Header Ads

বিজেপি ঠেকাতে বাম-কংগ্রেস পাশে দাঁড়াবে না বলেই আমার বিশ্বাস !!

লিখেছেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়


অস্তিত্বহীন সংগঠনহীন বিজেপি তৃণমূলের আকাশস্পর্শী আত্মতুষ্টি অহমিকা ঔদ্ধত্যকে যেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তাতে বিজেপি’র নিজস্ব কৃতীত্ব যতটা তার চেয়ে অনেকবেশি রাজ্যের মানুষের। মাত্র আট বছরের মধ্যেই মানুষের তৃণমূলকে সহ্য করার ক্ষমতা যে এইভাবে তলানিতে এসে ঠেকবে তা টের পায়নি দলের দাপুটে নেতৃত্ব। আমার মতো অনেকেই যারা ঝাণ্ডা হাতে পথে ছোটাছুটি করি না--কিন্তু খুব কাছ থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক আবহাওয়াটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি--বুঝতে পারছিলাম বিপর্য্যয় ঘনিয়ে আসছে। আমরা এই সম্ভাবনার কথা বললেও তাকে উড়িয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী কালচারই শেষপর্যন্ত একেবারে ডুবিয়ে দিল। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ছবিটা কিন্তু ভয়ঙ্কর রকমের বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। 
ছবি, সৌঃ  ফেসবুক



দল ভাঙিয়ে দলকে ভুঁড়িদাস বানানোর উগ্রআতিশয্যে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে বাম-কংগ্রেসকে। এখনও কুড়ি-বাইশজন বাম-কংগ্রেস বিধায়ক পদত্যাগ না করে ফের জনমত না নিয়ে দলত্যাগ করে উন্নয়নের চাকর-বাকর হয়ে রয়েছেন। সেই দলভাঙানোর রাজনীতি যখন ব্যুমেরাং হয়ে প্রবল বেগে ফিরে আসছে তখন ন্যায়-নীতি-আদর্শের গান গাইতে হচ্ছে তৃণমূলকে !আমি বহুবার এ ধরণের আত্মঘাতী প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু আমি কোন্ হরিদাস পাল যে আমার লেখা পড়তে হবে? তারা পড়লেও ফুৎকারে উড়িয়ে দিযেছেন--কারণ রাজনীতি করলেও তাদের দেওয়ালের লেখা পড়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তৃণমূলের এই বিপর্য্যয়ের পিছনে বাম-কংগ্রেস তো বটেই তৃণমূল কংগ্রেসের বীতশ্রদ্ধ হতাশ সমর্থকদের ভূমিকাও কাজ করেছে। শুধু তাই নয়--বহু ক্ষেত্রেই তৃণমূলই তৃণমূলের হারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। 

আজই দেখলাম কোচবিহারের এক তৃণমূলকর্মী জেলার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে রাজ্যনেতাদের ভূমিকাকেই দায়ি করে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছেন--তার ঐ অভিযোগে কেঁপে উঠেছেন জেলার তাবড় নেতারা--কারণ তারা নিজেরাও জানেন অভিযোগটা একেবারেই মিথ্যে নয়। শুধু কোচবিহারেই নয়, প্রতিটি জেলায় রাজ্য নেতাদের একাধিক লবির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লড়াই গোটা দলটাকেই ভেতর থেকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। কোচবিহারের মতো অভিষেক লবি-পার্থ লবি-অরূপ লবি-সুব্রত লবি’র প্রতিমুহূর্তের লড়াই কমার বদলে বাড়তে বাড়তে শ্মশানের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। 
দলের যুব লবি গোটা রাজ্যের মূল তৃণমূল সংগঠনটাকেই একেবারে খোকলা করে দিলেও এই সর্বনাশা সমান্তরাল দলীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে নেত্রী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন নি। বরং যারা দলকে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে হারিয়েছে এবং পরে দলত্যাগের হুমকি দিয়ে নিজেদের ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানার মতো নির্দোষ প্রমাণে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছিল তাদের হাতেই সংগঠনের ক্ষমতা তুলে দিলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ফলে দলের মধ্যে বিক্ষুব্ধদের সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে গেল--দলে দলে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি শিবিরে ঢুকে গেল--এমনটাই তো হওয়ার কথা --হচ্ছেও তাই ! 
দু’এক মাস সময় নিয়ে কোচবিহারের হারের কারণ ভালভাবে পর্যালোচনা বিশ্লেষণ না করে রাতারাতি সাংগঠনিক রদবদল করার ফল হল--জেলার কোথাও জেলা নেতারা তো দূরের কথা--রাজ্য নেতারাও পা রাখতে পারছেন না। বিরাট সংখ্যক জিপি-পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সদলবলে বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছে--এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরির ক্ষমতা জেলা নেতাদের হাতে আর নেই। কারণ, পুলিশ-প্রশাসনকে কব্জায় রেখে ধমক-চমকের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে।
আমার কথা এখন শুনতে খুব খারাপ লাগলেও এটাই নির্মম সত্যি যে বিজেপিকে একক শক্তিতে ঠেকাবার ক্ষমতা একেবারেই শেষ হয়ে গেছে তৃণমূলের। বিজেপি’র বিকল্প আর তৃণমূল নয়--প্রমাণ হবে পুর ও বিধানসভা নির্বাচনে। এটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন তৃণমূল নেত্রী--তাই বাম-কংগ্রেসের সাহায্য চাইছেন !
সংসদে কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা অধীর চৌধুরী কোনও যুক্তিতেই কংগ্রেস কে ‘ইউজ অ্যাণ্ড থ্রো’ রাজনীতির ফাঁদে পা দিতে দেবেন না। সোমেন মিত্রও এ ব্যাপারে অধীরের পাশেই থাকবেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। দিনের পর দিন চরম অপমানের বদলা নিতে বাম-কংগ্রেস বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধেই জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। 
২০২১ সালেই বাম-কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে--এমন অলীক স্বপ্ন কোন বাম-কংগ্রেস নেতাই দেখছেন না--এমন কী ক্ষমতার নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে ও উঠে আসবেন বলেও ভাবছেন না--তাদের লক্ষ্য থাকবে ২০২৬-এর নির্বাচন--এই জোট অঘটন ঘটানোর মতো জায়গায় উঠে আসতে পারে যদি সর্বভারতীয় রাজনীতির দায়বদ্ধতা জাতীয় আদিখ্যেতা-ন্যাকামি বাদ দিয়ে রাজ্যরাজনীতির পরিস্থিতি অনুযায়ী বাম-কংগ্রেস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জোটবদ্ধভাবে এগোবার চেষ্টা করে। বাম নেতাদের অন্তঃসারশূন্য প্রবল ইগো এবং ফালতু আওয়াজ দেওয়ার প্রবণতা শিকেয় তুলে রাখতে পারেন এবং বাস্তবের মাটিতে পা রেখে কংগ্রসের হাতে হাত রেখে চলার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাহলে বাম-কংগ্রেস জোটই বিজেপি’র বিকল্প গ্রহণযোগ্য শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে রাজ্যের বাম ও কংগ্রেসনেতাদের একটা বিষয়ে খুবই শক্ত অবস্থান নিতে হবে তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অযৌক্তিক অনভিপ্রেত নাকগলানোর অভ্যাসকে দূরে রাখার প্রশ্নে। তা না হলে রাজ্যের জন্য সেই সর্বনাশা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ন্যাকামির দৌলতে কংগ্রেসকে ‘ইউজ অ্যাণ্ড থ্রো’ রাজনীতির অসহায় অক্ষম দলের অপ্রাসঙ্গিক অস্তিত্ব নির্ভর হয়েই থাকতে হবে--ঠিক এইরকমভাবেই সিপিএমকেও কোমায় থাকতে হবে কম করেও আরও একদশক !
তৃণমূল নিজের হারাকিরি হঠকারিতায় বিজেপি’র উত্থানকে এ রাজ্যে নিশ্চিত করেছে--তৃণমূলের অসংখ্য ভুলভাল রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও কর্মসূচীর কারণেই বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের এই বাড়বৃদ্ধির সম্পূর্ণ দায় নিতে হচ্ছে তৃণমূলকেই--বাম কংগ্রেসকে কেউ দায়ি করছে না। তা সে যতই বাম ভোটে বিজেপি জিতেছে বলে প্রচার করা হোক না কেন--এ তত্ত্বে বিশ্বাস করার মতো নির্বোধ এ রাজ্যের মানুষ নয়। 
আমি ভেবেছিলাম--দলের এই বিপর্য্যয়ের কারণ নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব চুরচেরা বিশ্লেষণ করবে--মারাত্মক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে নিঃশব্দে সেগুলোকে কি ভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবে। সে সব কিচ্ছু হল না--রাতারাতি যারা হারলো--যাদের মানুষ স্পষ্ট জানিয়ে দিল তাদের পছন্দ নয়--এবং যারা হারিয়ে দিতে তলায় তলায় মাটি কাটলো তাদের হাতেই সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল। এরা ২০২১-এ ফের দলকে ক্ষমতায় বসাবে? তার জন্যে কতজন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল দলে থাকবে?
প্রকাশ্যে কাটমানি নিয়ে দলের ভাবমূর্তি মেরামতির চেষ্টার কি খুব প্রয়োজন ছিল? নিঃশব্দে ভেতরে ভেতরে দুষ্টু গরুগুলোকে কি তাড়ানো যেত না--নাকি সেরকম পদক্ষেপ গ্রহণের মতো ক্ষমতা আর সাংগঠনিকভাবে হাতের মধ্যে ছিল না ! জেলায় জেলায় লবি সংঘর্ষের ব্যাপক হতশ্রী চেহারাটও অবশ্য সামনে উঠে আসার আশঙ্কা ছিল--কিন্তু যে চেহারা উঠে এল সেটাও তো কিছু কম অস্বস্তিকর নয় !
শিরে সর্পাঘাত হলে তাগা বাঁধার জায়গা থাকে না ঠিকই--তবু সামনে এখন মাত্র দুটি রাস্তা খোলা থাকছে---
১) তোলাবাজি-কাটমানি-সিণ্ডিকেট-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দুষ্টু ছেলেদের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দলে ধরে রাখার চেষ্টা করার পাশাপাশি জেলায় জেলায় রাজ্যনেতাদের লবিবাজির রাজনীতিকে চলতে দেওয়ার মাধ্যমে দলের ভাঙন রোধের চেষ্টা করা।
২) সংগঠনের সর্বস্তরে আগাপাশতলা ঝেঁটিয়ে সাফ করে দুষ্টু গরুগুলোকে গোয়াল থেকে তাড়িয়ে ফের শূন্য থেকে দলটাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে গড়ে তোলা। 
এই দুই রাস্তাই গভীর সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠেছে। প্রশান্ত কিশোরের পক্ষেও সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। আর আমার কেন যেন বার বারে মনে হচ্ছে রাজ্যটাকে বিজেপি’র হাতেই তুলে দিতে তাকে আবাহন করা হয়েছে ! সত্যি না মিথ্যে সেটা প্রতিফলিত হবে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে !!



মতামত লেখকের নিজস্ব

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.