Header Ads

সুন্দর বন লঞ্চে ইলিশ উৎসব ,বাঙালির জীবে জল

ইলিশের কথা বললেই আমার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেই আসামীর গল্পটা মনে পড়ে যায়।

বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন “বাছা, মরার আগে তোমার শেষ সাধ কী?”
সে বললে “হুজুর, ফাঁসি দেবার আগের দিন প্রাণভরে ইলিশ খেতে চাই আর আমার মৃতদেহের সৎকারের সময় সঙ্গে যেন খান দুইচার ইলিশও দিয়ে দেওয়া হয়”।
বিচারক অবাক। “মরার পরে ইলিশের কী দরকার?”
“আজ্ঞে স্বর্গের যা যা বর্ণনা আজ অবধি পড়েছি, তার কোনটাতেই ইলিশের কথা নেই। এমন সুস্বাদু মাছ ছাড়া কি আর স্বর্গসুখ পাবো? আর নেহাত যদি নরকেই যাই, তাহলে সেখানের কষ্ট ইলিশ ছাড়া আর কে  ভোলাবে বলুন দেখি?”

শেষ অবধি কি হয়েছিল জানি না, তবে ইলিশ নিয়ে বাঙালী যে পরিমান মরিয়া তাতে গল্পটা সত্যি হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ এমন মাছ যার নাম শুনলে মানুষ তো মানুষ, গাছ-ও নাকি হাঁ করে। রাতের বেলায় এই মাছ হাতে দুলিয়ে নিলে পিছন থেকে তেনারা খোনা গলায় “মাঁছ দেঁ, মাঁছ দেঁ” বলে বাড়ি অবধি তাড়িয়ে আনে বলে শুনেছি।

সরস্বতী পুজোতে তেল সিঁদুর দিয়ে জোড়া ইলিশ ঘরে তোলা হয়, খাওয়া হয় সেই দশমী পর্যন্ত। আসলে শ্রাবণ থেকে আশ্বিন ইলিশের ডিম পাড়ার সময়। তার পরের পাঁচ মাস ইলিশকে বড় হতে দেবার জন্যেই এই প্যাঁচ। সংস্কৃতে অবশ্য ইলিশ এসেছে ইল্লিশ নামে। বলা হয়েছে এই মাছ নাকি “স্নিগ্ধ রোচক, বলবর্ধক, পিত্ত ও কফকারী, লঘু পুষ্টিকর ও বাতনাশক”। শুধু তাই না, এই মাছ নাকি নির্দ্বিধায় নিরামিষভোজীরাও নিরামিষ ভেবে খেয়ে নিতে পারে “ইলিশো খলিশশ্চৈব ভেট্‌কির্মদ্‌গূর এবচ/ রোহিতো মৎস্যরাজেন্দ্রঃ পঞ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ”।

যদিও আসল শব্দখানা হল ইলীশ। ইল মানে জলের মধ্যে আর ঈশ মানে কর্তা বা রাজা। এই দুইয়ে মিলেমিশে ‘সর্বৈষামেব মৎস্যানাং ইল্লিশঃ শ্রেষ্ঠ উচ্চ্যতে।’ বাংলাদেশে একে বলে— ‘জামাই ভুলাইনা মাছ/ ছাওয়াল কাদাইনা মাছ।’ এই মাছ পাতে দিলে জামাই ছেড়ে যেতে চায় না। না দিলে সন্তান কেঁদে ভাষায়। ইলিশের আঁশ ঘরে পোঁতা থাকলে নাকি গৃহস্থের মঙ্গল হয়। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে কলা দিয়ে ইলিশ মাছ রান্নার অদ্ভুত রেসিপি রয়েছে।

আনিয়ে ইলিশ মৎস
করিল ফালাফালা
তাহা দিয়ে রান্ধে ব্যাঞ্জন
দক্ষিণ সাগর কলা।

আসলে ইলিশ মানেই ভরপুর নস্টালজিয়া। ইলিশ নিয়ে বাঙালির বাড়াবাড়ি চিরকাল ছিল, আজও আছে। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন-

রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে 
জলের উজ্জ্বল শ‍স‍্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এল বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।

এখানে একটু বিস্তারিত বলি। স্বাধীনতার আগে চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দে স্টিমার চলত সারারাত ধরে। দোতলা স্টিমার। তার নিচতলায় মুসলমান রাঁধুনিরা রাঁধতেন ইলিশের ঝোল আর মুরগির লাল গরগরে কারি। স্টিমার কারি। মাছের দাম ছ-আনা। ভাত যত খুশি। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছাত সেই পদ্মার ইলিশ। অবশ্য সারা বছর ইলিশ পাওয়া যেত দামুকদরিয়া ঘাটেও। একসময় এই ঘাটেই দার্জিলিং মেলের ব্রডগেজ যাত্রা হত শেষ। এবার স্টিমারে চেপে পদ্মা নদী পেরিয়ে ওপারে সাঁড়াঘাট। ওপারেও এক দার্জিলিং মেল অপেক্ষা করছে। তবে সে ট্রেন মিটার গেজের। পদ্মার দুপারে দরমার বেড়ার হোটেল। ভেসে আসত ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ। অন্যদিকে হয়ত রান্না হচ্ছে দেশি মুরগির কারি। সব মালপত্র লাগেজবাবুর কাছে রেখে যাত্রীরা খেয়ে নিত গরম সাদা ভাতের সঙ্গে কালোজিরে ভাসতে থাকা ইলিশ মাছের ঝোল। সঙ্গে ফিনফিনে করে কাটা দু-একটুকরো আলু। পাশে মিষ্টি কুমড়োর সরু খণ্ড আর কাঁঠালের বীজ ভাজা। যাতে যাত্রীরা বেশি না খেয়ে ফেলে, তাই সুচতুর দোকানদার খাবার মাঝেই হেঁকে উঠত “স্টিমারে হুইচেল দিছে কত্তা। হক্কলে ছুটেন”। যারা আনাড়ি, আধপেটা খেয়েই তড়িঘড়ি দৌড়াত। যারা ঘোড়েল, তারা নির্বিকার মুখে আরও একবার ভাত ঘুরিয়ে দিতে বলতেন। পাতে যতক্ষণ মাছ আছে, ভাত ফ্রি।

“বর্ষার মাঝামাঝি।
পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।…শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।
কুবের মাঝি আজ ধরিতেছিল…’ (পদ্মা নদীর মাঝি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)

ইলিশের মরশুমে মাছ শিকারিরা ভেসে চলে ছান্দি জাল নিয়ে। এই জাল নিয়ে বেরোলে নাকি জল নিরাশ করে না। জেলেরা তাই গান গায় “ছান্দি আমার বান্দি, খড়কা আমার ভাই/ খড়কি জালের পয়সা দিয়া দুধভাত খাই”। মাছের সাইজ অনুযায়ী ইলিশ চার রকম। একেবারে ছোট হল “উবলি”। তারপর একে একে জাইতকা, খোকা ইলিশ আর প্রমাণ মাপের ইলিশ। সমুদ্রে মাছ ধরতে নৌকোতে আর চলে না। ট্রলার লাগে। ধুপ ধুনো দিয়ে শুদ্ধাচারে পুজো করে, গলুইতে মিষ্টি, বাতাসা দিয়ে তারপর জাল তোলা হয়। জেলে ওঠেন হাত-পা ধুয়ে। পরিষ্কার কাপড়ে। দশ-বারো দিনের মত জলে ভাসার আয়োজন। তাতে মাছ শিকারী থাকে সাত আটজন। লাগে অভিজ্ঞ চোখ। জলের রঙ, স্রোতের টান, মাছের গতিবিধি দেখে, জোয়ার ভাঁটা তিথি নক্ষত্র মেনে জাল ফেলা হয়। জলেরই কত নাম। দধি জল, চোখা জল, কাঁচখোলা জল। মাছের গায়ের ঘষা লেগে জল ঘোলা হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি হয় চতুর্দশী থেকে ষষ্ঠী তিথিতে। সেই ধূসর বা লালচে জলে বেশি মাছ ধরা পরে। ভাগ্যভাল থাকলে এক এক জালে পঞ্চাশ মন অবধি মাছ ওঠে। মাছ তোলার আলাদা আলাদা সব নাম। জোয়ারের শুরুতে ফেলা জালের নাম “সার” বা “আওলা”, ভাঁটায় সেটাই বদলে হয়ে যায় “পূরণী”। ভাঁটার শেষ টানের নাম “খেউ”। ভাঁটার খেউ শেষ হয়ে গেলেই মুশকিল। সেদিন আর মাছ ধরা পড়বে না জালে।
স্বাদে সোয়াদে কে বেশি ভাল? গঙ্গার ইলিশ না পদ্মার ইলশা, এই নিয়ে ঝগড়া চলছে চলবে। কমলকুমার মজুমদার তো বলেই দিয়েছিলেন “গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে কোম্পানীর তেল খেয়েছে। এর সঙ্গে অন্য ইলিশ পাল্লা দেবে কী করে!” অন্যদিকে বুদ্ধদেব গুহ নাকি পদ্মার “ইমপোর্টেড” ইলিশ খেয়ে কলমই ধরতে পারছিলেন না, এত তেল। সে তেল নাকি প্রায় হাতা দিয়ে ফেলে দেবার মত। তবে বাজারে গিয়ে গঙ্গা-পদ্মা চেনার একটা সহজ উপায় আছে। খুব নজর করে দেখলে গঙ্গার ইলিশের গায়ে হালকা সোনালী আভা আর পদ্মার ইলিশে গোলাপী আভা দেখা যায়। ইলিশ যদি পুরুষ হয়, তবে তা খেতে সুস্বাদু। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। মেয়েদের তুলনায় এরা স্লিম, লম্বা আর সুঠাম। বাই চান্স বাজারে পেয়ে গেলে ছাড়বেন না। এককালে ইলিশ মাছের আড়তে মাছ কাটার জন্য এক্সপার্ট লোক পাওয়া যেত। এদের নাম “কপালি” বা “কাটারু”। মাছ কতদিনের জন্য রাখতে হবে আর কতদূর যাবে বললেই এরা সুন্দর করে কেটে প্যাক করে দেবে। অল্প কিছুদিনের জন্য হলে মাটির হাঁড়িতে। সময় বাড়লে বাড়তে থাকবে নুন আর হলুদের পরিমান। কোল পেটি আলাদা কাটলে ঝুড়াকাটা। একসঙ্গে রাখলে পুস্তাকাটা। আর গোটা ইলিশের গায়ে দাগ দাগ করে কাটার নাম আইলচা কাটা। লবনে জারানো সেই নোনা ইলিশ বরফ ছাড়াই চলবে ছয় মাস।  মাঝে মাঝে শুধু নোনা জলটা ফেলে দিতে হবে।

বাংলায় ইলিশের নানা পদ। সব পদের নাম বলতে গেলে আলাদা একটা লেখা লিখতে হবে। তবে এটুকু জানিয়ে যাই, সাহেবদের জন্য কাঁটা ছাড়িয়ে স্মোকড হিলসা বা ধূমপক্ক ইলিশ প্রথমবার রাঁধেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। বাংলাদেশে ইলিশের এক অদ্ভুত পদ আছে। ইলিশের হাংরাস। পদ্মা নদীতে যারা মাছ ধরে তাদের মধ্যেই এই পদটির চল।  ইলিশ মাছের আঁশ ছাড়িয়ে হলুদ নুন মাখিয়ে একটি পাতার মধ্যে টুকরো মাছগুলো রেখে নদীর চরের বালি একটু গর্ত করে তাতে রেখে বালি চাপা দিয়ে দেয়। রোদের তাপে বালি উত্তপ্ত হয়ে পদটি তৈরি হয়ে যায়। মাছটি কাটা হয় কিন্তু ধারালো বাঁশের পাতা দিয়ে।

শেষ ভোজনে ইলিশ খেয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন এমন দুজনের কথা জানি। এক তো মহম্মদ বিন তুঘলক। দ্বিতীয় আমাদের ঘরের ছেলে স্বামী বিবেকানন্দ। ইলিশ নিয়ে চিরকাল তিনি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। ১৯০১ -এর ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসে গঙ্গার দিকে চোখ রেখে তিনি এক চিঠিতে ক্রিস্টেনকে লেখেন “পৃথিবীতে এমন জিনিসটি হয় না। নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি - ঘরের গায়ে ঢেউ ধাক্কা খেয়ে উছলে উঠছে। নিচে শত শত মাছ ধরার নৌকো। সবাই ধরায় ব্যস্ত। আমাদের ইলিশ তোমাদের আমেরিকান ইলিশের চেয়ে বহুগুণে উৎকৃষ্ট”।

ইলিশ নিয়ে অনেক গল্প হল। সুযোগ পেলে বারান্তরে আরো কথা বলা যাবে। তবে শেষটা করি রজরাজ অমৃতলালের লেখা দুরন্ত এক নকশা দিয়ে। ইলিশ নিয়ে আলটিমেট কথা হয়তো তিনিই বলে গেছেন-

গরম গরম ভাজা খিচুড়ির সঙ্গে।
বর্ষাকালে হর্ষে গালে তোলে লোকে বঙ্গে ।।
কাঁচা ইলিশের ঝোল কাঁচা লঙ্কা চিরে।
ভুলিবে না খেয়েছে যে বসে পদ্মাতীরে।।
ভাজিলে ঝালের ঝোলে ইলিশ অসার।
কাঁচাতে অরুচি, রুচি মাখনের তার।।
সর্ষে বাটা দিয়ে তাতে মাখাইয়া দধি।
আমিরি আহার হবে রেঁধে খাও যদি ।।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.