Header Ads

স্বাধীনতা দিবস, সংবিধান দিবসঃ দক্ষিণ আফ্রিকা ও আজকের আমরা। : খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

স্বাধীনতা দিবস, সংবিধান দিবসঃ দক্ষিণ আফ্রিকা ও আজকের আমরা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

২৭ শে এপ্রিল ১৯৯৪ সাল, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ কালের আপোষহীন সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষরা স্বাধীনতা লাভ করেন। বলা বাহুল্য যে এই এপ্রিল মাস হোল শত শহীদের রক্তে রাঙা, বহু আন্তর্জাতিক ঘটনা বিজড়িত মাস। এ মাস হোল সেই মাস, যে মাসে ১৯৭৮ সালে আফগানিস্থানে PDPA বা People's Democratic Party of Afganistan-এর নেতৃত্বে নূরমহম্মদ তারাক্কির ছত্রছায়ায় সাউর বিপ্লব হয় শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে, এই মাস হোল সেই মাস যে মাসে কমরেড হো--চি--মিনের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রায় বিশ বছর ধরে চলে আসা ভিয়েৎনাম মুক্তি যুদ্ধের সফল পরিণতি লাভ হয়; এই মাস হোল সেই মাস যে মাসে নেলসন ম্যাণ্ডেলার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিশাপ মুক্তি হয় এবং বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধীতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। এই দিন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা দিবস ঘোষিত হয় এবং নূতন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান চালু হয়।
প্রকাশ থাকে যে দক্ষিণ আফ্রিকার ৮০% মানুষ খৃশ্চান, ১৫% মানুষ কোন ধর্ম পালন করেন না, ২% মানুষ মুসলিম, ১.৫% হিন্দু, ১% ইহুদি, বাকীরা অন্যান্য। অথচ এই দেশকে খৃশ্চান রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়নি, কিংবা ৯৫% মানুষ মুসলিম হলেও ইয়াসের আরাফৎ প্যালেস্টাইনকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা না করে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে ঘোষণা করে গেছেন এবং বুকের রক্ত দিয়ে প্যালেস্টাইনের বীর মুক্তি যোদ্ধারা সেই পরম্পরাকে ধরে রেখেছন। মায়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদীরা সুচি-র নেতৃত্বে মুসলিম হবার অপরাধে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের খুনে রেঙ্গুনের মাটি লালে লাল করে দিচ্ছে। অথচ ৯৫% মানুষ বৌদ্ধ হলেও হো--চি--মিনের মাটিতে কি বৌদ্ধ মৌলবাদ, কি অন্য কোন ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা গাঁড়তে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা মেকং-এর তীরে পৎপৎ করে উড়ছে। অথচ আমাদের এই মহান দেশ ভারতবর্ষ যেখানে বুদ্ধ--চৈতন্য--নানক--কবীর কিংবা--অশোক--আকবর--দারাশিকো--রবীন্দ্রনাথ--নজরুলের মত মানুষরা জন্মেছেন, সেখানে ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতির মিত্রোঁ উগ্র হিন্দু মৌলবাদের বিষ দিকে দিকে ছড়িয়ে আমাদের জাতীয় সংহতিকে বিপন্ন করছেন। তাই আজ এই বহু সংগ্রামের ঐতিহ্য বিজড়িত এপ্রিল মাসে, ২৭ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা দিবস তথা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার দিবসে আমাদেরকে একই সঙ্গে দুইটি অঙ্গীকার করতে হবে -- (১) চোখের মণির মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকারের এই দেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্র অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। (২) প্রধানমন্ত্রী মোদী জণগনের মহানুভূতি আদায়ের জন্য প্রায়ই বলে থাকেন যে তিনি চা বিক্রি করতেন। কিন্তু, এখন তো দেখা যাচ্ছে তিনি আমাদের এই দেশটাকেই আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কি অভ্যন্তরীণ নীতি, কি বৈদেশিক নীতি, সবদিক দিয়েই মোদী সরকার হোল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস। নেহেরুর আমল থেকে শুরু করে অতীতের অ বি. জে. পি. সরকারগুলির অনেক ত্রুটি--বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু, তারা কখনো হত দরিদ্র ভারতবাসীর অর্থনৈতিক ভাগ্যকে বড় বড় এক চেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির পায়ে সঁপে দেয়নি; কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্ণ বৈষম্যবাদের গোলামী করেনি। কিন্তু, এই "জয় সিয়ারাম" ধ্বনি দেওয়া প্রধানমন্ত্রী মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নরখাদক ভূমিকাকে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে যাচ্ছে। জর্ডানের তীরে, গাজার প্রান্তরে আজ কেবল মুসলিম হবার অপরাধে হাজার হাজার নারী--শিশু--আবালবৃদ্ধ বণিতা শহীদ হচ্ছে। তবু এই নারকীয় তাণ্ডবকে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে যাচ্ছে ভারত। কঙ্গো সংকটের সময় মার্কিন কংগ্রেসে, ১৯৬১ সালে প্রদত্ত এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বীরদর্পে বলেছিলেন--Where freedom is menaced and justice threatened, we Shall not be and can not be neutral। অর্থাৎ যেখানে স্বাধীনতা বিপন্ন, ন্যায় বিচার পদদলিত, সেখানে আমরা নীরব থাকতে পারি না, নীরব থাকবো না। অথচ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরমেধ যজ্ঞ দেখেও নির্বাক। ধিক ধিক, শত ধিক প্রধানমন্রীধ  মোদীকে। 
স্মৃতির কোটায় ভেসে ওঠে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। আমরা তখনো পরাধীন। কিন্তু সোভিয়েত প্রধান কমরেড স্টালিন জোর দেন যে একটি নিষ্পেষিত জাতি হিসাবে ভারতকে জাতিপুঞ্জের সভ্য করতে হবে। আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স আধিপত্যবাদী সুরে হুংকার দেয় যে পরাধীন ভারতকে এই সংস্থার সভ্য কিছুতেই করা যাবে না। কমরেড স্টালিন হাজার গুণ ধমকের সুরে জানান যে ভারতকে এই সংস্থার সভ্য করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত ওই তিন পশ্চিমী দেশ বাধ্য হয় ভারতকে পরাধীন অবস্থাতেই শুরু থেকেই জাতিপুঞ্জের সভ্য হিসাবে মেনে নিতে। এই বছরে মাত্র কিছুদিন আগে PLO আবেদন করেছে প্যালেস্টাইনে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সভ্যপদের জন্য। আমেরিকা নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েৎনাম, ভেনেজুয়েলা প্রমুখ দেশগুলি এই মার্কিন অবস্থানের তীব্র নিন্দা করেছে। কিন্তু ভারত ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টভোগী কুত্তা, সৌদি আরব এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। ভারতসহ সারা পৃথিবীর জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষরা এদের এই কাজকে ধিক্কার দিচ্ছে। শুধু গায়ে নামাবলী পরে তিলক কেটে সিয়ারাম সিয়ারাম বলে বুলি আওড়ালে কিংবা দাড়ি রেখে টুপি পরে শরিয়তের কথা উচ্চারণ করলেই, ঈশ্বর--আল্লাকে পাওয়া যায় না, ঈশ্বর--আল্লা আছেন মানুষের মাঝে। নিরপরাধ মানুষের নির্বিচার খুনের সামনে মৌনীবাবা হয়ে, খুনীদের সেবাদাস হিসাবে যারা কাজ করে, ঈশ্বর আল্লা তাদের মুখে পদাঘাত করেন। আমাদের দেশের ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতির মিত্রোঁ ও সৌদি আরবের ধনকুবের শেখদের কপালে ওটাই পাওনা। বিশ্ববাসীর কাছ থেকেও পাবে ওরা ঐ একই উপহার।
উপসংহারে বলতে চাই যে কোন একটি দেশের মুক্তি যুদ্ধ কতদিনে সফল হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। আন্তর্জাতিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর তা নির্ভর করে। আমরা ভারতবাসী পৌণে দুশো বছর ধরে সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ গতিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যসহ অনুকূল পরিস্থিতিতে এক বছরেই স্বাধীন হয়েছে; আবার ভিয়েৎনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে কিছু বেশী সময়ের মধ্যে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু প্যালেস্টাইনবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে গাজাতে, জর্ডানের দুকূলে। কিন্তু এর পাশাপাশি সারা বিশ্বের জণরোষ ও ঘৃণা বাড়ছে দিন দিন আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানী, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের বড় বড় শহরগুলিতে প্যালেস্টাইন থেকে মার্কিন ইসরায়েল হাত গোটানোর দাবী দিন দিন সোচ্চার হচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলেও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষয।  করা যাচ্ছে। ঠিক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জনসন ও নিক্সনের বিরুদ্ধে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ থামানোর দাবীতে যে গণবিক্ষোভ বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছিল, আজ প্যালেস্টাইন প্রশ্নেও জো বাইডেনের বিরুদ্ধে সেই বজ্রকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হবেই হবে--দক্ষিণ আফ্রিকার এই স্বাধীনতা তথা ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার দিবসে, এ আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। 

      
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ফোন-৯৪৩৪৩৮৫৪৮৩ (লেখকের ব্যক্তিগত মত)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.