Header Ads

৮ মাৰ্চ সংগ্ৰামের দিন, উৎসবের নয়


সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদী শক্তির একচ্ছত্ৰী আধিপত্য শুরু হয়। ‘বিশ্বের পুঁজি এক হোক’ এই শ্লোগানের মুক্ত হাওয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের পরিভাষার পরিবৰ্তন হতে থাকে। মুক্ত নারীর সংজ্ঞা তৈরি করল মুক্ত বাজার। গণতন্ত্ৰ এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন ছিল আন্তৰ্জাতিক নারী দিবসের সংগ্ৰাম। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে নারী বৰ্ষ এবং ১৯৭১-৮৫ সালকে আন্তৰ্জাতিক নারী দশকরূপে ঘোষণা করে। আশির দশক থেকে জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলি নারী উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে শুরু করল। ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘ সমাজের সামগ্ৰিক উন্নয়নের পরিমাপ হিসেবে জেন্ডার উন্নয়ন সংক্ৰান্ত সূচক, জেন্ডার ক্ষমতায়ন পরিমাপের (জিইএম) কথা বলতে শুরু করে। তখন থেকে নারীর ক্ষমতায়ন এক গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয় হয়ে উঠল। ১৯১০ সাল থেকে ১৯১৯। লাগাতার যাত্ৰা। সমগ্ৰ বিশ্বের আৰ্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের দ্ৰুত পট পরিবৰ্তন হল। এইসব পরিবৰ্তনের মধ্যে নারীর অবস্থানের মূল্যায়ন করতে হলে চোখে পরবে আত্মপ্ৰতিষ্ঠা, আত্মমৰ্যাদার জন্য সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করার দিনটি ক্ৰমশ একটি উৎসবে পরিণত করার আয়োজন করছে এই বাজার। বড় বড় বুটিক, ব্ৰ্যান্ড, নারীর পোষাক, গয়নাগাটিতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। রেস্তোরাঁতে মেয়েদের জন্য পাৰ্টি এবং সেলফি তোলার আয়োজন করা হচ্ছে। ফ্লাইটের টিকিটে ছাড়, বড় বড় প্ৰাইভেট হাসপাতালগুলিতে ফ্ৰি চেক আপ, ভারতীয় নারী মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সব শ্ৰেণীই এখন বহুজাতিক কোম্পানির লক্ষ্য। বাজার অৰ্থনীতির প্ৰসারের সঙ্গে সংগতিপূৰ্ণ মুক্ত নারীর শ্লোগানে একদিকে ক্ৰমশ উপভোক্তা সংস্কৃতির বিস্তার করছে, অন্যদিকে, নারীর আত্মমৰ্যাদা, অধিকার প্ৰতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নের জন্য লড়াইয়ের দিনটি উৎসবে পরিবৰ্তিত করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মুক্ত নারী এবং পণ্য নারীর অৰ্থ একই হয়ে যাচ্ছে। বৰ্তমানে বাজারে অৰ্থনীতির মুনাফা অৰ্জনের বিশেষ উপাদান হচ্ছে নারী। কসমেটিক্স নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই বেড়েছে। কিন্তু সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে ক্ৰিম, লিপস্টিক, লেডিস পারফিউম, আইশেড, নেলপলিশ, হেয়ার স্প্ৰে। বিশেষ করে আন্তৰ্জাতিক ব্ৰ্যান্ডগুলির চাহিদা চোখে পরার মতো বেড়েছে। লরিয়েল, প্যারিস সব কোম্পানিই সন্তুষ্টি দিচ্ছে এই বলে যে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতবৰ্ষের প্ৰসাধনের বাজার অত্যধিক বড় হবে। আন্তৰ্জাতিক ব্ৰ্যান্ডগুলি অনলাইনের মাধ্যমে ভারতের বাজারে ঢুকেছে। ফ্লিপকাৰ্ট, মিন্ট্ৰা, স্নেপডিল, স্মাৰ্ট মোবাইল আজ গ্ৰামের মেয়েদের হাতে হাতে পৌঁছে গিয়েছে। অৰ্থাৎ বলা যায় নারী নিজের অবস্থা পরিবৰ্তনের যে লড়াইয়ে নেমেছে, তা এক ভয়ংকর উপভোক্তা সংস্কৃতির প্ৰতিষ্ঠার লড়াই মাত্ৰ। সেখানে ‘মুক্তি’ শব্দটির অস্তিত্ব নেই। জীবনযাপনের ক্ষেত্ৰে বাজার নিৰ্ভরতা যত বেশি বাড়ছে নারীর সামাজিক অবস্থানও ততো অবনতি হচ্ছে। পারিবারিক জীবনের বন্ধন ক্ৰমশ শিথিল হতে শুরু করেছে। সামগ্ৰিকভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে শারীরিকভাবে অত্যাচারিত না হলেও নারীর প্ৰতি অবহেলার পরিসংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট, চ্যাট, পৰ্ণোগ্ৰাফিক ইন্ডাষ্ট্ৰির রমরমা চলছে। সেক্স ট্যুরিজম এখন ‘কিসায়েং’ নামে পরিচিত। কিসায়েং ট্যুরিজম, কিসায়েং পাৰ্টি, কিসায়েং রেস্তরাঁ। এইসবে ১৩ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সের নারীকে নিযুক্ত করা হচ্ছে। একদিকে ডাইনী হত্যা, অনার কিলিং, গণধৰ্ষণ বাড়ছে, রাজনৈতিক মুনাফার জন্য সবরীমালা মন্দিরে প্ৰবেশ, ৩ তালাক নিষিদ্ধ, # মি টু ধরনের আন্দোলনকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে পারিবারিক জীবন দৰ্শন ক্ৰমশ বাজারকেন্দ্ৰিক হয়ে ওঠার কারণে পারিবারিক মূল্যবোধ ক্ৰমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পণ্য সংস্কৃতির ছোয়ায় পাল্টে যাচ্ছে সম্পৰ্কের পরিভাষা, ভাল জীবনের অৰ্থ। প্ৰশ্ন হচ্ছে সুস্থ পারিবারিক জীবন বলতে কি শুধু মাত্ৰ ভাল একজন ক্ৰেতা হয়ে ওঠাকে বোঝায়? নারীর ক্ষমতায়নের প্ৰশ্ন কিন্তু যুক্ত হয়ে রয়েছে আত্মপরিচয়, সম্মান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুস্থ-সবল হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে। বাজারের আগ্ৰাসন রুখতে, মানুষকে পণ্য করে তোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে নিহিত রয়েছে ভাল জীবনের স্বপ্ন। তাই ৮ মাৰ্চ উৎসবের নয়, সংগ্ৰামের দিন।       

মূল লেখা সাংবাদিক সুপৰ্ণা লাহিড়ী বড়ুয়ার
লেখাটি অসমিয়া থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন রিংকি মজুমদার

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.