Header Ads

অরণ্যচারীদের অরণ্যেই থাকতে দিন, বিরক্ত করবেন না, সুরক্ষিত হোক সেন্টিনেলিজদের বেঁচে থাকার অধিকার


শঙ্খশুভ্র  দেববর্মণ
 বঙ্গোপসাগরের একটি ছোট্ট দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল(৫৯.৬৭ কিমি2) অগাধ  নীল  জলরাশির মাঝে   উত্থিত এই দ্বীপেই  যেন লুকিয়ে  আছে প্রাচীন  পৃথিবীর সব  রহস্য সেখানে পৌঁছনো দুস্কর। দুঃসাহসী কোনও অভিযাত্রিক ডিঙ্গি থেকে  নেমে  দ্বীপে পা  রাখলেই  অরণ্যের অভ্যন্তর  থেকে  ছুটে আসে  সেন্টিনেলিজ  আদিবাসীর দল। অভিযাত্রীদের দিকে  ঝাঁকে ঝাঁকে  ধেয়ে  আসে বিষ মাখানো তির। ক্রুদ্ধ আদিবাসীরা  ছুরি, বল্লম, লাঠি, কুড়াল, পাথর  নিয়ে  ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুপ্রবেশকারীর ওপর। প্রাণ বাঁচিয়ে তড়িঘড়ি ডিঙ্গিতে উঠে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া  অভিযাত্রীদের কাছে  তখন আর  কোনও উপায় থাকে না। দ্বিতীয়বার সেখানে  যাওয়ার দুঃসাহস   কারোর  হয় না আর। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে শুধু জানা  গিয়েছে ওরা ঝিনুক, বুনো শুকরের  মাংস, কুল জাতীয় ফল, মধু   খায়।  যূথবদ্ধ  যৌনতায় বিশ্বাসী!  প্রাচীন পৃথিবীর  মূর্তমান  প্রতীক  সভ্যতার সঙ্গে  সংশ্রবহীন এইআনকন্ট্যাক্টেড ট্রাইব সভ্য মানুষের সংস্পর্শ থেকে   দূরে থাকতেই পছন্দ  করে ওরা! আমাদের  কাছে  অজানা  তাই আজও  সেন্টিনেলিজদের ভাষা,  সংস্কৃতি এবং  ধর্মীয় বিশ্বাস। জানা  সম্ভব হয় নি ওদের জনসংখ্যার পরিমাণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা,  বর্তমানে সম্ভবত প্রায় ১৫০জনের  মতো  সেন্টিনেলিজ বেঁচে বর্তে আছে। শুধু এক ধারণা; সংখ্যাটা এর  থেকেও  কম হতে পারে!  তথাকথিত সভ্য মানুষের কাছে নর্থ সেন্টিনেল তাই এক  প্রহেলিকাময় দ্বীপ    সুতরাং  এই  কিছুদিন  আগে   ভারত সরকারের সমস্ত  বিধিনিষেধকে   উপেক্ষা  করে অবৈধ উপায়ে  নর্থ   সেন্টিনেল   অনুপ্রবেশকারী খ্রিস্টান মিশনারি জন অ্যালেন  চাউকে (২৬)  যখন  ক্রুদ্ধ  দ্বীপবাসীরা হত্যা  করে  - এমন ঘটনায় তখন সবাই  দুঃখ পেলেও  আশ্চর্য কেউ  হন নি। তবে সেন্টিনেলিজএর   মতো প্রাচীন আদিবাসীদের  তথাকথিত আধুনিক  সভ্যতার  আলোকবৃত্তে নিয়ে আসার  প্রয়াস সঙ্গত  কি অসঙ্গত সে নিয়ে এখন  বিশ্বব্যাপী  বিতর্ক ফেনিয়েছেএর পাশাপাশি  সেন্টিনেলিজদের নিরাপত্তা এবং অস্তিত্বঃ রক্ষার     প্রশ্নটিও কিন্তু  আরও গুরুতর হয়ে  উঠেছে। মিশনারিদের দ্বারা আদিবাসীদের ক্ৰমাগত ধৰ্মান্তরের প্ৰচেষ্টা ঘিরে বইছে আবারও সমালোচনার ঝড়। আসলে রাজনৈতিক আদৰ্শকেই ধৰ্মের আড়ালে রেখে মিশনারিরা পৃথিবীর সৰ্বত্ৰ তাদের ঔপনিবেশিক সত্তাকে অক্ষুন্ন রাখতে চান। আর তাঁদের নিশানায় সহজেই বিদ্ধ হয়সরল আদিবাসীরা। মিশনারিদের চোখে আদিবাসীরা সভ্যতা বিবৰ্জিত ‘আদিম জনগোষ্ঠী’। তাদের আধুনিক সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানে উদ্দীপ্ত করে তোলাকে তাই ঐশ্বরিক কৰ্তব্য বলেই মনে করেন। এরই প্ৰেক্ষিতে বহু মিশনারি আত্মোৎসৰ্গকেও সেই ঐশ্বরিক কৰ্তব্য বলেই ধরে নেন। জন অ্যালেন চাউ’ ও সম্ভবত একইভাবে নিজের জীবন দিতে দ্বিধান্বিত হন নি। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই সহমত পোষণ করছেন, সেন্টিনেলিজদের অস্তিত্বঃ এবং সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে জন অ্যালেন চাউ আখেরে তাদের অসম্মান করতে চেয়েছিলেন এবং শেষ পৰ্যন্ত নিজের প্ৰাণের বিনিময়ে তাঁকে সেই ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে।  
     ভারত  সরকারের  আইন  মোতাবেক সমুদ্র  বেষ্টিত এই  দ্বীপের পাঁচ নটিক্যাল মাইল   অভ্যন্তরে  প্রবেশ  অবৈধ।  নিষেধাজ্ঞা  রয়েছে সেন্টিনিলিজ  সহ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের  অন্যান্য 
আদিবাসীদের ছবি   তোলার ওপরেও।  আদিবাসীদের  আক্রমণের হাত  থেকে   অভিযাত্রীদের  বাঁচানোর জন্যই এইসব   বিধিনিষেধের  ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এর পেছনে    রয়েছে  আরও গভীর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ! মূলোদ্দেশ্য  হল পৃথিবীর  শেষতম প্রাক-নব্য প্রস্তরযুগের একটি  প্রাচীন  আদিবাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্বঃকে কোনওরকমে  বাঁচিয়ে রাখা।  আধুনিক  পৃথিবীর  সঙ্গে   কখনও  কোনও সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি  বলে  সেন্টিনেলিজদের  শরীরে জ্বর, হাম এমন কী  সর্দিকাশির  মতো   সাধারণ  রোগ  সংক্রমণের বিরুদ্ধেও কোনও প্রতিরোধ ব্যবস্থা  গড়ে   উঠে নি। আর এই প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা  গড়ে উঠে নি বলেই  আধুনিক  পৃথিবীর রপ্তানিকৃত এমন সব সাধারণ  অসুখবিসুখের  ফলেও  গোটা সেন্টিনেলিজ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বুক থেকে   সম্পূর্ণভাবে  নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।  বিশেষজ্ঞেরা এই  ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন  যে, জন অ্যালেন চাউ  মাধ্যমে এরই মধ্যে   না আবার বিভিন্ন রোগের  জীবাণু সেন্টিনেলিজদের  মধ্যে  ছড়িয়ে পড়ে! এর ফলে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে  ঘটে  যেতে পারে একটি বড়সড় নৃতাত্ত্বিক বিপর্যয়   জন  অ্যালেন চাউকে  তাই  অনেকে  আখেরে  সেন্টিনেলিজদের মৃত্যুদূত বলেই   অভিহিত  করছেন।  এমন  অনাকাঙ্খিত  ঘটনা সত্যই  যাতে পুনর্বার  না ঘটে সেদিকে এবার সবাই  নজর রেখে চলেছেন। বুঝতে  হবে নৃতত্ব দিক থেকে সেন্টিনেলিজদের  গুরুত্ব।  এশিয়াতে  প্রথম অভিবাসিত মানুষ হিসেবে  ওরাই   এই সময়ে  একমাত্র  জীবিত জনগোষ্ঠী। ৭৫,০০০ বছরেরও  আগে   অ্যাফ্রিকা থেকে মানুষের প্রথম অভিগমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছিল সেই সময়   অ্যাফ্রিকা  থেকে  মধ্যপ্রাচ্য,  ভারত,  বার্মা পেরিয়ে ওরা পৌঁছেছিল  বঙ্গোপসাগরের  নির্জন  আন্দামান  দ্বীপপুঞ্জে। ওদের   অনেকেই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে  বসবাস  শুরু করেছিল স্থায়ীভাবে। কিছু  পরিমাণে আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গেও স্থাপিত  হয়েছিল  ওদের যোগাযোগ।  কিন্তু আন্দামান ভূখণ্ড থেকে কিছুটা দূরে নিঃসঙ্গ নর্থ সেন্টিনিল দ্বীপের আদিবাসীরা কখনই আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে  সম্পর্ক স্থাপনে  বিশ্বাসী ছিল না। সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে সভ্য মানুষ সেই দ্বীপে যেতে চেয়েও ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেন্টিনেলিজদের  সেই  মানসিকতা সম্ভবত  কখনই বদলানোর নয়। এরই প্রেক্ষিতে সভ্য  মানুষের চোখে সেন্টিনেলিজরা হয়ে উঠেছে ‘আদিম’ এক ‘নগ্ন’ জনগোষ্ঠী – আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা  যাদের করায়ত্ত নয়। সীমিত   প্রাকৃতিক সম্পদের  ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে এমন ‘অসভ্য’  আদিবাসীরা।          
সেন্টিনেলিজরা নাকি আগুনও  উৎপন্ন করতে  জানে না। বিষয়ে বিতর্ক আছে। দ্বীপে  এর  আগে যারা যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা তাঁদের পর্যবেক্ষণলদ্ধ অভিজ্ঞতা  অনুযায়ী একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে  সেন্টিনেলিজেরা  আগুন ব্যবহার  করে আগুন উৎপন্নের জন্য সেন্টিনেলিজরা বজ্রপাতের আশায়  বসে থাকে। বজ্রপাতের ফলে লতাপাতায়  উৎপন্ন আগুন তারা নিজেদের  সুবিধা অনুযায়ী  যতদিন দরকার   ততদিনই ব্যবহার করে।   এইভাবেই  প্রাচীনকাল থেকেই নর্থ  সেন্টিনিল দ্বীপে বসবাসরত জনগোষ্ঠী  একাত্ম হয়ে   গিয়েছিল প্রকৃতির সঙ্গে। ক্রমে সবুজ  গরাণের অরণ্য,  সাদা বেলাভূমিই  হয়ে  উঠল ওদের প্রিয় পৃথিবী। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দ্বীপে খাদ্যের সংকট  কখনও কোনওকালেই  ছিল না। দরকার হয় নি চাষাবাদেরও। স্বচ্ছ্ব সমুদ্রের  জলে  খেলা করে মাছের ঝাঁক। তীক্ষ্ণ পাথর লাগানো  বল্লম   অথবা  চোখা কাঠ  লাগানো  তীর ছুঁড়ে সেইসব মাছ  বিদ্ধ  করা সহজ। ঢেউয়ে ভেসে আসে ঝিনুক,  কচ্ছপের  দল। পেট  ভরে  যায়  কচ্ছপের মাংস  খেয়ে।  বনে ছে কুল, মূল,  মধু।  গ্রীষ্মকালে অরণ্য থেকে  সংগৃহীত  এক বিশেষ ধরণের পাতার  রস গোটা দেহে  মেখে নেয়। এই পাতার গন্ধে মৌমাছি কাছে ঘেঁষে না। আরামসে ওরা তখন মধু সংগ্রহ করে। অরণ্যে  ঘুরে  বেড়ায় অগণিত শুকর। শিকার  করতে তেমন বেগ পেতে  হয় না।  খাদ্যের  প্রাচুর্য রয়েছে  তাই  দ্বীপের সর্বত্র। তেষ্টা মেটানোর   জন্য ছড়িয়ে  ছিটিয়ে  রয়েছে দ্বীপের সর্বত্র বৃষ্টি-সঞ্চিত  জলাশয়। নেই  কোথাও হিংস্র পশুর  উৎপাত।  উষ্ণ আবহাওয়ায় বয়ে বেড়ায় আশ্বাসের বার্তা। পরিচ্ছেদের তাই  দরকার  হয় না। নগ্ন জীবন। লতা পাতা ছাওয়া  কুটিরে সবার  বাস।  যাপন  এখানে  নিশ্চিত।   সুখের  এমন  পৃথিবীতে  তাই  অন্য মানুষের পদার্পণ মেনে নেওয়া কী  সম্ভব! সমুদ্র  বেষ্টিত এমন  শুভ্র  সৈকত  দ্বীপেই  সেন্টিনেলিজেরা গত ৩০,০০০ বছর ধরে   আনন্দের  সঙ্গে  বেঁচে আছে। অনাকাঙ্খিত  সভ্য মানুষের অনুপ্রবেশে এমন যাপনে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেই  বিষয়ে ওরা তাই অতি সতর্ক। আধুনিকীকরণের নামে  জীবনের অহেতুক  জটিলতা,    যন্ত্রপাতির প্রসার, প্লাস্টিকের ব্যবহার  ওরা চাইবে  কেন! সেন্টিনেলিজেরা  না চাইলেও সভ্য মানুষ কিন্তু  বারবারই হানা  দিয়েছে নর্থ সেন্টিনিল  দ্বীপে। তথ্য  ঘেঁটে জানা যায় প্রায়  ১০০০  বছর আগে চাইনিজ এবং পরে আরবী  অভিযাত্রীরা  নর্থ  সেন্টিনেল  দ্বীপে পা  রাখার  চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের  লক্ষ্য  করে  ছুটে এসেছিল  অজস্র  তীর। জাহাজে  ফিরে  আসতে বাধ্য হয়েছিল অভিযাত্রীদের দল।  তারা  সেন্টিনেলিজদের  পাখির  ঠোঁটওয়ালা  তিন ফুট উচ্চ মানুষের অবয়ব বিশিষ্ট এক প্রকার  প্রাণী বলে উল্লেখ করেছিল! তারপরেও   আধুনিক মানুষ    সেই দ্বীপে  যাওয়ার  চেষ্টা করেছে বহুবার; কিন্তু সবগুলি  অভিযানই  শেষ  পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে। এই  সময়ে  ভারত সরকারও সেন্টিনেলিজদের অস্তিত্বঃ রক্ষার  সংরক্ষণে অতিমাত্রায় সতর্ক।  সমস্ত  সুযোগ সুবিধা   থাকা  সত্বেও  ভারতীয় নৌ বাহিনী  নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে তাদের  গতিবিধি   সীমিত  রেখেছে।      
 
১৩  শতকে মার্কো পোলো সেন্টিনেলিজদের  সম্পর্কে জানতে  পেরে  এই  তথ্য  নথিবদ্ধ করেছিলেন যে, ওরা অত্যন্ত হিংস্র  আর  নিষ্ঠুর; সামনে যা পায়  তা-   খায়! ১৫৬৩  আর  এক নাবিক মাস্টার  সিজার ফ্রেডরিক লিখেছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে  কোনও জাহাজ  যদি নর্থ  সেন্টিনিল  দ্বীপে এসে ভিড়ে তবে তার  নাবিকদের  আর জীবিত ফিরে  আসা  সম্ভব হয় না!  তবে সেন্টিনেলিজ সহ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের  অন্যান্য   জনগোষ্ঠী  যে নরখাদক -  আজ পর্যন্ত  তার  কোনও প্রমাণ মেলে নি।       

ব্রিটিশেরা ভারতকে উপনিবেশ বানানোর পর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের   নির্বাসনে পাঠানোর জন্য  ১৮৫০  গোটা   আন্দামান  দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করে। সেই সময় স্থানীয় আদিবাসীদের  সংখ্যা ছিল ৫০০০এর  মতো। আদিবাসীরা   কিন্তু  বহিরাগতদের  সংস্পর্শের ফলে হাম  ইনফ্লুয়েঞ্জা সিফিলিসের  মতো রোগে আক্রান্ত  হয়। কয়েক হাজার আদিবাসী তখন মারা যায়। ১৮৬০  ব্রিটিশেরা গ্রেট আন্দামানিজদের একত্রে রাখার  জন্য আন্দামান হোমতৈরি করেছিল।  হোমে  থাকাকালীন  কয়েকশো আদিবাসী মারা যায়। ১৫০টি  শিশু তখন   জন্মে ছিল। একটি  শিশুও  দু  বছরের  বেশি  বাঁচে নি!

ব্রিটিশেরা কিন্তু  তখনও নর্থ সেন্টিনিল  দ্বীপকে তাদের  কাজকর্মের আওতার  বাইরেই  রেখে  দেয়। ১৮৮০ মরিস  ভিডাল  পোর্টম্যান নামে এক উদ্ধত  ইংরেজ  প্রশাসক  সশস্ত্র  পুলিশবাহিনী নিয়ে নর্থ সেন্টিনিল  দ্বীপে হামলা  চালিয়েছিলেন  এক  পুরো  সেন্টিনিলিজ  পরিবারকে  অপহরণ করে  নিয়ে আসা হয়   পোর্ট  ব্লেয়ারএ।  সব জন  প্রাপ্তবয়স্ক   সেন্টিনেলিজ তৎক্ষণাৎ মারা  যায়। নিয়ে  চারদিকে শোরগোল উঠে।  তাঁর কৃতকর্মের জন্য  সমালোচিত হন পোর্টম্যান। লজ্জিত  এবং বিব্রত পোর্টম্যান তড়িঘড়ি বেঁচে থাকা  বাকি  চারটি  বাচ্চাকে  কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে নর্থ সেন্টিনিল  দ্বীপে ফের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিদেশি  সেই উপহার সামগ্রীও সেন্টিনেলিজ বাচ্চারা পরে ফেলে   দিয়েছিল।  আন্দামান  দ্বীপপুঞ্জের  আদিবাসীদের   জবরদস্তি  সভ্যকরে  তোলার প্রচেষ্টার জন্য পোর্টম্যান  অনুতপ্ত  হন। লন্ডনের রয়্যাল  জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে  ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বহিরাগতদের  সংশ্রব সেন্টিনালিজদের ক্ষতি  ছাড়া  ভালো  কিছুই  করে নি। এই  কথা ভেবে দুঃখ হয়  এমন একটি  প্রাণবন্ত জনগোষ্ঠী দ্রুত অবলুপ্তির পথে চলেছে!’’  এরপর  এক শতক সেই দ্বীপে আর  কোনও অভিযান চালানো  হয় নি।

১৯৭০ আবার  একদল  নৃতত্ববিদ সেন্টিনেলিজদের  বিষয়ে জ্ঞান  আহরণের জন্য নোটবুক, ক্যামেরা  প্রভৃতি নিয়ে দ্বীপে পদার্পণের চেষ্টা করেছিলেন। যথারীতি  সেবারও   সেন্টিনেলিজদের  তির-বৃষ্টি থেকে কোনওরকমে  বেঁচে জাহাজে  ফিরেছিলেন সেই নৃতত্ববিদেরা। বেশি কিছু  জানা  তখনও সম্ভব হয় নি।  শুধু  দূর থেকে  দেখতে  পেয়েছিলেন  যূথবদ্ধ  যৌন  ক্রিয়ায়  মত্ত সেন্টিনেলিজদের।
   
১৯৭৪এও  আরও একবার নর্থ সেন্টিনিল দ্বীপের  আদিবাসিদের  সঙ্গে  সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেবারও সেন্টিনিলেজদের সহিংস  আক্রমণের  মুখে পড়ে অভিযাত্রীরা ফিরে আসতে  বাধ্য হয়। জাহাজে ফেরার আগে অভিযাত্রীরা সেন্টিনেলিজদের  জন্য  প্লাস্টিকের গাড়ি, অ্যালুমিনিয়ামের বাসন  আর একটি জীবিত  শুকর  রেখে এসেছিল। ওরা কিছুই  গ্রহণ করে নি। শুকরটিকে মেরে  ওরা বালিতে  পুঁতে রেখে   দিয়েছিল!

বারবার ওরা   বহির্দুনিয়াকে এই  কথাই বোঝাতে চেয়েছে সভ্যতা কিম্বা  সভ্যতাহীনতা আসলে  এক   ভাববাচ্য  সত্য মাত্র।  প্রকৃতি নির্ভর জীবনকেই   সেন্টিনিলেজরা   সভ্যতা  বলে মনে করে।  বাহুল্যের স্থান নেই এখানে;  নেই   অহেতুক  লোভ  লালসা এবং  প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্কীর্ণতা সেন্টিনেলিজদের  কাছে বরং  আধুনিক পৃথিবী  তাই  হয়তো অসভ্য এবং ঘৃণ্য!

সেন্টিনেলিজদের  সম্পর্কে  সাধারণ বিশ্ববাসী  অবহিত হয় ২০০৪ -  সেই  ভয়ঙ্কর সুনামি  পর। সুনামি তাণ্ডবে  সেবার  প্রায়  ২৩০,০০০ লোক  মারা গিয়েছিল। এপিসেন্টারের  কাছাকাছি হওয়া সত্বেও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের  আদিবাসীরা  নিজেদের রক্ষা করতে  সমর্থ হয়েছিল  আশ্চর্যজনকভাবে। সম্ভবত বেশ  কিছু  পশুপাখির  মতো  আন্দামান  দ্বীপপুঞ্জের  আদিবাসীরাও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস করায়ত্ত করতে  পেরেছে  বলে  বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিধ্বংসী ঢেউ যে  দ্রুত  বয়ে  আসছে সে কথা সম্ভবত ওরা বুঝতে পেরেছিল। মহামূল্য  অনির্বাপিত অগ্নিকুণ্ড নিয়ে ওরা সবাই  উঁচু  গাছের ডালে   চড়ে বসেছিল সেই সময়   

সুনামি  অব্যবহিত পরে  সেন্টিনেলিজদের  অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিল ভারতীয়  নৌ বাহিনী। অরণ্য অভ্যন্তর  থেকে বেরিয়ে এসে সেন্টিনেলিজেরা তখন হেলিকপ্টারের উদ্দেশ্যে তির  বল্লম ছুঁড়েছিল। সেই  ছবি   তুলে  রাখা  হয় ক্যামেরায় পাইলটও জানান, বহাল  তবিয়তেই  আছে  সেন্টিনেলিজেরা। রে ভারত  সহ বিশ্বের  বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায়  ছবিটি  প্রকাশিত হয়।   সুনামি ফলে যে সেন্টিনেলিজদের কোনও ক্ষতি হয় নি সেই  সচিত্র  তথ্য  জেনে সবাই আশ্বস্ত হন  ভারতীয়  নৌ বাহিনীর  প্রেরিত  হেলিকপ্টারের   উদ্দেশ্যে  তির  নিক্ষেপকারী সেন্টিনেলিজদের  সেই  ছবিটি   আজ যন্ত্র  নির্ভর জটিল  আধুনিক সভ্যতা  বনাম  প্রকৃতি নির্ভর  সরল  জনজাতি ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আধুনিক  সভ্যতার আগ্রাসী  অভিযানের  ফলেই  পৃথিবীর বুক থেকে   নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অরণ্য কিম্বা প্রকৃতি নির্ভর কত  প্রাচীন জনগোষ্ঠী। যে কয়টি রয়ে  গেছে আসন্ন  ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তারাও।  উত্তর ব্রাজিলের ইয়ানোমামি, বলিভিয়ার আয়েরিও টোটোবিয়েগোসোদে জনগোষ্ঠীর  অবস্থা  আজ সেন্টিনেলিজদের  মতো।  পৃথিবীর বুক থেকে  চিরতরে  হারিয়ে যেতে পারে এইসবআনকন্ট্যাক্টেড  ট্রাইব’!  যেমন করে  হারিয়ে  গেছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেরবোজনজাতি। ২০১১  বো   জনজাতির শেষতম সদস্যা মারা যান। তার  মৃত্যুর সঙ্গেই  বিলুপ্ত হয় বো জনগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি, জীবনচর্যা সব কিছু।
আধুনিক  পৃথিবীর লোভ আর চাহিদা অন্তহীন। প্রাকৃতিক  সম্পদ  লুঠ করে সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়। ধ্বস্ত হয় আশেপাশের  প্রকৃতি পরিবেশ  সভ্য মানুষ  তারপর  দূরে অদূরে  তখনও অবশিষ্ট অক্ষত অরণ্যভূমি কিম্বা অনাবিষ্কৃত দ্বীপে হামলা  চালায়। আর সে সময় প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের পথে প্রধান  প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়  প্রকৃতি পূজকঅসভ্যআদিবাসির  দল। সামরিক অভিযানের পাশাপাশি ধর্মের নামে বিজ্ঞানের  নামে আদিবাসীদের  তখন  বিভিন্ন ভাবে  বশীভূত করার  চেষ্টা চলে। সভ্য মানুষের পাপে পৃথিবী আজ কলুষিত আর কত পাপ  সইবে এই  পৃথিবী! এবার  শুরু  হোক পাপ স্খলনের পালা। হোক সভ্যতার  আত্ম বিশ্লেষণ। স্বীকৃত হোক পৃথিবীর সর্বত্র  অরণ্যজাত আদিবাসীদের বেঁচে থাকার অধিকার। বন্ধ হোক আদিবাসীদের ধর্মান্তরের অশুভ প্রক্রিয়া। দেখতে  হবে ধর্মীয় উন্মাদনায়  তাড়িত জন অ্যালেন চাউ মতো আর কারোর যেন এমন দুঃখজনক ঘটনা না ঘটে         

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.