Header Ads

হারানো সুযোগের পুনঃপ্রাপ্তি : আসাম এই সময়

অরূপ বৈশ্য

আসামে এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন চল্লিশ লাখেরও বেশি মানুষ। এই চল্লিশ লাখের থেকে কয়েক লাখ নেপালি, কোচ-রাজবংশী, ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতীয় ভাষিক গোষ্ঠী বাদ দিলে যারা রয়েছেন তারা হচ্ছেন বিশাল সংখ্যক বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরাখবর থেকে কেউ এটা সহজে অনুমান করে নিতে পারেন যে বাদ যাওয়া অংশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই বাংলাভাষী মুসলমান (যারা স্থানীয়ভাবে ‘মিয়া’ বলে সম্বোধিত হন) এবং বাংলাভাষী দলিত জনগণ, বিশেষ করে নমঃশূদ্র ও ভালো সংখ্যক কৈবর্তরা। তালিকা থেকে বাদ যাওয়াদের জনবিন্যাসের দলিত ও ‘মিয়া’ মুসলমানদের প্রেক্ষিতটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দলিত ও মুসলমানরাই আসাম আন্দোলনের সময় গণহারে উগ্রজাতীয়তাবাদের নির্মম উন্মত্ততার মুখোমুখি হয়েছে। তারা জনবিন্যাসের দুর্বল ও ভঙ্গুর একটা অংশ যারা আসাম আন্দোলনের সময়ে ছিল ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক, আর এখন দিনমজুর ও মজুরি শ্রমিকের বড় অংশ।

২০১৫ সালে এনআরসি প্রক্রিয়াটি যখন সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়, তখন আসামের প্রায় সমস্ত সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীরা স্বাগত জানিয়েছিল এই আশায় যে এনআরসি-র মাধ্যমে কয়েক যুগ থেকে চলে আসা বাংলাভাষী দলিত ও মুসলমান জনগোষ্ঠীদের উপর অবৈধ অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারী জাতীয় যে তকমা ও এ নিয়ে রুটিন মাফিক হেনস্তার একটা অন্ত হবে। কিন্তু তাদের এই ভ্রান্তি অচিরেই কেটে যায় যখন হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ার তাদের সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা নিয়ে ময়দানে নেমে পড়ে। সঙ্ঘ প্রথম দিকে এটা প্রচার করতে থাকে যে এক কোটিরও অধিক বাঙালি হিন্দু ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন যাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই আসামে রয়েছেন। তারা এই প্রচারাভিযান চালায় দুটি উদ্দেশ্যে – একটি হচ্ছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণটা আরো পাকাপোক্ত করা। অন্যটি হচ্ছে অসমিয়া ভাষিক আবেগকে চাগিয়ে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সবগুলো ডিটেনশন ক্যাম্প তুলে দেবেন ও আসামের ভাষিক সংখ্যালঘু ভোটারদের উপর ‘ডি’ (ডাউটফুল) চিহ্নিত করে হেনস্তার এই সরকারি প্রক্রিয়ার ইতি টানবেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি হিন্দু ভোটারদের অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার মাত্রা বাড়তে থাকে। কিন্তু মোদি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন যার ফলে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে, যাকে প্রশমিত করতেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবছরই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ সামনে আনে ; যদিও বিজেপি এটা ভালো জানে যে সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতার পরীক্ষায় এই বিলটি সহজেই ফেল করবে। অন্যদিকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ, যার অনেকেই সংসদীয় বাম শিবিরের, তারা সঙ্ঘের দ্বারা প্রচারিত সেই ১ কোটি উদ্বাস্তুদের সংখ্যাটাকেই হাতিয়ার করে ও নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে সঙ্ঘের হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে পরাস্ত করার নামে অসমীয়া জাতীয় আবেগকে নাড়িয়ে দিতে মাঠে নেমে পড়ে। অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো সংসদীয় বামেদের কাছ থেকে এই জমি ছিনিয়ে নিতে সঙ্ঘের নির্দেশে এই বাম শিবিরের হাত ধরে। উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি অসমিয়া জনগণের সেই পুরোনো ভিত্তিটা হারিয়ে ফেলেছে। এর নানা কারণ রয়েছে। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন, বিশাল সংখ্যক মজুরি শ্রমিক তৈরি হয়ে যাওয়া, অসমিয়া মধ্যশ্রেণির নতুন প্রজন্মের বেসরকারি খণ্ডে দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তর, বহুজাতিক ও ভারতীয় মুৎসুদ্দিদের দ্বারা বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি)-র মতো আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কগুলো  থেকে আসা বৈদেশিক লগ্নি পুঁজির সাথে নিজেকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলা মধ্যশ্রেণির একাংশ, যারা উপ-ঠিকাদার ক্ষুদ্র সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে, এবং উগ্রজাতীয়তাবাদের দীর্ঘদিনের হিংসাত্মক ও ব্যর্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোতে বিরক্ত ও অবসাদগ্রস্ত অসমিয়া জনগণ উগ্রজাতীয়তাবাদীদের জনভিত্তিকে দুর্বল করেছে। কিন্তু এই এনআরসি-র প্রক্রিয়াতে এবং আসামের সংসদীয় বামেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার কারণে সেই উদার বাম শিবিরের বিশ্বাসযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় শাসন চালানো রাষ্ট্রক্ষমতার সাহায্য নিয়ে প্রায় প্রত্যাখ্যাত উগ্রজাতীয়তাবাদী শিবির আবার হারানো জমি কিছুটা পুনরুদ্ধারের সুযোগ পেয়ে যায়। সঙ্ঘ পরিবার চাইছিল যে এনআরসিকে আমলাতান্ত্রিক ছলনার মাধ্যমে এমনভাবে তৈরি করা যেতে পারে যেখান থেকে দশ-লাখের গুণিতক হিসাবে মুসলমান জনগণকে বাদ দেওয়া যাবে – ফলে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক-উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটা পাকাপোক্ত মেলবন্ধনকে শক্তিশালী করা যাবে। এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়ায় সঙ্ঘের এই উদ্দেশ্য আংশিকভাবে সফল। তবে অন্তিম দৃশ্য দেখার আগে এখনও অনেক খেলার বাকি রয়েছে।

আসামে সাম্প্রদায়িক-উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তি এবং বামপন্থীদের একাংশ – উভয় পক্ষই একই স্বরে এনআরসি প্রক্রিয়াকে প্রশংসা করেছে। এর বিপরীতে এই প্রক্রিয়ার জটিলতা ও ভারবহুলতা, কিংবা এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব প্রমাণের নিয়ম-নীতিগুলো বার বার বদলে দেওয়ার ফলে নাগরিকরা যে সব হেনস্তার সম্মুখীন হচ্ছেন – এই বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা, প্রতিবাদ ইত্যাদিকে তারা বাঙালি সম্প্রসারণবাদ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।

‘বাঙালি সম্প্রসারণবাদ’-এর মতো বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যাহীন এই শব্দবন্ধগুলো ব্যবহৃত হয় এই সত্যটাকে ঢেকে দিতে যে, আসামের বাঙালিরা অনেক আগে থেকেই প্রান্তিকায়িত অবস্থানে আছেন – ক্ষমতার ভাগাভাগিই বলুন আর সাদা কলারের চাকরির বাজারেই বলুন, বা আজকের নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পরিণতিতে ধর্ম জাতি ভাষা নিরপেক্ষভাবে সবার জন্য কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার পরিস্থিতি। এনআরসি প্রক্রিয়ার হয়রানিগুলোকে অনুধাবন করা যায় এই প্রক্রিয়া চলাকালীন আসামের বাংলাভাষী মানুষের আত্মহত্যাগুলোর সংখ্যা দেখলে।

বিরাট সংখ্যক প্রলেতারিয়েত ও সামাজিক নিরাপত্তাহীন শ্রমজীবী জণসাধারণের আধিক্য সচেতনভাবে না হলেও ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের শ্রমজীবীদের কাজের-স্পেসে একটি ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করে দেয়। এই বাস্তব ঐক্যের ক্ষেত্রটাই রূপান্তরিত হতে পারত একটা গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে। যে লড়াই হতে পারত দিল্লিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে, রাজ্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা উঠিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ইত্যাদি। অর্থাৎ সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটা গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ তৈরি হতে পারত। কিন্তু প্রভাবশালী ও লিবারেল অসমিয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এই সুযোগ হাতছাড়া করেছে, সাময়িকভাবে হলেও তারা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদকে তার হারানো জমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দিয়েছে। এনআরসি-কে ঘিরে সংসদীয় বাম-লিবারেলদের জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ উগ্রজাতীয়তাবাদী-সাম্প্রদায়িক জোটকে রাষ্ট্র ক্ষমতার মদতে নিয়ন্ত্রকের আসনে বসতে সহায়তা করেছে, যে রাষ্ট্র সমস্ত সামাজিক স্পেসকে দমনমূলক হাতিয়ারের মাধ্যমে ক্রমাগত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। তথাকথিত সুশীল সমাজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা আওড়ে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রামীণ আসামে যা আমরা লক্ষ্য করছি তা অনেকাংশেই মিলে যাবে মাইরন ওয়েইনারের ১৯৫৯ সালের পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের (Political Leadership in West Bengal : The Implications of Its Changing Patterns for Economic Planning / Myron Weiner/ EPW,July 1959) সাথে। আসামের গ্রাম বা শহরাঞ্চলে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠনগুলোর কোনো ভিত নেই। জনগণের উপর রাজনৈতিক হেজিমনি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্থা, আর্থিক ও মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা। কিন্তু নয়া অর্থনীতির চাপে পড়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর পথে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী জনগণের তাৎক্ষণিকভাবে দরকার তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, এবং এটাই সঠিক সময় শক্তভাবে শ্রমজীবী জনগণের গণতান্ত্রিক ও নাগরিকত্বের অধিকারের সপক্ষে দাঁড়িয়ে বামপন্থী পুনরুত্থানের।

মাঝে মাঝে দু পা এগোতে হলে এক পা পিছোতে হয়। মানুষ তার সমস্ত ক্রোধ ও বিরক্তি নিয়েও আতঙ্কগ্রস্ত ও নেতৃত্বহীনতায় ধুঁকছেন। রাষ্ট্রও তার পেশিশক্তি দেখিয়ে সাধারণ জনতাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে, বিশেষ করে কোণঠাসা সংখ্যালঘুদেরকে। বাম ও গণতন্ত্রীদের এখন এই দাবি সাহসিকতার সাথে উত্থাপন করা দরকার যে বাদ পড়া ৪০০৭৭০৭ জনের ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়ার একটি বৈধ নথি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আসাম চুক্তি ও ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে ১৯৯৭ সালের ভোটার তালিকাকে সংশোধন করে, ভোটারদের নথিপত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল।

নীরবতার বর্তমান এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে মূলত সংখ্যালঘু বলয়ে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি ও জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর দমিয়ে দেওয়ার সব রকম প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্যই। আসামের এই মাটিতে পৃথিবীর দুর্দশাগ্রস্তদের (wretched of the earth) মরণফাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে উগ্রজাতীয়তাবাদী শিবিরের আনন্দ-উল্লাস ও উৎসবের মেজাজ সভ্যতার সঙ্কটকে দেখায়। রাষ্ট্রের সশস্ত্র ক্ষমতার প্রদর্শনীর দ্বারা বিপন্ন মানুষের সম্মিলিত আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়া গণতন্ত্রের বিপদকে সূচিত করে।


আসামের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা নোটটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ফ্রন্টিয়ার উইকলি  পত্রিকায় । মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন শহিদুল হক। লেখক অরূপ বৈশ্য আসামের শিলচরের বাসিন্দা , নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে যুক্ত। মূল ইংরেজি লেখাটা পড়া যাবে এখান থেকে-  Lost opportunity to be regained

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.