Header Ads

উপাচার্য নিয়োগ সমঝোতার গন্ধ

উপাচার্য নিয়োগ- নাট্যে সমঝোতার গন্ধ

দেবদূত ঘোষঠাকুর 


'কা কস্য পরিবেদনা' কথাটি একটি সংস্কৃত শ্লোক থেকে এসেছে। শ্লোকটি হল:
'এক বৃক্ষসমারূঢ়া নানাপক্ষিবিহঙ্গমাঃ।
প্রভাতে তু দিশো যান্তি  কা কস্য পরিবেদনা।।'
এর সোজাসাপটা বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় - একটি গাছে রাতে বহু ধরনের পাখি এসে সমবেত হয়। সকাল হলেই যে যার নিজের মতো উড়ে যায়। একে অন্যের খোঁজ পর্যন্ত রাখেনা। 
তখন আমরা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের সংস্কৃত শিক্ষক বোর্ডে আমাদের ওই বাগ্‌বিধিটি লিখতে দিয়েছিলেন। প্রথম কয়েকজন 'কাকস্য পরিবেদনা' লেখায় উনি আমাদের রণ ভঙ্গ দিতে বলে নিজেই গোটা গোটা করে বোর্ডে লিখলেন 'কা কস্য পরিবেদনা'। বললেন, 'এর সঙ্গে কাক-য়ের‌ কোনও সম্পর্ক নেই কিন্তু।' তারপরে বললেন, ‘কা’ মানে কে? ‘কস্য’  হল কার ? এবং ‘পরিবেদনা’ বলতে তীব্র কষ্ট, বেদনা, অন্তর্দহনকে বোঝায়। 
এই বাগ্‌বিধিটির আলংকারিক অর্থ— সংসারে  কে কার বেদনার খবর রাখে কিংবা কারও কষ্ট যতই তীব্র হোক না তাতে অন্য কারও তেমন কিছু যায় আসে না। মোদ্দা কথাটা হল- চারপাশে বন্ধুবান্ধব থাকলেও আদতে নিজের কষ্টের কথা বলার বা শোনার কেউ নেই। 
রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শতকরা একশ ভাগের ক্ষেত্রে এই বাগ্‌বিধিটি শতকরা ১০০ ভাগ সত্যি। দীর্ঘদিন স্থায়ী উপাচার্য না থাকলে পঠনপাঠনের দুরাবস্থা যে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় তা সেখানকার শিক্ষক, আধিকারিক ও ছাত্রছাত্রীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কিন্তু এই 'দুরাবস্থা' কাটাতে যাঁরা বন্ধু কিংবা অভিভাবক হিসেবে আশেপাশে রয়েছেন, সেই রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতর, রাজভবন কিংবা সুপ্রিম কোর্টের তাতে কোনও হেলদোল আছে বলে কিন্তু মনে হচ্ছেনা। অর্থাৎ স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগে এই টালবাহানায় যাঁরা সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের মর্মবেদনা তিন 'অভিভাবক'-কে স্পর্শ করেছে কী না তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় রয়েছে।  রাজ্যপাল, সুপ্রিম কোর্ট তো বটেই, এই 'উপাচার্ম সমস্যা' মেটাতে রাজ্য সরকারও কতটা যে উৎসাহী, ৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের ভূমিকার পরে সেই ব্যাপারে প্রশ্ন  উঠতে শুরু করেছে। শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে রাজ্য সরকার খুব বড় অঙ্কের টাকা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য খরচ করবে কী না তা নিয়ে আমলাদের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ অতি দ্রুত হয়ে গেলে রাজ্য সরকারের উপরে চাপ বাড়বে। যে ৩৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য দেওয়া হবে তার অন্তত ১০-১২ টি তে কোনও স্থায়ী শিক্ষক নেই। 'অতিথি' শিক্ষক দিয়ে ঠেকনা দেওয়া হচ্ছে। বিভাগীয় প্রধান বলে কেউ নেই। 
পাশাপাশি ক্লাস রুম নেই, ছাত্রছাত্রীদের কমন রুম, ক্যান্টিন নেই। কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানা ভাবে কিছু বিষয়ের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে ১৫ কিলোমিটার দূরের কোনও কলেজে। সেই সমস্যার সমাধান কবে হবে সেই সব হাজার প্রশ্নের সমাধানের প্রথম ধাপ হল স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ। যে ১০-১২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো অত্যাধিক ঢিলেঢালা, তাদের অনেকেরই স্থায়ী রেজিস্ট্রার বা ফিনান্স অফিসার নেই। স্থায়ী রেজিস্ট্রার এবং ফিনান্স অফিসারের আশা ত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কেউ কেউ কনট্রাকচুয়্যাল পদে ওই দুই আধিকারিক পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কিন্তু কনট্রাকচুয়্যাল রেজিস্ট্রার কর্ম সমিতির বৈঠক ডাকতে পারবেন কী না উঠেছে সেই প্রশ্নও। কারণ, বিধি অনুযায়ী রেজিস্ট্রার কর্মসমিতির সদস্য সচিব ও আহ্বায়ক। অর্থাৎ ঘুরেফিরে নতুন সমস্যার জালেই জড়িয়ে পড়তে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। 
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আধিকারিকেরা বলছেন, কলকাতা, যাদবপুর কিংবা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে টাকাপয়সার জন্য কর্তৃপক্ষকে তেমন চিন্তা করতে হয় না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে নবান্ন বা বিকাশ ভবন থেকে অর্থ মঞ্জুর করাতে তদ্বির করতে হয়। বার বার যেতে হয় উপাচার্যদের।  কারণ উপাচার্য ছাড়া আর কোনও প্রশাসনিক কর্তা সেখানে নেই।  স্থায়ী উপাচার্য ছাড়া ওই সব  বিশ্ববিদ্যালয় যে অভিভাবক হীন সেটা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন  রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতরের এক অবসরপ্রাপ্ত আমলা।  তাঁর অভিজ্ঞতা, যাদবপুর, কলকাতা, উত্তরবঙ্গের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সমস্যা তেমন নেই। ওদের সব জায়গায় ঠিক ঠিক লোক এবং ঠিক ঠিক পরিকাঠামো রয়েছে। একমাত্র শিক্ষক নিয়োগ কিংবা বড় আর্থিক পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। তবে খুবই 'খারাপ'অবস্থায় রয়েছে তৃণমূলের আমলে তৈরি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। তড়িঘড়ি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে গিয়ে স্থায়ী শিক্ষক, স্থায়ী কর্মীও নিয়োগের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তার ফল এখন ভুগছে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে কলকাতা, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, কল্যাণী কিংবা উত্তরবঙ্গের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও যে খুব ভালো অবস্থানে আছে তা-ও নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ অধ্যাপক বলছেন, 'গত কয়েক বছরের মধ্যে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মী অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের শূন্যপদ পূরণ হয়নি। ওই অধ্যাপক বলেন, 'আমাদের বিভাগ কিংবা পাশাপাশি অনেক বিভাগেই কর্মরত শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের গড় বয়স ৬০-৬২। বহুদিন নিয়োগ না হওয়াতেই সমস্যা এখন পাহাড়প্রমাণ।' ওই অধ্যাপকের এক সহকর্মীর আশঙ্কা, 'অবসরের আগে  আমাদের এখানেও অতিথি শিক্ষক দেখে যাবো কী না সেই দুঃস্বপ্ন কিন্তু হামেশাই দেখছি।' 
এক শিক্ষাবিদের মতে, এই সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র রাজ্য সরকারই। তিনি বলেন, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের পাশাপাশি স্থায়ী রেজিস্ট্রার, ফিনান্স অফিসার, স্থায়ী ডিন, ন্যূনতম সংখ্যায় স্থায়ী শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করতেই হবে। তার জন্য যে বিপুল টাকা দরকার তা বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছর রাজ্য সরকার ব্যয় করবে কী না তার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এক পোড় খাওয়া শিক্ষক নেতা বলেছেন, 'সাধারন রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে বলছি, রাজ্য সরকার এখন বেশি জোর দেবে লক্ষ্মীর ভান্ডার, রূপশ্রী, কন্যাশ্রী বা বিভিন্ন ভাতার অঙ্গ বাড়ানোর দিকে। কারণ , কী করলে নিজেদের ঝুলিতে আরও বেশি ভোট আসবে তা শাসক দলের জানা। আর অবিলম্বে স্থায়ী পদের আশায় বিকাশ ভবনে ঘুরপাক খাওয়া নতুন উপাচার্যদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে এই ইঙ্গিতও পেয়েছেন। 
শিক্ষাবিদদের অন্য একটি অংশ আবার এর পিছনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় 'লবি'-র  হাত'-ও দেখতে পাচ্ছেন। ওই অংশটি বলছেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যতো সমস্যা তৈরি হবে তাদের স্থায়ীত্ব নষ্ট হবে, মান কমবে পড়াশোনারও। যে সব ছাত্রছাত্রী আর্থিকয়ভাবে দুর্বল, তাদেরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই ভিড় জমাতে হবে। বিকাশ ভবন অবশ্য এই সব সন্দেহকে কোনও আমল দিচ্ছে না। কিন্তু এত দেরির জন্য আগের মতো রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েও তেমন সরব নয়। রাজভবন ও বিকাশ ভবন দু'পক্ষই মধ্যপন্থা অর্থাৎ আপোসের রাস্তা নিয়েছে। ৮ জানুয়ারি ফের রাজ্যপালকে তিন সপ্তাহ আরও সময় দেওয়ায় বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের আইনজীবী কে তেমন সরব হতে দেখা যায়নি। অনেকের কাছে এটা একধরনের 'সমঝোতা বলেও মনে হয়েছে। তাই বোধহয় স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে 'সবপক্ষের' মধ্যে সমঝোতার গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই।  তাঁরা মনে করছেন, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগে এই'ধীরে চলো' অবস্থান সেই জন্যই ।  বিষয়টি শিক্ষাবিদদের ভাবাচ্ছে কিন্তু!
 উত্তরবঙ্গ সংবাদ ২১/০১/২০২৪

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.