাজ্যগুলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই নড়বড়ে।
( তথ্য সূত্র : NFHS 4, Annual Health Survey, Niti Ayog Report, Handbook of NHM WHO'S report on South East Asia, Unicef report on children's status ) ।
কোন মন্তব্য নেই