গাছে বাবাকে বেঁধে অত্যাচার করা হয়েছিল : তাস লিমা নাসরিন
১৯৬৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই বাড়িতে বাস করেছি আমি। আমার শৈশব কৈশোর আর তারুণ্য কেটেছে এই বাড়িতে। এই বাড়িতে থেকে আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে এম বি বি এস ডিগ্রি লাভ করেছি। এই বাড়িতে থেকেই আমি শহরের দু'তিন স্থানে ডাক্তার হিসেবে সরকারি চাকরি করেছি। এখানেই আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, যেসব কবিতা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হতো, সেঁজুতি নামের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেছি কয়েক বছর, এই বাড়িতে থাকেই। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন সাহিত্য সংস্কৃতির সংগঠন শতাব্দী চক্র গড়েছি। এই বাড়িতে থেকেই আমি আমার প্রথম এবং দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো লিখেছি। এই বাড়িতে থেকেই আমি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এবং পত্রিকায় কলাম লিখেছি, যে কলামগুলো নির্বাচিত কলাম নামের বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই বাড়িতে আমি 'সকাল কবিতা পরিষদ' নামে একটি আবৃত্তি শিল্পীদের সংগঠন শুরু করেছি। বৃন্দ আবৃত্তি করেছি বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে। মাত্র ২০ বছর বাস করেছি এই বাড়িতে। অথচ কত কিছুই না করেছি।
সুন্দর স্মৃতিময় বাড়িটি এখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখানে নাকি বহুতল বাসভবন বানানো হবে। আমি আজ ৩০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছি। এই সুযোগে আমার বাবার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী এক আমাকেই সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়েছে পরিবার থেকে। আজও এই বয়সে স্ট্রাগল করছি, পায়ের তলায় মাটি নেই।
বাড়িটির কথা আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়ায় আছে। কালো ফটকের কথা অনেক লিখেছি, ফটকের দুই পাশের দুটো থামের একটি দেখা যাচ্ছে, এতে শ্বেত পাথরের গায়ে লেখা, ডাঃ এম আর আলী, এম বি বি এস। বাঁ দিকের থামে শ্বেত পাথরে লেখা ছিল বাড়িটির নাম, অবকাশ। ভাঙতে ভাঙতে বাড়িটি পেছনের দিকে যাচ্ছে। ছাদের রেলিং দেখা যাচ্ছে, বাকিটা ভেঙ্গে ফেললে ইতিহাস মুছে যাবে, স্মৃতি তলিয়ে যাবে।
বাড়ির কালো ফটকের পাশের একটি নারকেল গাছে পাকিস্তানি আর্মিরা ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বা ডিসেম্বর মাসের শুরুতে আমার বাবাকে বেঁধে মেরে *ছিল, বাড়ির ভেতর থেকে স্বর্ণালঙ্কার আর টাকাকড়ি লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। ফটকের পাশে পড়ে ছিল আমার বাবার অর্ধমৃ *ত শরীর। আমাদের ভাঙা বাড়ির এই ছবিটি অচেনা একজন আমাকে ফেসবুকের কমেন্টে পাঠিয়েছে। ছবিতে দেখতে পাচ্ছি একটি কাটা নারকেল গাছ পড়ে আছে। হয়তো এটিই সেই নারকেল গাছ, যে গাছে আমার বাবাকে বেঁধেছিল পাকিস্তানি আর্মি। - তসলিমা নাসরিন
কোন মন্তব্য নেই