Header Ads

ছোট্ট বেলার মধুর স্মৃতি রথের রশি টানা র সঙ্গে আগমনী বার্তার সুর একাকার

স্মৃতিকথা :  সঞ্জয় মিশ্র ,কান্দি জেল রোড 
         আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের পাড়াকে চুনুরী পাড়া বলা হতো কারন সেই সময় আমাদের পাড়ায় অনেকের বাড়িতে ঘটিং পুড়িয়ে চুন তৈরী করা হতো । যাঁরা এই কাজে যুক্ত থাকতেন তাঁদের চুনারী বলা হতো । কিন্তু কালের নিয়মে ঐ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চুনারী রা চৌধুরী পদবী লিখতে শুরু করলো তাই পরবর্তী তে আমাদের পাড়ার নাম ও বদলে গেল । কান্দি মহকুমার একমাত্র জেলখানা টি আমাদের পাড়ায় অবস্থিত হওয়ায় সবাই আমাদের পাড়া কে জেল রোড বলা শুরু করলো । সেই থেকে আমাদের পাড়ার দুর্গা মন্দিরের পূজো কমিটির নাম ও হয়ে গেল জেল রোড সার্বজনীন দূর্গা পূজা কমিটি । কিন্তু ঠাকুর্দা দের  তৈরী করে যাওয়া এই পূজোর বয়স হবে এবছরে ৯৭ বছর । 
         রথযাত্রা এলেই ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায় । পাড়ার বন্ধু - বান্ধব,বাড়ির ভাই-বোনেরা মিলে সকাল থেকে রঙিন কাগজ , বাঁশের টুকরো,আটা, দড়ি জোগাড় করে রথ তৈরী করতে লাগলাম । বিকেলে সেই রথের মধ্যে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ছবি রেখে মালা দিয়ে রথ টেনে নিয়ে এপাড়া - ওপাড়া ঘুরে বেড়াতাম । অনেকে আগ্রহ সহকারে এগিয়ে এসে আমাদের বানানো রথের রশি তে টান লাগাতো, ভক্তি সহকারে প্রণাম করে কিছু পয়সাও দিত । হোক না সে খেলনা রথ , কিন্তু ঐ রথে তো জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মতো দেব-দেবী রা আছেন । রথযাত্রার দিন রথের দড়িতে টান দিয়ে রথ টানা যে পূণ্যের কাজ , তাই পুরীধামে না গিয়েও ঘরের কাছের রথের রশি তে টান দিয়ে সেই পূণ্যার্জণ করার জন্যই বোধহয় সবাই এগিয়ে আসতো । সন্ধ্যা হয়ে গেলে রথ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম ।‌ নগদে পাওয়া পয়সা গুলো সবাই মিলে অত্যুৎসহকারে গোনা গুণতি করে রেখে দিতাম উল্টো রথের দিন আবার উল্টো পথে বের হয়ে আরোও কিছু পাওয়ার আশায় তারপর ঐ পয়সা গুলো দিয়ে কখনো একসঙ্গে খিঁচুড়ি, তরকারি বানিয়ে একসাথে খাওয়া দাওয়া করতাম আবার কখনো বা খেলার সরঞ্জাম কিনতাম। এই ভাবেই সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নিতাম । এখন ক্যারিয়ার সর্বস্ব যুগ ,এসব এখন কল্পনাতীত।
          এই রথ আসা মানেই পূজোর বাজনা বেজে যাওয়া। রথের দিন দুর্গা ঠাকুরের আটনে বা দুর্গা প্রতিমার শরীরে মাটি লাগিয়ে দেওয়া একটা রীতির মধ্যে পড়লেও আমাদের পাড়ায় সেসব চল ছিল‌ না । তবে আমরা বড়দের কাছ থেকে খবর নিয়ে রাখতাম আমাদের পাড়ার ঠাকুর এবার কে করবে । যখন ই শিল্পীর নাম জেনে যেতাম তখন থেকেই শিল্পীর বাড়ি আনাগোনা শুরু হয়ে যেত আমাদের । পূজো শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত  যেদিন যখন সময় পেতাম এবং যাদের কে সঙ্গে পেতাম তাদের কে সঙ্গে নিয়েই শিল্পীর বাড়ি চলে যেতাম। ফিরে এসে বাড়িতে বা পাড়ার বড়দের ঠাকুর বানানোর অগ্রগতির রিপোর্ট দিতাম । আজ খড় বেঁধেছে, আজ মাটি দিয়েছে, আজ দো মাটি দিয়েছে, আজ গঙ্গা মাটি দিয়েছে, আজ খড়ি মাটি দিয়েছে, আজ রং দেওয়া শুরু করেছে শেষে কাপড় পড়ানো আর চোখ আঁকা। এইসব খবর আর কী !! ছুটির দিন সকালের পড়াশোনা শেষ করে ঘরে কিছু খেয়ে নিয়ে শিল্পীর বাড়ি হাঁ করে বসে থাকতাম আর ঐ সব কাজ দেখতাম। 
       তখন পাড়ায় স্থায়ী মন্দির ছিল‌ না বলে আমাদের কষ্ট করে অন্য পাড়ায় শিল্পীর বাড়ি গিয়ে প্রতিমা বানানো দেখে আসতে হতো । এখন পাড়ায় স্থায়ী মন্দির তৈরী হয়েছে তাই মন্দিরের মধ্যে ই প্রতিমা তৈরী হয় । শিল্পী রথের দিনেই খড় দিয়ে কাঠামো বানানো প্রতিমার গায়ে মৃত্তিকা লেপন করে দেন । 
          চাকরি করার জন্য দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে, বাইরে থাকায় রথের দিন মাটি লাগানোর কাজ দেখতে পেতাম না । এখন অবসর প্রাপ্ত, বিভিন্ন জেলা ঘুরে এখন নিজের বাড়িতে ই থাকা শুরু করেছি । তাই ছোটো বেলার স্মৃতি ফিরে পেতে রথযাত্রার দিন দুর্গা মন্দিরে গিয়ে প্রতিমার গায়ে মাটি লাগানোর কাজ স্বচক্ষে দেখে এলাম। দেখলাম আমাদের ছোটো বেলার মতো পাড়ার  ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা এখনো সেই রেওয়াজ বজায় রেখেছে ।প্রায় শতবর্ষের কান্দি জেল রোড সর্বজনীন দুর্গা পুজোকে ঘিরে  উৎসাহ উন্মাদনার  সুর বেজে উঠে।   

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.