Header Ads

সফরঃ ডুরমাদেবীর আশীৰ্বাদ ধন্য সবুজ পাহাড়ের কোলে সুন্দর মনোরম শহর– তুরা


তুরা সার্কেট হাউস থেকে তোলা ছবি।

অমল গুপ্তঃ গুয়াহাটি,

মেঘালয়ের গারো উপজাতি সম্প্ৰদায়ের আরাধ্য দেবতা ডুরমা দেবী থেকেই আজকের এই তুরার আত্মপ্ৰকাশ। গুয়াহাটি মহানগর থেকে প্ৰায় ২০০ কিলোমিটার দূরবৰ্তী পাহাড়ি শহর তুরা পশ্চিম গারো হিলস-য়ের সদর শহর। আঁকা বাঁকা সবুজ আর সবুজ  বৃষ্টিস্নাত, পাহাড়ি পথ, চা বাগান, কমলা, আনারস খেতের সুবাস নিতে নিতে আমরা ডুরমা দেবীর পদতলে পৌঁছিয়ে গেলাম। সমুদ্ৰপৃষ্ঠ থেকে প্ৰায় ২২০০ উচ্চতা বিশিষ্ট পাহাড়ি শহরকে ঘিরে রেখেছে সবুজ বিস্তৃত পাহাড় বড় আদর করে ঘিরে রেখেছে ডুরমা দেবীকে। হাজার গাছ-গাছালি, পাহাড়ে ঢালু জমিতে পাহাড়ি ফুল-ফল, একাধিক ঝৰ্ণা, জৈব-বৈচিত্ৰ্যের অপূৰ্ব সমাহার। শৈল নগরী শিলংয়ের  মত এক দিকে তুরা পিক, অপরদিকে নকরেক পাহাড়ের মাথায় জল ভরা মেঘের আনাগোনা, কুয়াশার আলো-আঁধারির রহস্যে ঢেকে রেখেছে সুউচ্চ পাহাড় দুটিকে। তুরা দেড়শো বছরের পাহাড়ি শহর দেশের সব থেকে সমৃদ্ধিশালী অত্যাধুনিক বাঙ্গালুরুকে টেক্কা দিতে পারে অনুকূল স্বাস্থ্য সন্মত আবহাওয়ার দিক থেকে, সেই মহানগরের মতোই তুরার ‘মডারেট' স্নিগ্দ্ধ আবহাওয়া, না খুব ঠাণ্ডা, না খুব গরম, এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছে,শীতল স্নিগ্দ্ধ ছায়া ঘন শহর।দেশের অন্যতম স্যানেটোরিয়াম বা স্বাস্থ্য নিবাস হিসাবে পরিচিত হলেও প্ৰচারের অভাবে দেশের পৰ্যটকরা আজও এত সুন্দর পাহাড়ি শহরের খবরই পায় নি। এই শহরের কেন্দ্ৰস্থলে হাওয়াখানা বলে এক স্থান যেখানে পাহাড়ি স্নিগ্দ্ধ বাতাসের আনাগোনা মন প্ৰাণ জুড়িয়ে যাবে। ভূ-ভারতের বাঙালিরা যা ভাবতে পারে না, তা তুরায় আছে। এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে পঁচিশ-ত্ৰিশটি দূৰ্গা পূজা হয়। শহরের কেন্দ্ৰ স্থলে রংখন নামে এক ঝরণার জল ধরে রেখে শহরের ২৪টি দূৰ্গা প্ৰতীমার বিসৰ্জন দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তুরার সেণ্ট্ৰাল পূজা কমিটি প্ৰশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এক শ্লুইসগেট তৈরি করেছে, যে গেট বন্ধ রেখে জল জমিয়ে বিসৰ্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা এক অভাবনীয় বলা যেতে পারে।গারো সম্প্ৰদায় মাতৃতান্ত্ৰিক সমাজের অংশ, মহিলাদের প্ৰাধান্যই বেশি। সুপার মাৰ্কেটে সাজানো গোছান মহিলা পরিচালিত এক রেস্তোরায় আমরা চা খেলাম। গারো উপজাতি গোষ্ঠী ছাড়াও বাঙালি, বিহারী, কোচ, হাজং, রাভা, নেপালী, অসমীয়া, মারোয়ারী প্ৰভৃতি মিশ্ৰ জনজাতি গোষ্ঠীর বাস তুরা শহরে। রাজনৈতিক বাতাবরণ উষ্ণ নয়, স্থিতিশীল। মনোরম প্ৰাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে স্থানীয় মানুষগুলি মিলে মিশে আছে। দেখে এলাম বাঙালিরা বেশ ভালই আছেন। সেখানে আজও বাংলা মাধ্যমের প্ৰাচীন প্ৰাথমিক বিদ্যালয় আছে, বঙ্গ বালক এবং বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয় শত বছর উত্তীৰ্ণ হয়ে গেছে। তুরা হাইস্কুলও বহু প্ৰাচীন, তুরা নাট্যমন্দিরে এক সময় স্থানীয় বাঙালিরা নাট্য মঞ্চস্থ করতেন। তুরার বাঙালি প্ৰাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ প্ৰাথমিক বিদ্যালয়, নাট্যমন্দির প্ৰভৃতি স্থাপনে গারো সম্প্ৰদায়ের সমাজকৰ্মী এবং বিশিষ্ট বাঙালিরা মিলে মিশে প্ৰতিষ্ঠা করে গেছেন। এ. কে. সরকার, পি.আর চক্ৰবৰ্তী, এ. ঘটক, হরি নারায়ন দে, এ চৌধুরী, রাম সিং সাংমা, রঙ্গম মমিন, মিলটন এস সাংমা, করনেশ আর মারাক, উইলসন আর মারাক, ওমেড ডব্লিউ মমিন, রামকে ডব্লিউ মমিন প্ৰমুখ বিশিষ্ট সমাজকৰ্মীরা এই সব ঐতিহ্যশালী প্ৰতিষ্ঠান গড়তে এগিয়ে এসেছিলেন। সেণ্ট্ৰাল পূজা কমিটির স্মারক গ্ৰন্থ ‘আনন্দম'-র এডিটর ইন চিফ বিশ্বজিৎ নন্দীর লেখনি থেকে এই সব সমাজ কৰ্মীদের নাম জানা গেল। তুরার দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালি। প্ৰায় ২৫-৩০ হাজার বাঙালির বাস। প্ৰায় দেড় শো বছরের প্ৰচীন শহরে ১৩৫ বছরের দূৰ্গা পূজোর সোনালী ইতিহাস আছে। নেপালী দূৰ্গা পূজা কমিটি সেই ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষী। এছাড়াও বাবুপাড়া দূৰ্গা পূজা কমিটি ১৯২১ এবং ঠাকুরবাড়ি দূৰ্গা পূজা কমিটি ১৯৪৬ সাল থেকে পূজোর আয়োজন চলছে। শহরের সব পূজো কমিটির নিয়ন্ত্ৰক সেণ্ট্ৰাল পূজা কমিটির অধীনে ২৪টি পূজো কমিটি যৌথভাবে ‘আনন্দম' নামে এক স্মরণিকা প্ৰকাশ করেছে। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক অরূপ নাগ তুরা শহরের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও ঘরানার কথা জানান। তাছাড়া এই শহরের বাসিন্দা কবি তথা কলকাতাস্থিত মেঘালয় ভবনের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বজিৎ নন্দী প্ৰাচীন তুরা শহরের বাঙালিদের ঐতিহ্য-র কথা তুলে ধরেছেন ‘আনন্দম'-এ। তুরা সফরের আগে সেখানকার ডেপুটি কমিশনার রাম সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, হোয়াটস অ্যাপ-এ এক সাধারাণ ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম বাংলা নিউজ পোৰ্টাল নয়া ঠাহর-এর সম্পাদক হিসাবে। সেই ম্যসেজের সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাই, তিনি  আমাদের পাহাড়ের কোলে অপূৰ্ব সুন্দর সাৰ্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দেন, আমি তার প্ৰতি কৃতজ্ঞ। গত ২৯ জানুায়ারি সাৰ্কিট হাউসে ছিলাম, আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর।
মেঘালয়ের প্ৰথম মুখ্যমন্ত্ৰী এবং মিজোরামের প্ৰথাম রাজ্যপাল ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন এ. সাংমার (Williamson Ampang Sangma) আদি শহর, প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰী তথা প্ৰাক্তন রাজ্যপালের উইলিয়াম সন সাংমার শহরেই উত্তর পূৰ্বাঞ্চলের বিকাশ পুরুষ, তথা দেশের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব পি.এ. সাংমার বাসস্থান, লোকসভার প্ৰাক্তন অধ্যক্ষ সাংমা মেঘালয়ে এক উজ্জ্বল ঘরানা তৈরি করে গেছেন। লোকসভার প্ৰাক্তন অধ্যক্ষ পি.এ. সাংমা তাঁর ‘‘এ লাইফ ইন পলিটিকস' নামে প্ৰায় ৫০০ পৃষ্ঠা ব্যাপী গ্ৰন্থটি এই প্ৰতিবেদককে দিল্লীতে উপহার দিয়েছিলেন। সংসদের এক প্ৰশিক্ষণ শিবিরে অংশ গ্ৰহণ করেছিলেন, এই সাংবাদিক সেখানেই গ্ৰন্থ টি উপহার পাই। সেই আত্মজীবনীমূলক গ্ৰন্থে প্ৰাক্তন রাষ্ট্ৰপতি ড০ এ.পি.জে আব্দুল কালাম, প্ৰাক্তন প্ৰধানমন্ত্ৰী অটল বিহারী বাজপেয়ী, লোকসভার প্ৰাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্ৰমুখ সাংমার সংগ্ৰামময় জীবনের নানা দিক আলোকপাত করেছেন। সাংমা এই প্ৰতিবেদকের কাছে দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্ৰিক প্ৰতিষ্ঠান সংসদের গরিমা ও মৰ্যাদা রক্ষার ক্ষেত্ৰে উদ্বেগ প্ৰকাশ করে বলেছিলেন, সংসদে বিতৰ্কে সুষ্ঠু বাতাবরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সময়ের অপচয় হচ্ছে। অসম সহ উত্তর-পূৰ্বাঞ্চলের বিধানসভাগুলির অধিবেশন ক্ৰমশ সঙ্কুচিত হওয়ায় ক্ষোভ প্ৰকাশ করেছিলেন। প্ৰয়াত সাংমার এক পুত্ৰ করণাড সাংমা মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্ৰী, এক পুত্ৰ জেমস মেঘালয়ের গৃহমন্ত্ৰী, তার কন্যা আগাথা ছিলেন কেন্দ্ৰীয় মন্ত্ৰী সভার সৰ্ব কনিষ্ঠ মন্ত্ৰী। এই বিশাল ঘরানার মালিক সাংমা পরিবারে গৃহকত্ৰী সোরাদিনী দেবীর (Soradini Kongkal Sangma) সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুরার সেই বাড়িতে একজন নিরাপত্তা বাহিনীকেও দেখলাম না। পুরো খোলা-মেলা, কোথাও নিরাপত্তার বাঁধন নেই। সোরাদিনী দেবীর গলায় অসমীয়া গামোছা পড়িয়ে দিয়ে সৌজন্যতামূলক কথা বাৰ্তা বললাম। তিনি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বললেন, আমরা বাংলাদেশ সীমান্তের মানুষ, বাংলা জানবো না তাই কি হয়? আমাদের সঙ্গে ছিলেন অরূপ নাগ, অসীম দাস গুপ্ত, কাকলি ও সান্ত্বনা। পশ্চিম গারো হিলস-র বাংলাদেশ সীমান্তবৰ্তী প্ৰত্যন্তর গ্ৰাম চম্পাহাটি গ্ৰাম থেকে উঠে এসে পি.এ. সাংমা (Porno Agitok Sangma) সারা দেশের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। পাহাড়ি শহর তুরা প্ৰাকৃতিক সম্পদে ভরপূর। ভূগৰ্ভস্থ কয়লার বিশাল ভাণ্ডার। গারো পাহাড়ের কমলা, আনারস, কাজু বিখ্যাত। এছাড়াও আদা, তেজপাতা, কাঁঠাল, গোলমরিচ প্ৰভৃতি কৃষিজাত সামগ্ৰী অঢেল উৎপাদিত হয়। খ্ৰীষ্টান অধু্যষিত তুরা শহরে এই সেই দিন লক্ষ মানুষের সমাবেশে এ বি ডি কে (A’chik Baptist Dalgipa Krima) র ধৰ্মগুরুদের ঈশ্বরের মহত্ব নিয়ে বক্তব্য রাখতে দেখলাম। মন্ত্ৰ মুগ্দ্ধের মতো লক্ষ মানুষ তা মন দিয়ে শুনছেন। এই শহরেই বাঙালিরাও মন প্ৰাণ ঢেলে তাদের শারদীয় উৎসবে মেতে থাকে। কোনও অশান্তি গ্ৰাস করতে পারে নিই। কারণ ডুরমা দেবীর আশীৰ্বাদের ফলে শহরকে আজও বড় ধরণের কোনও অশান্তি স্পৰ্শ করতে পারে নি।



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.