শ্রীরাম ও মানবতার দায়
*শ্রীরাম ও মানবতার দায়বদ্ধতা*
শিবাশিস চক্রবর্তী
শ্রীরামচন্দ্র ভারতের লোকমানসে অতি শ্রদ্ধার একটি নাম। তাঁকে "মর্যাদা পুরুষোত্তম" নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। "রামরাজত্ব" সে দৃষ্টিতে একটা মিথ-এ পরিণত। রামচন্দ্র আদৌ অযোধ্যায় জন্মেছিলেন কি না, অথবা বর্তমান রামজন্মভূমিই তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান কি না, ইত্যাদি বিষয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু ঘটনা হলো, রামের নামটি সনাতন মানসে একটা চূড়ান্ত পরিপুষ্টতার( Superlative) প্রতীক হিসেবেই গাথা হয়ে গিয়েছে। রাম সে বড়া রামকা নাম- ভজন লিখিত হয়েছে। পন্ডিত ভীমসেন যোশী লতা মঙ্গেশকরকে সঙ্গে নিয়ে গান গেয়েছেন "রামকা গুণগান করিয়ে, রাম প্রভুকি ভদ্রতাকা, সভ্যতাকা ধ্যান ধরিয়ে।" অর্থাৎ , রামকে যুগপৎ ভদ্রতা ও সভ্যতার প্রতিভূ হিসাবেও আখ্যা করা হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে। রামের ভাবমূর্তিতে অনুপ্রাণিত হয়েই কাজী নজরুল লিখেছেন তাঁর কালজয়ী গান, "মন জপ নাম, শ্রীরঘুপতি রাম, নবদূর্বাদলশ্যাম নয়নাভিরাম।" নজরুলের চেতনায় শ্রীরামের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, সেই রামের আরাধনায় কোনও অমঙ্গল থাকতে পারেনা। রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ আন্দোলন প্রসূত যে "জয় শ্রীরাম" ধ্বনি আসমুদ্র হিমালয় ঝড় তুলেছিল , এর পেছনে নিঃসন্দেহে অনেকে রাজনীতি খুঁজে পেতে পারেন, কিন্তু অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে প্রভু রামের প্রতি একটা অদৃশ্য দায়বদ্ধতাও ওই আন্দোলনের পেছনে শক্তি জুগিয়েছে। ঘটনা হলো, ১৯৯২ সালের আগে থেকেই রামের নাম ভারতের ঘরে ঘরে জড়িয়ে গেছে। তাইতো রামমোহন, রামকুমার, রামনাথ, রামেশ্বর, রামেশ্বরম, রামাস্বামী,রামানন্দ, রামপ্যারি, রামসকল, রামটহল, সীতারাম, সীতারামাইয়া , রামপ্রসাদ, রামসেবক, রামজনম, রঘুনাথ, রঘুবীর, জানকীনাথ ইত্যাদি নাম রাখা হয় এবং হতো গোটা দেশের প্রতিটি রাজ্যেই। ভাষা নির্বিশেষেই। রামকে অনেকে "হিন্দিবলয়"-র দেবতা বলে ধরে নিতে অভ্যস্ত , অথচ বাংলার লোকায়ত জীবনেও রাম জড়িয়ে আছেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এখনও জনপ্রিয়। বাংলায় অনেক জায়গায় রামায়ণ গান হয়। রাঢ়বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস,রাণী রাসমণি,মুরারি গুপ্ত,চৈতন্যজীবনীলেখক দয়ানন্দ,অদ্বৈত আচার্য সহ অনেকে রামের পূজা করতেন।বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত জনপ্রিয় হওয়ার আগে অনেকেই রাম মন্ত্রে দীক্ষা নিত। রাণী রাসমণি রঘুবীরের রথযাত্রা করতেন। বীর হাম্বীর এর সময় বাঁকুড়া জেলায় অনেক রাম মন্দির তৈরি হয়। বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়াতে দুর্গাপূজার শেষ হয় "রাবণকাটা নৃত্য" দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু রাম মন্দির হল-
১. রামচন্দ্র মন্দির গুপ্তিপাড়া, হুগলি,
২. রঘুনাথ মন্দির চন্দ্রকোনা ,মেদিনীপুর ,
৩. রাম মন্দির রামরাজাতলা ,হাওড়া ,
৪. রামজীউ দেউল মন্দির, তমলুক
৫. রামচন্দ্র মন্দির চিরুলিয়া ,মেদিনীপুর,
৬. রঘুনাথ মন্দির নাশিপুর আখড়া ,মুর্শিদাবাদ,
৭. রামজিউ দেউল,তমলুক,পূর্ব মেদিনীপুর,
৮. রামসীতা মন্দির, শ্রীরামপুর, হুগলি,
৯. মাতিয়ারি রাম সীতা মন্দির,নদীয়া,
১০. রামচন্দ্র মন্দির নারাজোল,পশ্চিম মেদিনীপুর,
১১. নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের রাম সীতা মন্দির,
১২.সীতা রাম মন্দির,ঘাটাল,পশ্চিম মেদিনীপুর
১৩. চিরুলিয়ার রামচন্দ্র মন্দির ,মেদিনীপুর
১৪. সীতা রামজী মন্দির,রাউতারা, মেদিনীপুর
১৫. গড় পঞ্চকোট রাম মন্দির,পুরুলিয়া
১৬.রঘুনাথবাড়ি,লালগোলা,মুর্শিদাবাদ,
১৭.বিড়লা রাম মন্দির,কলকাতা,
১৮. দুর্গাপুরের রাম মন্দির
১৯. রঘুনাথ মন্দির,পুরশুড়া,আরামবাগ,হুগলি।
এখন প্রশ্ন হলো, অযোধ্যায় শ্রীরামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর স্বভাবতই "রামরাজ্য" প্রতিষ্ঠার একটা দায়বদ্ধতা এসে যাচ্ছে। কারণ , প্রজানুরঞ্জন প্রভু রামকে প্রকৃত সম্মান জানানো তখনই সম্ভব , যদি তাঁর পূজন কিংবা ভজনকীর্তনের মাধ্যমে প্রতিজনের মধ্যে একটা অভয় ভাব জাগ্রত হয়। অযোধ্যায় মহোৎসবের আবহে ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে রামের প্রতি যে শ্রদ্ধার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটা সেসকল সংকীর্ণ ধর্মান্ধদের জন্য অনুকরণীয়, যারা নিজের মত ছাড়া অন্য কিছুকে সহ্য করতে পারেন না এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি রপ্ত করতে গিয়ে নিজ দেশের ঐতিহ্য, নিজের রক্তের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করেন। প্রভু রামের প্রশস্তিতে তাই কাশ্মীরের মুসলিম তরুণী যখন ভজন লিখেন, কেউ জমি দান করেন, রাজা মুরাদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যখন অকপটে বলেন, "আমার ফিল্মি জীবনের যাত্রাই শুরু হয়েছে -রাম বলরাম- সিনেমা দিয়ে, জয় শ্রীরাম"। তখন ভারতীয় হিসেবে গর্ব অনুভব হতেই পারে। ভারতই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ধর্মের জন্য জাতীয়তাকে বলি না দিলেও চলে। প্রতিবেশী চিনের মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায় "চৈনিক দর্শন"-এর কাছে কত অসহায়, সেটা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সেখানে "বিতর্কিত" অযোধ্যা কিন্তু রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম দর্শনীয় মসজিদ গড়েও আরেক নজির গড়ছে। যেখানে রাখা হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোরান শরিফ। এসব ইতিবাচক অগ্রগতির হদিশও রাখা উচিৎ তাঁদের , যারা সবসময় রামভক্তদের সমালোচনা করতে অভ্যস্ত। অযোধ্যা যদি আগামীতে ধর্মীয় সম্প্রীতিরও এক অনুপম তীর্থ হয়ে উঠতে পারে, তাহলে কৃতিত্বের ভাগীদার কিন্তু হতে পারেন গোটা দেশবাসীই।
দেশে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগামীতে সরকার কোন পথ ধরে অগ্রসর হয়, সেটা অবশ্যই দেখার। ভারত যুগ যুগ থেকে ভিন্ন মত , পথকে সঙ্গে নিয়ে চলার যে ঐতিহ্য বহাল রেখেছে, এর ব্যত্যয় কেউ কখনও ঘটাতে পারবেনা। কেন না ভারতীয়দের হৃদয়ে যে রাম অধিষ্ঠিত আছেন, তিনি সততই মহানতার শিক্ষা দেন, শান্তির হদিস দেন, সহিষ্ণুতার প্রেরণা জোগান। এই রামই লোকায়ত চেতনায়, যেখানে দেখনদারি নেই, সস্তা রাজনীতির তাগিদ নেই। অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার এই ঐতিহাসিক আবহে জাতিকে সংকল্প নিতে হবে প্রভু শ্রীরাম যাতে সবার মানসে কবি কথিত"সভ্য, ভদ্র , নয়নাভিরাম" হয়েই বিরাজ করেন যুগে যুগে।####
(২২ জানুয়ারি দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে প্রকাশিত)
কোন মন্তব্য নেই