Header Ads

সংবিধান বিরোধী, দেশ বিরোধী দুষ্টু চক্ৰই আজ অসমের ভাগ্য বিধাতা

অসমের প্ৰতিটি ঘটনায় আক্ৰমণের সফট টাৰ্গেট সেই বাঙালিরা, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল তিনসুকিয়ায়

অমল গুপ্ত, গুয়াহাটিঃ 
অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার উজান অসমের তিনসুকিয়া জেলার চৈখোয়া ঘাট পুলিশ আউট পোষ্ট থেকে প্ৰায় ২০০ মিটার দূরবৰ্তী ধলার দারিদ্ৰপীড়িত বিসনীমুখ খেরবাড়ী গ্ৰামে সন্ধ্যা নেমে এসিছিল। কৃষি জমি থেকে বরবটি, মূলো ইত্যাদি শাক-সব্জি তুলে এনে বিশ্বাস পরিবারের সদস্যরা সন্ধ্যা প্ৰদীপের আলোর মাঝে সন্দেহ জনক দুটি বাইকে চারজন যুবককে আসতে দেখেন। তাদের ঘরে এসে ‘একবার আসুন আপনাদের সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে।' অনন্ত বিশ্বাস এবং অবিনাশ বিশ্বাস যেতে চাইলে সঙ্গে তাদের বাবা শ্যামলাল বিশ্বাসও সেই ডাকে সারা দেন। কিছুদূরে এক সেতুর কাছে নিয়ে গিয়ে তাদের লাইন ধরে বসতে বলা হয়, অন্য তিনজনকেও তারা ডেকে আনে। সামরিক পোষাক পড়া মুখ ঢাকা হিন্দিতে নিজেদের মধ্যে কথাবৰ্তা বলছিল। লাইনে বসিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে এ কে ৪৭ -এর গুলিতে তাদের ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। একজন কোনও রকমে বেঁচে ফেরে। শ্যামলাল বিশ্বাস, অনন্ত বিশ্বাস, অবিনাশ বিশ্বাস, ধনঞ্জয় নমঃশূদ্ৰ এবং সুবল দাস ঘটনাস্থলে প্ৰাণ হারান। ২০০ মিটার দূরে চৈখোয়া ঘাট আউট পোষ্ট, পুলিশকে খবর দিলেও আসেনি। মোবাইলে সুইচ অফ করে দেওয়া হয় বলে গ্ৰামবাসীরা অভিযোগ করেছে। অসমের সফট টাৰ্গেট বাঙালি হিন্দুরা বরাবরই রাজ্যের উগ্ৰ জাতীয়তাবাদিদের আক্ৰমণের লক্ষ্য। অবিনাশের পরিবার এবং অন্যান্য নিহত পরিবারের পরিজনরা একবাররে জন্যেও বাংলাভাষায় কথা বলেনি। অসমীয়া জনগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি গ্ৰহণ করেই তাদের জীবন নিৰ্বাহ, জাতীয় নাগরিপঞ্জীতে তাদের প্ৰত্যেকের নামও অন্তৰ্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের বাঙালি বলেই আক্ৰমণ করা হয়। অসমের বাঙালি হিন্দুরা দুহাত ভরে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, সেই ভোটের জোরে বিজেপি দিশপুরের ক্ষমতায় বসে। কিন্তু এই বিজেপি সরকারের সময়েই এন আর সি উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলে এবং ‘ডি' ভোটারের তাদেরকে সব চেয়ে বেশি নিৰ্যাতনের শিকার হতে হয়ে। রাজ্যের ৬ টি ডিটেনশন ক্যাম্পে ১০০০-এর বেশি বাঙালি হিন্দু-মুসলিমকে ক্যাম্পে আটক করে রাখা হয়। স্বাধীন ভারতে বিনা অপরাধে জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে আটকিয়ে রাখার কোনও রেকৰ্ড নেই। এত দিন পর সুপ্ৰীমকোৰ্ট বিষয়টি নজরে এসেছে। অসম বাংলাদেশ সীমান্তে ২৬৩ কিলোমিটার অধিকাংশ উন্মুক্ত হয়ে পরে আছে, অনুপ্ৰবেশ চলছেই। প্ৰকৃত ভারতীয় নাগরিকের সংজ্ঞা নিৰ্ণয় হয়নি। এর মধ্যেই বিদেশী নোটিশও দেওয়া চলছিল। অথচ এন আর সি কৰ্তৃপক্ষ বাদ বিচার না করেই হাজার হাজার প্ৰকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম কেটে বাদ দেয়। যাদের অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু। তারই করুণ পরিণতি হিসাবে বহু বাঙালি আত্মঘাতী হয়। স্বাধীন অসমের স্বপ্ন দেখা সশস্ত্ৰ আন্দোলনের প্ৰবক্তা আলফার প্ৰতি রাজ্যের মানুষের দুৰ্বলতা বরাবর, তা রাজ্যের ক্ষতি করছে। বেআইনী সংগঠন আলফা নেতাদের প্ৰরোচনামূলক বক্তব্য ফলাও করে প্ৰচার করছে সংবাদ মাধ্যম। শারদীয় উৎসবের প্ৰাককালে গুয়াহাটি মহানগরের প্ৰাণ কেন্দ্ৰ ফেন্সী বাজারের কাছে বোমা ফাটিয়ে আলফা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করলেন, তারা হিন্দু বাঙালিদের বিরুদ্ধে তাদের এই প্ৰতিবাদ। সংবাদ পত্ৰগুলিতেও তা প্ৰচার করা হল। সরকার এই ঘটনাই প্ৰকৃত দোষীদের গ্ৰেফতার করার প্ৰয়োজনবোধ করলেন না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল কোনও দিনই লোকসভায় পাশ হবে না। অনিশ্চিত এই বিলকে কেন্দ্ৰ করে রাজ্যে জাতীয়তাবাদি সংগঠনগুলি যে ভাবে বাঙালি বিরোধী হাওয়া তুললো তা নজির বিহীন। বাংলাদেশ অসম থেকে অনেক উন্নত তাদের মাথা পিছু আয় অসম রাজ্য থেকে বহুগুণ বেশি। সেই বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি বাঙালি হিন্দু অসমে এসে আশ্ৰয় নেবে তার কোনও যুক্তিযুক্ততা নেই। এই ইসু্যকে কেন্দ্ৰ করে কৃষক মুক্তি সংগ্ৰাম সমিতি এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি রাজ্য জুড়ে আন্দোলনে নামে সহজ-সরল অসমীয়াভাষিকে আবেগিক করে তুলে বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়া করায়। রাজ্যের বাঙালি হিন্দুরা অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি গ্ৰহণ করেনি তাদেরকে প্ৰশ্ৰয় দিলেই ত্ৰিপুরার মতো রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করবে। কিন্তু রাজ্যের গরিব, শ্ৰমজীবি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষ অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি গ্ৰহণ করেছে তাদেরকে পাশে নিয়ে চলা সম্ভব। কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের নিয়ে সম্ভব নয়। এই মূল্যায়ন করে রাজ্যের অধিকাংশ সংগঠন, বুদ্ধিজীবি বাঙালি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে প্ৰায় জেহাদ ঘোষণা করেছে। ১৯৭১ সালের পরে আসা বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে তারা সরব। কিন্তু বাঙালি মুসলিম যারা ১৯৭১ পরে এসেছে তাদের ব্যাপারে বিস্ময়কর ভাবে মৌনব্ৰত অবলম্বন করেছে। আলফা সংগঠনের নেতারা বাংলাদেশের ভাষা- সংস্কৃতিকে গ্ৰহণ করে সে দেশে বহু কাল কাটিয়েছেন, তাই তাদের বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্ৰতি এক সহানুভুতি থেকেই গেছে। আলফা ক্যাডাররাও জাতীয়তাবাদি সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবিদের মতো মুসলিম জনগোষ্ঠীকেই পছন্দের চোখে দেখে। এই প্ৰেক্ষপট তো আছেই তার সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদি সংগঠনের উষ্কানি ও প্ৰরোচনামূলক মন্তব্য হিতে বিপরীত হয়েছে। তার সঙ্গে সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে বৈদু্যতিন মাধ্যম লাগাতার ভাবে বাঙালি বিরোধী হাওয়াকে বাড়তে দিয়েছে। শাসক দলের সদস্যরাও এই হাওয়াকে গরম করেছে। এই সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি তিনসুকিয়ার হত্যাকাণ্ড। মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সনোয়াল চেন্নাই থেকে ফিরেই এসে এই মৰ্মান্তিক ঘটনায় একাংশ রাজনৈতিক দল এবং সংবাদ মাধ্যমের দিকে আঙুল তুলেছেন। ধলার ঘটনায় আলফাকে সন্দেহ করা হলেও আলফা বিবৃতি দিয়ে হত্যার ঘটনা অস্বীকার করেছে। রাজ্যের মানুষ ভুলে যায়নি মাজুলিতে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য হিসাবে সঞ্জয় ঘোষ উন্নয়নমূলক কাজ করছিলেন। তখন আলফা ঘোষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যখন ঘটনায় আন্তৰ্জাতিক পৰ্যায়ে সমালোচনার ঝড় উঠে তখন আলফা তা অস্বীকার করে দেয়। একই ঘটনা ধেমাজির শিশুদের হত্যাকাণ্ডদের ক্ষেত্ৰেও পরে তাদের হত্যার পিছনে  আলফার হাত ছিল বলে স্পষ্ট হয়ে যায়। গতকালের তিনসুকিয়ার ঘটনাতে দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আলোচনাপন্থী আলফা সদস্যদের সঙ্গে কেন্দ্ৰর আলোচনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে আলফা হত্যাকাণ্ডে তাদের হাত নেই বলে দাবি করছে বলে বাঙালি নেতাদের অভিযোগ। প্ৰতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবংঙ্গের মুখ্যমন্ত্ৰী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই অসমের হত্যার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করছে। শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব মমতাকে এবং বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্যকে সতৰ্ক করে দিয়ে সংযত থাকার পরামৰ্শ দিয়েছেন। এই প্ৰতিবেদক গুয়াহাটি টিভি চ্যানেল নিউজ-১৮-এ এক টক শোয়ে অংশগ্ৰহণ করে বরাক ব্ৰহ্মপুত্ৰ নেতাদের কথাবাৰ্তাএবং মন্তব্যে বাক সংযম করার আহবান জানিয়েছিলেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে। কিন্তু ঘটনার পরেও রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সোসাল মিডিয়ায় প্ৰরোচনামূলক মন্তব্য অব্যাহত আছে। মুখ্যমন্ত্ৰী অপরাধীদের গ্ৰেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কড়া নিৰ্দেশ দিয়েছেন। প্ৰতি ঘটনাতেই একই রকম নিৰ্দেশ, কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্ৰে দোষীরা শাস্তি পায় না। সংবিধান বিরোধী, দেশ বিরোধী চক্ৰই আজ অসমের ভাগ্য বিধাতা। তাদের নিয়ন্ত্ৰণ করার সদইচ্ছা বা ইচছা কারওই নেই। দূৰ্ভাগ্য অসমের উন্নয়নের পাশে কেউ নেই, ধ্বংসের পাশে সবাই।অসমকে ভালোবাসার কি কেউ নেই?



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.