উত্তর প্রদেশের হাত রস স্টেশন বিবেকানন্দের জীবনে নতুন মোড় নিয়েছে
সময়টা ১৮৮৮ সাল। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বৃন্দাবন থেকে ঋষিকেশের পথে উত্তরপ্রদেশের হাতরাস্ রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে অপেক্ষারত। তখন এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার এক বঙ্গ সন্তান, শরৎচন্দ্র গুপ্ত। সম্ভবত দৈব নির্দেশিত কারণেই স্বামীজীর সাথে প্রথম পরিচয়ে এই স্টেশন মাস্টার পরবর্তী জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘে গুপ্ত মহারাজ নামে খ্যাত হন, সন্ন্যাস নাম স্বামী সদানন্দ। আজ স্বামীজীর অন্যতম প্রধান শিষ্য সেই *স্বামী সদানন্দের শুভ জন্মদিবস।*
১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জানুমারি (১২৭১ বঙ্গাব্দের, ২২শে পৌষ) কলকাতার গড়পা অঞ্চলে শরৎচন্দ্রের (পূর্ব নাম) জন্ম হয়। তাঁর পিতা যদুনাথ গুপ্ত ১৮৬৮ সালের কোন সময়ে সপরিবারে বারাণসীর কাছে জৌনপুরে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সেজন্য বাঙালী হলেও শরৎচন্দ্র বাংলা ভাষার থেকে হিন্দী ও উর্দু ভাল জানতেন। তাঁর দাদা অধরচন্দ্র গুপ্তও গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।
হাতরাস্ স্টেশনে প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে শরৎচন্দ্রের অনুরোধে স্বামীজী কিছুদিন তার স্টেশন সংলগ্ন গৃহে বাস করেছিলেন। স্বামীজীর অপূর্ব সান্নিধ্যে সেই দিন কয়েকের মধ্যেই শরৎচন্দ্রের সম্পূর্ণ ভাবান্তর ঘটে এবং রেলওয়ের সরকারী চাকরি ছেড়ে স্বামীজীর সাথেই ঋষিকেশের দুর্গম পার্বত্য পথে যাত্রা শুরু করেন। স্বামীজি তাঁর নতুন শিষ্যকে ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত করে নাম দেন সদানন্দ।
গরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ এরপর সদানন্দের অসুস্থতার কারণে কেদার-বদ্রি দর্শন মুলতবি রেখে ঋষিকেশ থেকে পুনরায় হাতরাস্ ফিরে সদানন্দকে সেখানে রেখে বরাহনগর মঠে ফিরে আসেন। সদানন্দ সুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন পরে বরাহনগর মঠে যোগ দেন। বরাহনগর মঠে যোগ দিয়ে পশ্চিমী প্রথা অনুসারে সদানন্দ সব সাধুদের 'মহারাজ' বলে সম্বোধন করতে আরম্ভ করেন। সেই থেকেই মঠে সাধু সন্ন্যাসীদের সম্মোধনে 'মহারাজ' কথাটির প্রচলন হয়।
১৮৯০ সালে স্বামীজীর নির্দেশে কাশীতে অসুস্থ অভেদানন্দজীর সেবায় সদানন্দ আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৯১ সালের নভেম্বরে মঠ যখন আলমবাজারের স্থানান্তরিত হয় সদানন্দ তখন রামকৃষ্ণানন্দজী, প্রেমানন্দজী প্রমূখ শ্রীরামকৃষ্ণ সন্তানদের সঙ্গে নতুন মঠের কাজে খুব পরিশ্রম করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তিনি রামকৃষ্ণানন্দজীর সাথে মাদ্রাজে রামকৃষ্ণ মিশনের কার্য সূচনায় নিযুক্ত ছিলেন। এরপর স্বামীজীর পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও উত্তর ভারত ভ্রমণের সময় সদানন্দ আবার তাঁর পূণ্য সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।
৩১ শে মার্চ ১৮৯৯, সদানন্দের নেতৃত্বে কলকাতায় প্লেগ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। কলকাতার বস্তিগুলিতে জঞ্জাল পরিষ্কার থেকে শুরু করে সদানন্দ সমস্ত রকম দুর্গন্ধময় আবর্জনাও নিজহাতে অম্লানবদনে সাফ করতেন। শুধু কলকাতায় নয়, এরপর ১৯০৪ সালে ভাগলপুরে যখন প্লেগ মহামারী দেখা দেয় সেখানেও সদানন্দের নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সেবাকাজ পরিচালিত হয়েছিল।
১৯০২ সালের চৌঠা জুলাই স্বামীজীর দেহাবসানের দিন সদানন্দ মঠেই উপস্থিত ছিলেন। হাতরাস্ স্টেশন থেকে শুরু করে বেলুড় মঠ পর্যন্ত, স্বামীজীর সাথে দীর্ঘ ১৪ বছরের পূণ্য সান্নিধ্যের অবসানে সদানন্দ কার্যত ভেঙে পড়েন। এরপর থেকে তিনি জপ-ধ্যান ও ছোট-ছোট যুবক গোষ্ঠীর মধ্যে স্বামীজীর ভাব বিস্তারের কাজে নিজেকে যুক্ত করেন।
১৯০৩-এর মাঝামাঝি সদানন্দ জাপান সফরে গিয়েছিলেন ব্রহ্মচারী অমূল্যকে সাথে নিয়ে। স্বামীজীর জীবনী থেকে আমরা জানি যে, জীবনের শেষ দিকে স্বামীজি জাপান-মন্ত্রকের আমন্ত্রণ সত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেখানে বেদান্ত প্রচারে উপস্থিত হতে পারেননি। স্বামীজির সেই অসমাপ্ত কাজ সদানন্দ সম্পূর্ণ করেন। ভগিনী নিবেদিতার উক্তিতে, "তাঁর (সদানন্দের) দেহে স্বামীজি সেই ভূমিতে (জাপানে) যেতে চান, এই আমার বিশ্বাস।" ১৯০৪ সালে সদানন্দ পুনরায় ভগিনী নিবেদিতার সাথে প্রচার সফরে গিয়েছিলেন।
এরপর থেকে সদানন্দের স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে এবং দু'বছরেরও বেশি সময় তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। শ্রীশ্রীমা স্বয়ং বোসপাড়া লেনের বাড়িতে অসুস্থ সদানন্দকে দর্শন দিতে এসেছিলেন। মৃত্যুশয্যাতেও সদানন্দের জপের বিরাম ছিল না। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯১১, বেলা তিনটার সময় তিনবার স্বামীজীর নাম উচ্চারণ করে গুপ্ত মহারাজ স্বামীজীর পাদপদ্মে মিলিত হন। আজ এই মহাজীবনের পূণ্য জন্মদিবসে আমরা জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রণাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
তথ্যসূত্রঃ স্বামীজীর পদপ্রান্তে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যদিও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পরম্পরায় শ্রীশ্রীঠাকুর এবং পার্ষদগন ব্যতীত জন্মতিথি / জন্মদিবস পালন করা হয় না কিন্তু বিশিষ্ট মহাজীবনের স্মৃতিচারণা সাধারণের অনুপ্রেরণাদায়ক এবং সেজন্যই স্বল্প পরিসরে স্মরণ-মণনের প্রয়াস।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কোন মন্তব্য নেই