ডাঃ অমিতাভ দে'র মৃত্যু একটি সম্ভাবনাময় জীবনের সমাপ্তি, তাঁকে শ্ৰদ্ধাঞ্জলি
প্ৰয়াত ডাঃ অমিতাভ দে
নিউ জার্সির সমরসেট থেকে আশীষ কুমার দে
গত ৬ নভেম্বর ভারতীয় সময় রাত ১১টা ৩০ নাগাদ আমার এক বন্ধু পাঠান মেসেঞ্জারে দুটি লাইন। 'Dr Amitava Dey passed away sometime back at international hospital'. খবরটি পড়ে হতবাক হয়ে যাই, অনেকের কাছেই জানতে চাই খবরটির সত্যতা অত রাতে আর কোন খবর পাই নি। নানা ধরনের ভাবনা আসতে শুরু করে, খবরটি ঠিক নয়, গুজব বা হয়তো অন্য কিছু। সকালে অনেকেই জানায় খবরটি সত্যি। লামডিং এর এক চিকিৎসক বন্ধু জানান, ডেঙ্গুজ্বর হয়েছিল, রেল হাসপাতালের এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছিলেন, শনিবারে বাড়াবাড়ি হলে হোজাই ও পরে গুয়াহাটির অ্যাপেলোতে ভর্তি করা হয়, মাল্টিপল অরগ্যান ফেইল হলে মারা যান। এও জানতে পারলাম লামডিঙে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নিজে একজন MS(Opthalmology ) ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক, স্ত্রী ধাত্রীবিশেষজ্ঞ। তাঁর এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হল। একজন সম্ভাবনাময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাত্র ৫৬ বছরে এমন একটি রোগে মৃত্যু হল যা দুরারোগ্য তো নয় নিরাময়ের সম্ভাবনা আছে। তাঁর মৃত্যু সামাজিক ভাবে অপূরনীয় ক্ষতি। আমাদের দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ১: ১১000। তাও সব স্থানে সমান নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই সংখ্যা হওয়া উচিত ১:১000। একজন সাধারণ MBBS তৈরি করতে সরকারের ও ব্যক্তিগত ব্যয় অনেক। সেখানে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এমনভাবে মারা যাবেন খুবই দুঃখজনক ঘটনা। যিনি বেঁচে থাকলে সমাজকে আগামী তিরিশ বছর অনায়াসে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে পারতেন। একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষকের ছেলে হয়ে তিনি নিজের প্রতিভার দ্বারা শিলচর মেডিক্যাল কলেজ থেকে MBBS, ও পরে MS ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশের নামী চক্ষু প্রতিষ্ঠান থেকে পেশাগত উৎকর্ষের জন্য নিয়মিত CME তে অংশ নিতেন। আমার সাথে পরিচয় ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে। ঘরোয়া সিদ্ধান্ত নেন পাল্স পোলিও অভিযানে অংশ নেবেন। তিনি তখন লামডিং সিভিল হাসপাতালের ইনচার্জ। এর পর ১৯৯৬ সালে তিনি স্বস্ত্ৰীক ঘরোয়ার সদস্য হন । ঐ বছরই ন্যাশনাল স্কুল হেল্থ প্রোগ্রামে ঘরোয়াকে ৬৪ টি বিদ্যালয়ের ছাত্ৰছাত্ৰীদের এই বিদ্যালয়গুলি ছিল নগাঁও, কাৰ্বি আঙলং ও এন সি হিলে। তিনি বেশ কয়েকটি দুর্গম এলাকায় গিয়ে কাজ করেছেন। পাল্স পোলিও প্রোগ্রামে ঘরোয়ার প্রোগ্রাম অফিসার হিসাবে অনেক বছর দায়িত্ব পালন করেন। মাদার অ্যন্ড চাইল্ড হেল্থ ট্রেনিং পরিচালনা, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও ১৯৯৮ সালে পূব লামডিং এর মহামারীর সময়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৭ সালে পরিবেশ মন্ত্রকের ইকো ক্লাবের প্রথম কোঅর্ডিনেটর ছিলেন ডাঃ দে, যা লামডিং এর বিদ্যালয়গুলিতে চলত। তাঁর উদ্যোগ ঘরোয়াতে সরস্বতী পুজো শুরু হয় যা পরবর্তীকালে ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তিনি প্রতিহিংসার শিকার হন ড০ দে এবং তাঁর স্ত্রীকে বদল করা হয়। আমি ও ঘরোয়ার কিছু সদস্য তদানীন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কমলা কলিতার সঙ্গে দেখা করে বদল রদ করার অনুরোধ করি। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাঁকে এপিবিএন ২ এবং তাঁর স্ত্রীকে লামডিং আনা হয়। ২০০৩-৪ এরপরে ধীরে ধীরে তিনি আমাদের থেকে দূরে সরে যান ও পরে জানতে পারি 'হেল্প' নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন আমরা খুব খুশী হয়েছিলাম এবং প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবসে মুখ্য অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। পরে মনে হয় সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি এরপরে সাহিত্য চর্চা ও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যসোসিয়েশন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি একজন প্রতিভাবান সুবক্তা ও কমিউনিটি হেল্থ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন। রেল হাসপাতালের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে দেখা হত তাঁর সাথে। তাঁর স্ত্রী ডাঃ সুমিত্রা দে ঘরোয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে এখনও নিয়মিত উপস্থিত থাকেন রিসোর্স পার্সন হিসেবে। একজন চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে আমি তাঁর ওপর আস্থাশীল ছিলাম। আমাদের চোখের কোনও সমস্যা হলেই তাঁর পরামর্শ নিতাম। এর মধ্যে ২০০৯ সালে আমিও বদলি হয়ে চলে যাই বদরপুর, ডিমাপুর ও ২০১৫ তে অবসর নিয়ে ব্যাঙ্গালুরুবাসী তাই সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ কমে যায় শেষ দেখা ২০১৬ র মার্চ মাসে লামডিং এর একটি নার্সিংহোম উদ্বোধনের সময়। তাঁর অসময়ে চলে যাওয়া একটি সম্ভাবনাময় জীবনের সমাপ্তি ।
কোন মন্তব্য নেই