Header Ads

ভালোবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ কল্যাণবাবু

সঞ্জয় কুমার: সাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, শিক্ষক তথা সাংস্কৃতিক কর্মী মাননীয় শ্রী কল্যাণ কুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে ফরাক্কাবাসীর অবিচ্ছেদ্য আন্তরিকতার যোগসূত্র রচিত হয় তিন দশক পূর্বে নয়নসুখ এল. এন. এস. এম. হাই স্কুলে শিক্ষকতার পথ বেয়ে ১৯৮৮ সালের ১লা  জুলাই। আর আজ ২০১৯।  দীর্ঘ তিন দশক ধরে শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট অনুকূল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যার নিরলস প্রয়াস অদ্যকার মসি চালনায় বাধ্য করেছে তিনি ১৯৫৯ সালের ৬ ই এপ্রিল এই মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করেন। মাতা জাহ্নবীলতা দেবী এবং পিতা সত্যনারায়ন মুখোপাধ্যায়ের যোগ্য পুত্ররূপে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দিতে বিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করেন।  তবে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা বিশেষত ফুটবল, ভলিবল আর পাঁচটি শিশুকে যেমন আকৃষ্ট করে তেমনি তাঁকেও করেছে। কিন্তু নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে বারবেলায় মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে নাটকের টানে ছুটে যাওয়ায় আপাত অর্থে পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজ এই লগ্নে তাঁর অনুভূতি, 'জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা'। 
কান্দির শিক্ষা সমাপ্ত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছানিতে আকর্ষিত হয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন তিনি। পরে পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি পাঠ সম্পন্ন করেন ঠিকই কিন্তু শিক্ষকতার ন্যায় মহান পেশাকে জীবনের ব্রত রূপে গ্রহণ করতে তিনি বিএড ডিগ্রিও অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 
সাংবাদিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা যোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান কল্যাণবাবু বিদ্যা শিক্ষার পাঠ সমাপ্ত করেই কর্মজীবনের অলিন্দে প্রবেশ করেন। হ্যাঁ, মুর্শিদাবাদ জেলার প্রখ্যাত কান্দি রাজ কলেজে প্রভাষক রূপের যোগদানের সূচনা হয় তাঁর কর্মজীবনের । অবশ্য শিক্ষকতার পাশাপাশি ওই একই সময়ে তিনি কান্দি মহকুমা আদালতে ওকালতিও অভ্যাস করতে থাকেন। কিন্তু শৈশবেই পাওয়া পিতৃদত্ত আদর্শের বাস্তবায়নে ১৯৮৮ সালের ১লা জুলাই পাকাপাকি ভাবে যোগদান করেন নয়নসুখ এল. এন. এস. এম. হাই স্কুলে সহ- শিক্ষক রূপে। 
জন্মসূত্রে নয়, যথার্থ শিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়েই ব্রাহ্মণত্ব লাভে যে তিতিক্ষার প্রয়োজন - এই শিক্ষা লাভ করেন পিতার নিকটেই  এবং সেই শিক্ষাই তাঁকে এনে দেয়  এশিয়াটিক সোসাইটি ও পারুল প্রকাশনী প্রদত্ত যৌথ শিক্ষা সম্মান ২০১৫। আর শৈশবের বারবেলায় দৃশ্যকাব্যের যে অমোঘ টান অনুভব করেছিলেন সেই টানেই নয়নসুখ এল. এন. এস. এম. হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক - শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীবৃন্দ এবং সর্বোপরি ফারাক্কার জনমানসকে খুব সহজে আকৃষ্ট করেন। ক্রমে নাট্যাভিনয় জগতে ছড়িয়ে যায় তাঁর নাম।  তাঁর সুযোগ্য অভিনয় নিপুণতায় 'ছেঁড়াতার', 'নবান্ন'-র ন্যায় মাইলস্টোন নাটকও মঞ্চাভিনীত হয়। 
তবে শুধু নাট্যাভিনয়ই নয়, নাট্য পরিচালনার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের অভিনয় করিয়ে বহু পুরস্কার তিনি এনে দিয়েছেন অত্র বিদ্যালয়কে। অভিনয়ের প্রয়োজনে মসি হাতে তিনি রচনা করেন 'নাগপাশ এড়িয়ে'-র ন্যায় মঞ্চসফল নাটক। যদিও কল্যাণবাবুর আগমনের পূর্বে ফরাক্কায় সাংস্কৃতিক বহর পাল তুলেছিল তথাপি একথা বুঝি অস্বীকার করার ধৃষ্টতা কেউ দেখাবেন না যে কল্যাণবাবুর আগমনেই ফরাক্কায় সাংস্কৃতিক বহরের পালে গতি সঞ্চারিত হয় ।
অর্থাৎ ফরাক্কা - সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল - কল্যাণবাবু এই মণিকাঞ্চনযোগ আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন ছিল। তবে শিক্ষাক্ষেত্র বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ কালে জনমানসের অভাব-অভিযোগ তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাছাড়া ১৯২১ সালে 'কান্দিবান্ধব'- এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোপালচন্দ্র সিংহ মহাশয় যে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সূচনা করেন, দেবেন্দ্র নারায়ন রায়ের হাত ঘুরে সেই সম্পাদনার ভার আসে সত্যনারায়ন মুখোপাধ্যায়ের কাছে। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সাংবাদিকতার লার্ভা যে একদিন পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি হয়ে ফরাক্কার আকাশে-বাতাসে রামধনু ছড়াবে তা বলাই বাহুল্য । 
হ্যাঁ, সেই লার্ভার প্রজাপতি হওয়াতে ভূমিকা নিয়েছে ছাত্র তীর্থ
কুমার দাস, ছাত্রোপম শাহজাদ হোসেন,সঞ্জয় হালদার, প্রতুলচন্দ্র দাস, সহকর্মী আলী আকবর মহাশয়ের আন্তরিক অনুরোধ এবং শেষমেষ ২০০৫ সালে প্রফেসর সৈয়দ নুরুল হাসান কলেজে সাড়ম্বরে গণকণ্ঠের সম্পাদক মাননীয় শ্রী প্রাণরঞ্জন চৌধুরী (সম্পাদক,  জেলা সাংবাদিক সংঘ)-র উপস্থিতিতে পথ চলা শুরু হয় 'মধ্যবঙ্গবার্তা' সংবাদ পাক্ষিক, সম্পাদক আলী আকবর মহাশয় এবং কার্যকারী সম্পাদক কল্যাণ কুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়। তারপর ২০০৮ সালে রিস্টার্ট   Register of Newspaper of India (RNI) দ্বারা স্বীকৃতিকালে পত্রিকাটির নাম হয় 'মধ্যবঙ্গবান্ধব'। পত্রিকাটি একদিকে যেমন ফারাক্কার সৌকর্ষোৎপাদনে এক নব পালক যোগ করে অন্যদিকে তেমনি প্রকৃতই ফরাক্কাবাসীর প্রাণের বান্ধবে পরিণত হয়। 
তবে স্থানীয় সংবাদ পরিবেশনের সীমায়িত গন্ডিতেই পত্রিকাটিকে আটকে রাখতে চাননি তাঁর যোগ্য কার্যকারী সম্পাদক কল্যাণবাবু।  তাই বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠায় শহীদদের প্রাণের মূল্যকে জনমানসে প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করে তিনি যেমন মাতৃভাষার প্রতি কর্তব্য পরায়নতা দেখিয়েছেন অন্যদিকে তেমনি ভাষা দিবস ও শারদীয় দুটি সাহিত্য সংখ্যা প্রকাশ করে নবাগত তরুণ কবি - সাহিত্যিকদের একটা মঞ্চ তৈরি করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। 
ভাবতে ভালো লাগে, ভাষা দিবস উদযাপনের সূত্র ধরেই কল্যাণবাবুর সাথে আমার যোগাযোগের সেতু রচিত হয়।তৎপূর্বে কল্যাণবাবু আমাদের নিকট শুধুই 'কড়া মাস্টার'( ছাত্রীয় পরিভাষায়) । কেননা ২০০০ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিনেই উনি আমাদের এক সহপাঠীর খাতায় রচনা অংশে লাল কালিতে যে দাগ দিয়েছিলেন সেই দাগ মনের খাতায় তখনও দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে উনার সাথে মেশার যখন সুযোগ পেলাম তখন পূর্ব স্মৃতিতে পুনর্লিখন ঘটল।  আপাদ-মস্তক এই ভদ্রলোকটি সত্যিই মনোজ্ঞ, পন্ডিত, বিবেকবান, মননশীল মানসিকতায় পূর্ণ এক নির্ভেজাল মানুষ। 
তবে আজ এত কথা বলছি কেন ?  বলছি,  কারণ চাকুরীর শর্তাবলী মেনে উনি গত ৩০শে এপ্রিল ২০১৯ তারিখে নয়নসুখ এল. এন. এস. এম. হাই স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন । অন্য ভাবে বললে বলতে হয়, প্রাগুক্ত বিদ্যালয়ের একটি চেয়ার আজীবনের জন্য শূন্য হয়ে গেল । যে শূন্যতা কালের নিয়মেই। তবে পরিণত বয়সে যিনি শুনেছেন, 'চেয়ারের পেছনে ছোটো না, কর্ম করে যাও, চেয়ার তোমার পানে ছুটবে' তাঁর চেয়ারের অভাব হয়না । আর হয় না বলেই, কল্যাণবাবুকে ভালোবাসার ডোরে বেঁধে ফেলেছে অন্য একটি চেয়ার।  হ্যাঁ, ফারাক্কার প্রখ্যাত একমাত্র বাংলা মাধ্যমের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় 'প্রণবানন্দ বিদ্যাপীঠ' -এর অধ্যক্ষ পদে তিনি অভিষিক্ত হন চলতি মাসের ৩ তারিখে । তাঁর এই পদাভিষেকে আমরা শ্লাঘা অনুভব করছি।  আর একবার আমরা ওনাকে ফরাক্কায় আটকে দিতে পেরেছি ভালোবাসার প্রতিদানে। 
না, আর নয়, এবারে সমাপ্তি পর্বে নেমে আসতে হচ্ছে । হয়তো সব কথা বলে উঠতে পারলাম না, হয়তো অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথাও বলে ফেললাম । তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।স্যার আপনি সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। আপনার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি কামনায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.