Header Ads

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বিশেষ প্ৰতিবেদন


‘দাও ফিরিয়ে দাও হে অরণ্য লও হে নগর’

অমল গুপ্ত

আমরা দেশের অন্যতম ‘ফাসটেস্ট গ্ৰোয়িং সিটি’ গুয়াহাটিতে বসবাস করি। ২১৬.৭৯ বৰ্গ কিলোমিটার এলাকার মহানগরে ১৮ টি পাহাড়, বিশাল নদ ব্ৰহ্মপুত্ৰ, বাঘ হাতী, হরিণ অন্যান্য বনজন্তু সবুজ পাহাড় চারদিকে ঘিরে রেখেছে। অপূৰ্ব মনোরম নৈসৰ্গিক পরিবেশের মাঝে দেশের অন্যতম সীমান্তবৰ্তী শহর গুয়াহাটি মহানগর। নীলাচল পাহাড়ের মাথায় দেশের তীৰ্থ চূড়ামনী বলে খ্যাত কামাখ্যা ধাম মহানগরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্ৰকৃতিপ্ৰেমীরা সতৰ্ক বাণী শোনাচ্ছেন, যে হারে পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে মানুষের লোভ লালসা বেড়ে চলেছে, বিষয় সম্পত্তি জমি-বাড়ি তৈরির প্ৰতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে প্ৰতীয়মান হয় আর দু তিন দশক পর গুয়াহাটি মহানগরের সবুজ ধ্বংস হয়ে যাবে। সরকারী প্রশাসনের হাজার নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চারপাশের পাহাড়ের মাটি কাটা চলছে শহরের পাশেই আমসাং অভয়ারণ্যের মধ্যে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির চিমনির ধোঁয়া চারপাশ দুষিত করে তুলেছে। রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারী আনুগত্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলির প্ৰত্যক্ষ মদতে তা চলছে। গুয়াহাটি মহানগরকে স্মাৰ্ট সিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মহানগরের পয়ঃপ্ৰণালী, ফুটপাত, যানবাহন চলেচলের রাস্তাঘাটের দুরবস্থার অন্ত নেই। মহানগরে প্ৰায় ১০ লক্ষ দুচাকা ও চার চাকার গাড়ি চলে। কাৰ্বনডাই অক্সাইডের বিষ মহানগরকে গ্ৰাস করেছে। সারা দেশের মধ্যে অন্যতম দুষিত শহর হিসেবে পরিণত হয়েছে গুয়াহাটি। অপরিকল্পিতভাবে গুয়াহাটি মহনগর ক্ৰমশ বেড়ে চলেছে। পাহাড়ের মাথাতেও চলছে নিৰ্মাণ। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ভূগৰ্ভের জল নিষ্কাষণ চলছে। বিধানসভায় এ নিয়ে আইন প্ৰণয়ণের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তা ব্যৰ্থ হয়। গুয়াহাটির যা সৌন্দৰ্য বৰ্ধনের অন্যতম অঙ্গ হতে পারতো ভরলু খাল তা আবৰ্জনা ফেলার প্ৰধান ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। মহানগরে শাকসব্জি, মাছ-মাংস, ফলমূল, দুধ সব কিছুতেই ভেজাল। কোনও কিছু খাওয়ার উপায় নেই। কাৰ্বাইড সমেত বিভিন্ন রসায়নিক দ্ৰব্য, হৰ্মন ইনজেকশন প্ৰভৃতি দিয়ে খাদ্য সামগ্ৰি দুষিত হয়ে পড়েছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মহানগরে বিভিন্ন কোম্পানির বোতল বন্দি পানীয় জলের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্ৰশ্ন উঠেছে। রাজ্যে শাক সবজি উৎপাদনে রেকৰ্ড করা খারুপেটিয়া, মিছামারি, বরপেটা, হোজাই, প্ৰভৃতি অঞ্চলে ব্যপকহারে  কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। প্ৰশাসন সব জেনেও কোনও নিয়ন্ত্ৰণ করতে পারছে না। সরকারী প্ৰশাসন পুরোপুরি ব্যৰ্থ। সারা দেশের মধ্যে গুয়াহাটি অন্যতম দুষিত শহর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা হয় না, সরকারী আনুকুল্যে রাজ্যে কয়েক হাজার মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। গুয়াহাটি মহানগরের অধিকাংশ শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানের অভিজাত পরিবারের ছাত্ৰছাত্ৰীরা মাদকাসক্ত, এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে প্ৰায় ৫০ শতাংশ ছাত্ৰছাত্ৰী বেআইনী মাদক গ্ৰহণ করে। এইদিকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদীর মত বিশাল নদকে ঠিকমত ব্যবহার করা হচ্ছে না। চিনের হোয়াংহো নদীকে দুঃখের নদী বলা হত। আজ সেই নদী আশীৰ্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদ প্ৰতিবছর বন্যায় কোটি কোটি টাকার জীবন সম্পত্তি নষ্ট হয়। ব্যাপক ধ্বংসের ফলে বছরে প্ৰায় ৫ লক্ষ বৰ্গ কিলোমিটার মাটি নদীগুলিতে তলিয়ে যায়। এশিয়ার বৃহত্তম নদীদ্বীপ মাজুলি বন্যা ধ্বংসের ফলে ক্ৰমশ সংকুচিত হচ্ছে। বিধানসভায় বহুবার ব্ৰহ্মপুত্ৰ বন্যা ধ্বসকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আৰ্থিক সাহ্যয্যের দাবি জানানো হয়েছিল, কিন্তু তা আজও বাস্তবায়িত হল না। প্ৰতিবেশী মেঘালয়ের মত অসমেও বেআইনীভাবে কয়লা খনি উত্তোলন চলেছেই। গুয়াহাটি-শিলং পথে পাহাড় কাটা অব্যাহত, অসমের মাৰ্ঘেরিটা অঞ্চলের ওপেন কাস্ট কয়লা খনি ধ্বংস চলছে। রাজনৈতিক আনুকুল্যে উজান অসমে ভূগৰ্ভস্থ তেল এবং গ্যাসের সদ ব্যবহার হচ্ছে না। রাজ্যের বনাঞ্চল ক্ৰমশ সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ প্ৰকৃতির ভারসাম্য রক্ষা তাগিদে ন্যূনতম ৩১ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। রাজ্যে তা নেই। কিন্তু সরকারী কাগজে কলমে আছে। সেইসঙ্গে বন্যপ্ৰাণী নিধন অব্যাহত আছে। বিশ্বের বিপন্ন প্ৰজাতি একশৃংগ বিশিষ্ট গণ্ডার হত্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না। জঙ্গলের হাতীরা আজ খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। নুমলিগড়ের হাতীদের করিডোর আজ বেদখল হয়ে গেছে। প্ৰতিদিন হাতীদের প্ৰাণ যাচ্ছে। সরকারী তথ্য বলছে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পৰ্যন্ত অসমে ২৪৯ টি হাতীর মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে ৭৬১ জনের। সরকারী তথ্য বলছে অসমে ৫টি রাষ্ট্ৰীয় উদ্যানে ৩৯.৭১০ বৰ্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে, ১৮ টি অভয়ারণ্যে ১০০. ৩৭৫ বৰ্গ কিলোমিটার এবং ৩১২ টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৩৬৪১. ৪৫০২ বৰ্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে, তা সরকারী পরিভাষায় বেদখল হয়েছে। অগপর বিধায়ক রমেন্দ্ৰ নারায়ণ কলিতার এক প্ৰশ্নের জবাবে বনমন্ত্ৰী পরিমল শুক্লবৈদ্য এই তথ্য বিধানসভায় জানিয়েছিলেন, রাজ্যের ৩৭৮ টি বালি ও পাথর মহল আছে। তার এই জবাবেই বন বিভাগের কঙ্কালসার চেহারা ধরা পরেছে। শুধু সরকারী তথ্য এই পরিমাণ ধ্বংসের ছবি দেখাচ্ছে। কিন্তু প্ৰকৃতাৰ্থে বহু বেশি হারে জঙ্গল ধ্বংস চলছে। গুয়াহাটি মহানগরের উপকন্ঠে ৩০৯০ বিঘা জমিতে দীপর বিল, পক্ষী অভয়ারণ্য মহানগরের আবৰ্জনা ফেলার প্ৰধান কেন্দ্ৰ হয়ে পরেছে। সেখানে যাযাবর এবং দেশান্তরি পাখিতে প্ৰতিবছর ভরে যায়। পাৰ্শ্ববৰ্তী রাণী বনাঞ্চল থেকে বুনো হাতীরা এসে রেল লাইনে চাপা পড়ে মারা যাচ্ছে। হাতীদের এই করিডরে রেল কৰ্তৃপক্ষ ডবল লাইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। প্ৰতিবছর ভারতে ১২ লক্ষ মানুষ বায়ু দুষণের ফলে মারা যাচ্ছে। সরকারী তথ্য সেকথা বলছে।   
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যথারীতি নিয়ম রক্ষায় অনুষ্ঠান হবে, আলোচনা চক্ৰ হবে যা প্ৰতিবছর হয়ে থাকে, তাতে ফলশ্ৰুতি কিন্তু জিরো। মানুষ পরিবেশ প্ৰকৃতি সংরক্ষণে আন্তরিক নয়, সচেতন নয়, সজাগ নয়, স্বচ্ছ অভিযানের আগ্ৰহ নেই, প্লাস্টিক মুক্ত পরিবেশের কথা ভাবতেই পারে না। প্লাস্টিকের সঙ্গেই থাকতে ভালবাসে। আজ এক সমীক্ষায় জানা গেছে আজ এই সভ্যতার অভিশাপ স্বরূপ এই  প্লাস্টিক সমুদ্ৰের গভীরতম অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। তিমি মাছের পেটেও হাজার হাজার কেজি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মানুষ ব্যক্তিগত লোভ লালসা, ভোগ বিলাস, বৈভবে ডুবে থাকতে চায়। পরিবেশের কথা একবারও ভাবে না, সৰ্বগ্ৰাসী সৰ্বনাশ ধেয়ে আসছে। মহাত্মা গান্ধী বলে গেছেন, দেশে পৰ্যাপ্ত পরিমাণে বনজঙ্গল আছে, কিন্তু মানুষের লোভ লালসার কাছে সেই পরিমাণ কিছুই নয়। অসমের প্ৰকৃতিপ্ৰেমী রবিন ব্যানাৰ্জি বলে গেছেন, কাজিরাঙা একদিন মানুষের লোভের বলি হয়ে নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে। আমরা সমাজে কি একজনও প্ৰকৃতিপ্ৰেমী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুঁজে পাব না? বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বারে বারে উঠে আসছে এই প্ৰশ্ন। অমলিন সুন্দর পরিবেশের প্ৰতি প্ৰগাঢ় ভালবাসা জানিয়ে প্ৰকৃতিপ্ৰেমী বিভূতিভূষণ এই বিখ্যাত মন্তব্যটি করেছিলেন- ‘‘কেউ জানে না কত ভালবাসী আমি আমার গ্ৰামকে। আমার ইছামতী নদীকে, বাঁশবন, শেওড়া ঝোপ, সোঁদালিফুল, ছাতিমফুল, বাবলাবনকে। সে ছায়া, সে স্নিগ্ধ স্নেহ আমার জীবনের চিরসম্পদ হয়ে আছে। তারাই আমার ঐশ্বৰ্য। অন্য ঐশ্বৰ্যকে তাদের কাছে তৃণের মতো গণ্য করি।’’ তাঁর মতো করে প্ৰকৃতিকে ভালবাসার একজনও নেই। আমরা কি সৰ্বগ্ৰাসী ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে?


প্ৰতিবেদনটি লিখেছেন ‘নয়া ঠাহর’এর সম্পাদক অমল গুপ্ত
মুঠোফোনঃ ৯৮৬৪০৪৪২৩৯


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.