Header Ads

আর কবে? কলকাতা বিচার পেল না

আর কবে, এখানেও তো বিচার চাই

দেবদূত ঘোষঠাকুর

অরিজিৎ সিংহের সাম্প্রতিক একটি গানের প্রথম লাইনটি রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখন বেশ জনপ্রিয়।
 'আর কবে, আর কবে, আর কবে?' 
ওই গানের প্রেক্ষিতটি ভিন্ন হলেও, এই প্রশ্নটি কিন্তু সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির  ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। 
প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল রাজ্যের ৩৬ টি সরকারি  বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও স্থায়ী উপাচার্য নেই। সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত সার্চ কমিটি আবেদনপত্র ঝাড়াইবাছাই করে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেছিল দুর্গা পুজোর পরে পরেই। শুরু হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে দিয়ে। রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দপ্তর সূত্রের খবর, শুক্রবারই শেষ হয়েছে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে।  
এবার কত দিনে নিয়োগ হবে স্থায়ী উপাচার্যদের? 
ইন্টারভিউয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি  প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনজনের নামের প্যানেল তৈরি করে পাঠাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর ওই প্যানেল থেকে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবেন। সেই পছন্দসই প্রার্থীকে কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিয়োগপত্র দেওয়া যাবে না। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের নাম সহ  সেই তালিকা যাবে আচার্য রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যপাল নিয়োগপত্র দেবেন। নতুন করে কোনও আইনি জটিলতা তৈরি না হলে চলতি মাসের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুতেই স্থায়ী উপাচার্য পেয়ে যাওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির।
সত্যিই কি এত তাড়াতাড়ি এই সমস্যা মিটে যাবে? রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতরের মতে এত সবের পরেও ফের আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। 
  উপাচার্য পদ নিয়ে রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ মিলে গেল তো ভালো। আর না মিললে? ফের সুপ্রিম কোর্টে যাবে বিষয়টি। তাই খুব সহজেই যে উপাচার্য নিয়োগ সমস্যার সমাধান হবে তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালান, তাঁদের কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কারণ, অস্থায়ী উপাচার্যদের 'উপাচার্যের সব কাজ' করতে দিচ্ছেনা রাজ্য সরকার। পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছে। পঠনপাঠন, প্রশাসন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
এই সমস্যা অনুধাবন করেই কিন্তু রাজ্য সরকার অস্থায়ী উপাচার্যদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছিল । তারা বলেছিল, অস্থায়ী উপাচার্যের মেয়াদ ছয় মাসের জন্য হতে পারে। এর বেশি দিন তাঁরা কাজ  চালাতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অচলাবস্থার দায় কোনও মতেই রাজ্য সরকারের উপরে বর্তাবে না। কারণ, রাজ্য সরকার আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবে না।  
  সুপ্রিম কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিল, ‘আমরাও চাই না অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্যরা দীর্ঘদিন থাকুন। যত দিন না স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছে ততদিন এই অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা চলতে পারে।’ কিন্তু খতদীন এটা চলতে পারে সে ব্যাপারে কারো কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট বার বার বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা চায় সরকার ও রাজ্যপাল - দুই পক্ষের আলোচনা এবং সহমতের ভিত্তিতেই উপাচার্য নিয়োগ হোক। কিন্তু রাজভবন আর নবান্নের যে সম্পর্ক তাতে  সুপ্রিম কোর্টের এই আশা বাস্তবায়িত হবে কী না তার নিয়ে শিক্ষা মহলে ঘোরতর সন্দেহ ছিল।
তাই আওয়াজ উঠেছে, 'আর কবে?'
আর উঠবেই না কেন? 
উপাচার্যেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময় কর্তা। বিশেষ করে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় পঠনপাঠনের নিয়ন্ত্রক তিনি। শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণার রূপরেখা তৈরি, ছাত্রছাত্রীদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে চাকরি বা গবেষণার জন্য তৈরি করা হচ্ছে কী না, শিক্ষকেরা ঠিকমতো ক্লাস নিচ্ছেন কী না, গবেষণার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে কী না তার তত্ত্বাবধায়ক উপাচার্য নিজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক এবং নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম সমিতি (কারও কারও ক্ষেত্রে সিনেট-সিন্ডিকেট)। কর্ম সমিতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা উপাচার্যদের রয়েছে। কিন্তু তির আগে কর্মসমিতির বৈঠক হওয়ার বাধ্যতামূলক। বলছে বিকাল ভবন। 
দেড় বছর ধরে ওই ৩৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ওই কর্মসমিতির বৈঠক ডাকতে পারেনি (কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে)। কারণ, অস্থায়ী উপাচার্যের কর্মসমিতির বৈঠক ডাকার এক্তিয়ার নাকি নেই। তাই বিকাশ ভবন অনুমতি দেয়নি। 
 যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও স্থায়ী শিক্ষক নেই, স্থায়ী রেজিস্ট্রার কিংবা স্থায়ী পরীক্ষা নিয়ামক এবং স্থায়ী ফিনান্স অফিসার নেই- তাদের ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে ডিগ্রি পাচ্ছেন সেটাই একটা ম্যাজিক। শিক্ষা দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছেন না। তাঁরা কোনওমতে ডিগ্রিটা পেয়ে 'মুক্ত' হতে চাইছেন। তৃণমূলের আমলে গাদা গাদা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে বটে, তার অনেকগুলি তেই নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী।  দক্ষিণবঙ্গের এক অনুন্নত এলাকার  নতুন এক বিশ্ববিদ্যালয়  রয়েছে যেখানে নেই একজনও স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। 'অতিথি শিক্ষক'-রাই ভরসা। স্থায়ী কর্মীও নেই একজন। সবাই 'ঠিকা' কর্মী। তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এক কর্মীর কথায়, 'শেষ যে স্থায়ী উপাচার্য ছিলেন, তাঁর আমলে স্থায়ীকরণের একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। গত দেড় বছর ধরে সব বন্ধ। ভাড়া করা শিক্ষক, ভাড়া করা শিক্ষাকর্মী। তবুও যে এখানে ছাত্র ভর্তি হচ্ছে সেটাই আশ্চর্যের। ' শুধু তাই নয়, পরিকাঠামোগত কাজকর্মও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। 'অনুন্নত' এলাকার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে দেখা যাবে অর্ধসমাপ্ত বাড়ি। কাঠামো অর্ধসমাপ্ত রেখেই নির্মাণ সংস্থা চলে গিয়েছে। অর্ধসমাপ্ত পরিকিঠার এপাশ ওপাশ থেকে বেরিয়ে থাকা লোহার রডের মরচে ধরে গিয়েছে। 
দক্ষিণবঙ্গ থেকে  উত্তরবঙ্গের দিকে নজর ঘোরালে দেখা যাবে সেখানে পরিস্থিতি আরও নড়বড়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দার্জিলিং হিল বিশ্ববিদ্যালয়ে  বর্তমানে উপাচার্যের চেয়ার ফাঁকা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে আধিকারিকদের। প্রতিদিনই নানা প্রাশসনিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। থমকে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বহু কাজ। গবেষণা থেকে নিয়োগ সবক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। 
দুই অধ্যাপককে রেজিস্ট্রার এবং ফিন্যান্স অফিসারের বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে কোনওরকমে চালানো হচ্ছে দার্জিলিং হিল বিশ্ববিদ্যালয়। ভারপ্রাপ্ত দুই আধিকারিক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনও কর্মী বা আধিকারিক নেই। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। বছরের পর বছর ধরে ফাঁকা পড়ে রয়েছে স্থায়ী রেজিস্ট্রারের চেয়ার। নেই ফিন্যান্স অফিসার, কলেজ পরিদর্শক। এই পরিস্থিতিতে দুই স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আধিকারিকেরা বলছেন, কলাপাতা, যাদবপুর কিংবা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে টাকাপয়সার জন্য কতৃপক্ষকে চিন্তা করতে হয় না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে নবান্ন বা বিকাশ ভবন থেকে অর্থ মঞ্জুর করাতে তদ্বির করতে হয়। বার বার যেতে হয় উপাচার্যদের।  কারণ উপাচার্য ছাড়া আর কোনও প্রশাসনিক কর্তা সেখানে নেই।  স্থায়ী উপাচার্য ছাড়া ওই সব  বিশ্ববিদ্যালয় যে অভিভাবক হীন সেটা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন  রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতরের এক অবসরপ্রাপ্ত আমলা।  তাঁর অভিজ্ঞতা, যাদবপুর, কলকাতা, উত্তরবঙ্গের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সমস্যা তেমন নেই। ওদের সব জায়গায় ঠিক ঠিক লোক এবং ঠিক ঠিক পরিকাঠামো রয়েছে। একমাত্র শিক্ষক নিয়োগ কিংবা বড় আর্থিক পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। তবে খুবই 'খারাপ'অবস্থায় রয়েছে তৃণমূলের আমলে তৈরি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। তড়িঘড়ি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে গিয়ে স্থায়ী শিক্ষক, স্থায়ী কর্মীও নিয়োগের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তার ফল এখন ভুগছে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়। রাজ্যের আর্থিক অবস্থাও এখন ভালো নয়। 
এমতাবস্থায় স্থায়ী উপাচার্য এলেও কি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়? 

উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ১০/১১/২০২৪

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.